আন্তঃব্লগার যোগাযোগ সমস্যা — ২য় অংশ: প্রজেকশন

মোনেম অপু
Published : 7 Oct 2015, 04:02 PM
Updated : 7 Oct 2015, 04:02 PM
ভাষার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। আকাশের রংয়ের ছাপটি দ্রষ্টার মনের একটা 'ভাব'। দুজন দ্রষ্টা একই শব্দ 'নীল' ব্যবহার করলেও একের ছাপটিকে কিন্তু অন্যজন প্রত্যক্ষ করেন না বা করতে পারেন না। আমরা বিশ্বাস করি যে, অন্যেও আমারটার মতোই একটি ছাপ দেখতে পান। বিশ্বাসটি তৈরি হয় 'নীল' নামক বিবরণটির মাধ্যমে। রংয়ের 'সমরূপতার' ধারণার সাথে এই 'বিশ্বাসের' একটি সম্পর্ক রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই 'নীল' রংয়ের মতো 'নীল' ধ্বনীসমগ্রটিও একই সমস্যায় আক্রান্ত। সে যাই হোক, এই সমরূপতার ধারণার মূলে কিছুটা হলেও একটি অনুমান কাজ করে। আর এর নির্গলিতার্থ দাঁড়ায়, নিজেকে অন্যের উপর সামান্য হলেও আরোপ করা।

এ তো গেল বর্ণ, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদির ব্যাপার। নৈতিকতা, নান্দনিকতা, রোমান্টিকতা, আইডিওলজি ইত্যাদি নিরেট ভাবের বেলায় জটিলতা আরও গভীর। বর্ণ, শব্দ নিয়ে দরকারি ভোকাবুলারির চেয়ে এই মূল্যায়ন সংক্রান্ত পরের বিষয়গুলোর ভকাবুলারি আয়তনে অনেক অনেক বড়। এখানকার শব্দগুলো অর্থ বা অভিধা বিচারে খুবই তরল, এবং অনেক ক্ষেত্রে রীতিমতো বায়বীয়। ফলে এখানে সমস্যা অত্যধিক এবং গুরুতর। ব্লগে আমাদের যোগাযোগের কন্টেন্ট বস্তু-স্থান-কালের বিবরণ নয়, গণিত বা বিজ্ঞানের মতো তা কনক্রিট নয়; বরং প্রধানত রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে মতাদর্শ ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত। ফলে কার্যকর ও ফলপ্রসূ যোগাযোগ সহজ নয়।

ভাবের আরেকটি প্রকার হচ্ছে কল্পনা, যা কিনা সবচে বেশী বেয়াড়া ও বেপরোয়া। একটি গল্প রয়েছে। এক চোর, এক সাধু ও অন্য আরেকজন—মোট তিনজন খুব ভোরে নদীতে গোসল করতে গেল। চোরটি ভাবলো অন্য দুজনও বুঝি তার মতোই গায়ের কালি-ঝুলি সাফ করতে এসেছে। সাধু ভাবলো অন্য দুজনও বুঝি উপাসনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আর তৃতীয় ব্যক্তিটির ধারণা হলো, অন্য দুজন তারই মতো গা-গতর ধুয়ে পরিষ্কার করতে এসেছে। এটি নিছক গল্প হলেও তা 'অন্যের মধ্যে নিজেকে প্রজেক্ট করা'র আমাদের সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাটিকে তুলে ধরেছে। এখানে বিশ্বাসের বদলে কল্পনা বা বন্য অনুমান বেশী কাজ করেছে।

এ রকম কল্পনা যে কেবল সমভাবে কাজ করে তা নয়, বিপরীতভাবেও করতে পারে। আমাদের চোখের সাত রং থাকলেও, মন কেবল দুটি মাত্র রংয়ে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারে—সাদা ও কালো। তখন লাল-বেগুনী ইত্যাদি অন্যান্য বাহারি রং দূরে থাক, সাদা ও কালোর মাঝেও যে হাজারও ধুসর শেড রয়েছে সেগুলোও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। যদিও আমরা 'দোষে-গুণে মানুষ' বলতে পছন্দ করি, তবুও আদতে প্রায়শই আমরা 'হয় দোষী, নয় গুণী' এই দুই স্তরের একটি বলেই অপরকে ধরে নেই। এরই অগ্রসর ধাপ হচ্ছে 'উইথ আস অর এগেইনস্ট আস' মীমাংসা। অর্থাৎ প্রজেকশনটা হয় 'ডাইরেক্ট' 'আমার মতো গুণী' রূপে; অথবা 'ইনভার্সলি', তথা 'আমার মতো গুণী নয়', তথা 'সে দোষী' রূপে।

পূর্বে বলা গল্পটিকে ঘুরিয়ে তাই এভাবেও তৈরি করা সম্ভব । চোরটি ভাবছে, অন্য দুজন আমার মতোই চোর। সাধুটি ভাবছে, অন্য দুজন আমার মতো সাধু নয় ইত্যাদি। এটিই বেশী প্রচলিত যে, যে নিজেকে ভাল মনে করে, সে অন্যকে নিজের মতো ভাল মনে করে না; এবং যে নিজেকে মন্দ মনে করে, সে অন্যকেও নিজের মতোই মন্দ মনে করে থাকে। তবে আমরা যে অন্যকে সর্বদাই মন্দ মনে করি—তা নয়। যখন দেখি অন্য কেউ ভাষার মাধ্যমে আমার মনের ভাবের অনুরূপ ভাব প্রকাশ করছে, অর্থাৎ আমার মনের মতো করে কথা বলছে, তখন আমি তাকে আমার মতো ভাল বলেই জ্ঞান করে থাকি, 'উইথ আস' বলে মীমাংসা করে থাকি। এই যে মনের মতো আর মনের বিপরীত কথার ভিত্তিতে রেখা টানা ও রেখাটিকে প্রধান করে তোলা—এটিকে সংক্ষেপে বলা যায় স্টেরিওটাইপ করা।

ব্লগ তৈরি করতে হয় ভাষাকে অবলম্বন কর। গণ-ব্লগ-সাইট আবার বহু ব্লগারের বিচরণস্থল। ফলে এখানে একটি সাদা-কালো বিভাজন তৈরি হতে পারে। এই বিভাজনের একটি ভিত্তি হচ্ছে আদর্শ, মতবাদ ইত্যাদি। মতাদর্শ এখানে 'ভাব'। ভাব যখন ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় তখন ভাবটা যেমন গবেষণার বিষয় হয়, তেমনই ভাবুকটা, মানে ব্লগারটিও গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ভাব, বক্তব্য বা বার্তাটির বিচার ছাড়িয়ে যখন ব্লগারের বিচার শুরু হয় তখন সংকট ঘনীভূত হয়। বিভাজন রেখাটি মতাদর্শের ভিন্নতার মধ্যে সীমিত না থেকে তা বিস্তৃত হয়ে পড়ে ব্যক্তিবর্গের বিভাজনে। এ থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্কে টানাপড়েনের সূচনা পর্যন্ত হয়।

একই জাতি-ভাষা-রাষ্ট্রের অধিকারী হলেও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সাংস্কৃতিক পার্থ্যক্য থাকে, তা থেকে শব্দের ব্যঞ্জনায় ফারাক হয়। পাঠকের কাছে কোনো শব্দ অবমাননাকর হলেও, ভিন্ন আঙ্গিকে ও কোণ থেকে ক্রমাগত দেখতে থাকায় ও দীর্ঘদিনের ভিন্ন ব্যবহারে শব্দটি লেখকের কাছে নিরীহ হয়ে উঠতে পারে। রম্যরচনা, কৌতুক, ঠাট্টার ভাষায় সমস্যাটি প্রকটতর হতে পারে। এখনকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের ব্যবহৃত শব্দে আশির দশকের ছাত্ররা অবাক হতে পারে, সত্তরের দশকের ছাত্ররা ভিরমিও খেতে পারে। সত্তর-আশিতে রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি পড়ুয়াদের কাছে আজকের হুমায়ুন-মিলন পড়ুয়াদেরকে, এখনকার সিনেমা-নাটক দেখুয়াদেরকে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। লালিত-পালিত হবার সংস্কৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশে ফারাক হয়। ফারাকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরণের পার্থক্য থেকে আসতে পারে, আসতে পারে অর্থনৈতিক শ্রেণি পার্থক্য থেকে।

অন্যদিকে, আপনি যত বড় করেই লিখুন না কেন, তার বাইরে অনুক্ত থাকে আরেকটি বিরাট অংশ। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তা ক্রমেই অধিকতর পরিষ্কার হয় বটে, কিন্তু সম্পূর্ণতা কখনোই পায় না। দুজনের ভাষা বাংলা হলেও যতটুকু লিখিত হয়েছে ততটুকুর তাৎপর্য নির্ধারণে দুইয়ের মানসিক গঠনে ফারাকের কারণে তাৎপর্যে ভিন্নতা তৈরি হতে পারে। আর যা অনুক্ত রয়ে যায় তা নিয়ে পাঠক কল্পনার আশ্রয় নিয়ে লেখকের কথার বাইরে গিয়ে আরও অনেক কিছু ধারণা করে বসতে পারেন।

কিন্তু এরূপ সম্প্রসারণের নানা বিচিত্র ও পরস্পর বিরোধী সম্ভাব্য রূপ রয়েছে। কল্পনাপ্রসূত এসব নানা সম্ভাব্য রূপের মধ্যে কোনটি সংঘটিত/প্রকাশিত হবে তা পাঠকের নিজ দ্বারাই নির্ধারিত হয়। কল্পনার ভিত্তিতে যখন পাঠক প্রত্যুত্তরে কিছু লিখেন তখন লেখক ও পাঠকের মধ্যে বিরোধের সূচনা হয়। পাঠক যখন প্রত্যুত্তরে কিছু লিখেন তখন পূর্বের পাঠকটি লেখকের এবং পূর্বের লেখকটি পাঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ফলে সংকটের ঘনত্ব চক্রাকারে ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বক্তব্য নিয়ে বিরোধ পরে ব্যক্তিগত বিরোধে পর্যবসিত হয়।

এ অবস্থায় উপনীত হলে কল্পনা লাগাম-ছাড়া হয়ে পরে। কারণ আমদের অধিকাংশ ব্লগারদের মধ্যে বাস্তব জীবনে সাক্ষাৎ পরিচয় নেই। দীর্ঘদিনের ও নানা রকমের পরিস্থিতিতে মিথস্ক্রিয়ায় একজন অপরজন সম্বন্ধে যত অবজেকটিভ ধারণা অর্জন করতে পারেন, কেবল অল্প কিছু লেখা পাঠ করার মাধ্যমে তা অর্জন করা যায় না। ফলে ব্যক্তিটিকে যদি 'কায়া' হিসেবে ধরা যায় তবে তার লেখাকে 'ছায়া'র বেশী কিছু বলা চলে না। আমরা সবাই নিশ্চয়ই জানি যে, ছায়া দিয়ে কোন কায়ার পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় না। ছায়া থেকে কায়ার কনস্ট্রাকশন গুরুতরভাবে ভ্রান্ত হয়ে উঠার সম্ভাবনাই সবচে বেশী।

অতএব, যোগাযোগ সংকটের মূলে রয়েছে:
(ক) ভাব প্রকাশে ভাষার সীমাবদ্ধতা;
(খ) লেখক ও পাঠকের লালিত-পালিত হবার সাংস্কৃতিক পরিবেশের ভিন্নতা;
(গ) দুইয়ের মানসিক গঠনে ও প্রবণতায় ফারাক; এবং
(ঘ) বন্য কল্পনা ও মাত্রাতিরিক্ত অনুমানের বশবর্তী হয়ে দ্রুত অন্যকে স্টেরিওটাইপ করে ফেলা এবং তার একটি বৈশিষ্ট্যকে প্রধান করে তুলে তার ভিত্তিতে তার পরিচয় নির্মাণ করা ।

ফলে, বাচনিক মিথস্ক্রিয়াটি স্পষ্টত প্রকাশিত বক্তব্যের মধ্যে সীমিত রাখলে, অপ্রকাশিত অংশের জন্য ব্যকুল না হলে, শব্দের অর্থ নির্ধারণে একটি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখলে এবং বিষয়টিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে টেনে না নিয়ে গেলে একটি সুস্থ ও সুফলপ্রসূ মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।