অনার এন্ড কিলিং

মোনেম অপু
Published : 3 Oct 2015, 07:14 PM
Updated : 3 Oct 2015, 07:14 PM

সেরেফ সেলফ ডিফেন্স নয়, অনারের খাতিরেও ম্যান-মনুষ্য-ইনসান নানা কিসিমের খুনাখুনি করে, গোলাগুলি করে, এবং আরও করে বোমাবাজি।

এক আওরতের প্রেমে পড়া দুই মর্দ্দের ডুয়েল লড়া সেই কবে থেকে ইতিহাস। তবুও এটা দিয়েই শুরু করা যাক। শিভালরি বলে কথা! পেয়ারে মজলে মরদের আক্কেল উরুণ্ডি হয়। আর দুই মর্দ্দ এক মাইয়ার পিরিতে ভাসলে সমাজের গুষ্ঠিশুদ্ধ সক্কলের বুদ্ধিনাশ ঘটে। আহ! কী বায়োস্কোপিক দৃশ্য! মরদে মরদে মরণ খেলা। আর নারীটি চুপটি করে বসে আছে ঘরে। গাজির অপেক্ষায়। এবং মুণ্ডুর উপর সমাজ হলো-গে নিরপেক্ষ রেফারি। এতো ঘনঘটায় ফাঁক বা ফাঁকি—যাই বলুন, সেটা এই অ-বলা সত্যটির মধ্যে যে, মরদ বাছাইয়ে আওরতের কোনো শেষকথা থাকতে নেই। আর এই না থাকাটা পুরুষের এতই প্রিয়, তার জন্য এতই আবশ্যকীয় যে, স্বজাতের গুলিতে প্রাণটা বেঘোরে হারানোও শ্রেয়তর। মদ্দের অনার মদ্দই রাখুক, আওরত-কা মুখ থাকুক কুলুপে আঁটা। মরদের মরণের মতো আওরতের জিনাও যেন দুই পয়সার।

ডুয়েল এখন ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস হয়নি আওরতের তকদির। আমাদের সমাজে অনেক নিকে হয় খাড়া একটা চাদরের আড়ালে বসা আওরতের কবুলের মধ্য দিয়ে। কেই-বা বললো কবুল, স্বাক্ষীরাইবা শুনলো কী, কে জানে! নিকে হয়ে গেল। শরম নারীর অনার। তাই খাড়া পর্দা ও সেহেলির প্রক্সি বেহতর। আব্বা খুশি, আম্মা খুশি, খুশি পাড়ার পড়শি: অবশেষে ছেরির বিয়া তো হইল। পরে মইলো কি বাঁচিলো, সে তো আখের-কা বাত।

আজও বহাল তবিয়তে বহাল আছে চৌদ্দগুষ্ঠির অনার ঠেকাতে নিজের মেয়েকেই খুন করে ফেলার রেওয়াজ। বাপ হয়েও এককালে নিজের শিশু কন্যাকে বালুতে পুঁতে অনার রক্ষা করতো মহান পিতা। সে প্রথা উচ্ছেদের গর্বে পেট ফুলে মরা মুসলমানের বন্দুকের গুলিতে এখনও নিজের যুবতী কন্যার দেহ নিথর। এখানেও পুরুষ নির্বাচনে নারীর অধিকার অতি আশ্চর্য বিষয়। সে অধিকারে যে গুষ্ঠির ডিজঅনার। কাজেই বুকে বুলেট বিঁধিয়ে দাও। কিলিংয়েই অনার।

তা ছাড়াও আছে টুকটাক অনার ফিলিং। ফিলিং থেকে কিলিং। মুসলমানেরে বারবার আদালতে আনলে ইনসাফের খেলাফ হয়। হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই, বৈষম্যেরও উপায় নাই। কাজেই ভাইয়েরে একবার দাঁড় না করালে কাঠগড়ার অপমান। মুসলমানে গরু খেলে হিন্দুর ডিজঅনার। অনার রক্ষায় যষ্টি-কিলিং। দলিত মন্দিরে গেলে অ-দলিতের ডিজঅনার। অনার রক্ষায় অগ্নি-কিলিং।

এ তো গেল মর্দ্দানি আর গুষ্ঠিয়ানির বয়ান। মুলুকিয়তরেও বয়ান আছে। অনার কায়েমে পড়শি মুলুকের একটাকে-দুটাকে রুটিন করে ফেলে দাও, মনে ধরলে বেড়ায় ঝুলিয়ে দাও। সীমান্তে ফুটুস-ফাটুসের আরও ভেলিক আছে। কেন্দ্র নড়বড়ে হলে ডিজঅনার ঠেকাতে পরিধিতে ঠুস-ঠাস। ভারত-পাকিস্তান—দুইয়েরই পাল্টাপাল্টি ব্যাপক অভিজ্ঞতা। রাখে আল্লাহ, মারে কে? নেপাল, ভুটান, লঙ্কা লাগালাগি সীমান্তের অভাবে মরে একটার হাত থেকে আরেকটা বেঁচেছে।

শুধু গুলি কেনো, অনার হেফাজতে বোমাও জব্বর কামের। মার্কিনিরা বোমা ফেলে, ফেলে বিলাতিরা। তাও তো সহ্য হয়। আসাদ-এ-আলম, শের-এ-সুবা বলে কথা! তাই বলে চামচিকে তোমরাও? হায়রে! চোখের সামনে তুর্কি ফেলছে কুর্দির মাথায়। ফেলছে ইরান, ইরাকের জমিনে। সৌদের ছাওয়েরা বিলকিসের দেশে। সিংহর সাথে, বাঘের সাথে পাল্লা দিয়ে তরক্কিতে অনার চামচিকেরও। আর এতে সাদা ভালুকের অনার যে যায় যায়! ইউক্রেনের সাথে গা ঘষালেই কি আর রোশনাই ফেরত আসে? আধেক দুনিয়ার শাহেনশাহী জাহেরে অতীত হলেও এতো জলদি ইয়াদাশ থেকে হাওয়া হয় না। ছাগীর তিন নম্বর বাচ্চা অনারের খোঁজে যেমন করে এপাশ ওপাশ তিড়িংবিড়িং করে, তেমন করে আর কতকাল? সিরিয়াই মওকা। ফেল বোমা। আদায় করে নাও অনারের হক। অধিকার কেউ কাউকে আদর করে সেধে দেয় না। বোমা ফেলে, ঘর গুড়িয়ে, খুন ঝরিয়ে আদায় করে নিতে হয়।

আরও আছে সকালের রুটির মতো রুটিন অনার। আমেরিকায় জঙ্গিরা কত পাপই না করে বেড়ায়। গড়ে বছরে ডজন দুয়েকের পবিত্র রক্তে তাদের গান্ধা হাত আরও গান্ধা হয়। আরও আছে অবাক বিস্ময়। গানে-ভায়োলেন্সে সেই মুলুকেই মরে গড়ে বছরে তিরিশ হাজার, দিনে আশি। বন্দুকের গুলিতে মরণ সেখানে রুটিন কারবার। পোডিয়ামের পেছনটাও ওবামার রুটিন দফতর। নিহতের, জীবিতের অনার গুলাব, মুনাজাত, আর বয়ান: মুইরা ডরাই না, মুইরা হার মানি না, মুইরা সব বন্দুক-পাণি কবিলা, মুইরা শহিদ-গাজির কউম—সেও রুটিন। হক কথা, কুল্লে আওয়ামের হাতে বন্দুক থাকলে হর আদমী আমনে থাকে। কাউবয়ের মগজ তাই মাথার হ্যাটে, আর অনার কোমরের পিস্তলে। সত্যিই তো! ভরা পেটে মরে গেলে, পেট ভরিয়ে লাভ কী? অতএব, দুনিয়াটা ভরে দাও পিস্তলে বন্দুকে। আমন কায়েম কর ঘরে ঘরে। আগে প্রাণ-মান, পরে পেট-মাল। নিজে বাঁচলে তবেই না বাপের নাম।
.