সুবর্ণ বিধির তৃতীয় রূপ – শেষ অংশ

মোনেম অপু
Published : 18 May 2011, 11:55 AM
Updated : 18 May 2011, 11:55 AM

প্লাটিনাম রূপের নেতিবাচক রূপ:

অত্যাচার করবে না, যেন কেউ তোমার উপর অত্যাচার করতে না পারে। (১৮)

এটি নবী তাঁর বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন। এবার আমরা এই বচনটি পরীক্ষা করে দেখি।

১. এখানে প্রথমে এসেছে নিঃশর্ত আদেশটি, তারপর এসেছে যুক্তি/কারণ এবং প্রয়োগ একসাথে, একটি কথার মধ্য দিয়ে। এ আদেশটি এমন কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, যাতে অত্যাচারীর উপর অত্যাচার করা বৈধ হয়। নিঃশর্ত আদেশটির স্পষ্ট অর্থ হলো: অত্যাচার করবে না—এমনকি অত্যাচারীর উপরেও না, প্রতিরক্ষা-কালে অত্যাচারী শত্রুর উপরেও না।

২. আমি যদি এটিকে প্রত্যাশার সাথে যুক্ত করি তবে এরকম দাঁড়ায়:

আমি ক্ষতি থেকে ঈশ্বরের নিকট আশ্রয় প্রত্যাশা করি, তাই আমি অত্যাচার করি না। (১৯)
আমি যেহেতু অত্যাচার করি না, সেহেতু অন্য মানুষেরা আমার উপর অত্যাচার করতে পারবে না। (২০)

২. এখানে আমি অত্যাচারীর ইচ্ছা থেকে স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল, স্বনির্ভর, স্বাবলম্বী, সক্রিয় নির্ধারক এবং নিজের জন্য স্বাধীন পরিবেশের লক্ষ্যে অহংকারী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সতর্ক ও দৃঢ়।

৩. নবীর প্রকাশ ভঙ্গি থেকে পাওয়া যায় এমন অন্য রূপগুলো হলো:

আমি অত্যাচার করি না, তাই আমার উপর অত্যাচারের যুক্তি অহংকারীর নিকট নেই। (২১)
আমি অত্যাচার করি না, তাই অন্যের অত্যাচার থেকে প্রতিরক্ষা করার অধিকার আমার আছে। (২২)
আমি অত্যাচার করি না, তাই আমি নিজেকে অত্যাচারিত হতে দেব না। (২৩)

৪. যদি আমরা নেতিবাচক সুবর্ণ বিধির অর্থাৎ এটির রুপালি রূপটি উল্টোভাবে প্রকাশ করি তবে কী পাই?

আমি আঘাত চাই না, তাই আঘাত করি না।
উল্টালে হয়: যে আমাকে আঘাত করবে আমি তাকে প্রত্যাঘাত করব।

কিন্তু এটি প্রত্যাঘাতের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে না এবং মাত্রাও নির্ধারণ করে না; মাত্রাটি আমরা পাই অন্য জায়গা থেকে—দণ্ডবিধি থেকে। নবীর রূপটিকে কোনোভাবেই উল্টিয়ে পালটিয়ে অর্থপূর্ণ কোনো বচনে পরিণত করা যায় না। করলে যা দাঁড়ায়: আমি অত্যাচার করব, যেন অন্যে আমার উপর অত্যাচার করতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই আপনি নবীর কথা থেকে একথায় উপনীত হতে পারবেন না যে, কেউ আমাকে মারলে, আমি তাকে মারবো। আপনি কেবল বলতে পারেন: কেউ আমাকে মারতে আসলে, তাকে আমি আমাকে মারতে দেব না।

৫. নবীর বিধিটি নিজেই উদ্দেশ্য ঠিক করে দিচ্ছে।

উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট: নিজেকে অত্যাচার থেকে প্রতিরক্ষা করা, এর বেশী কিছু অবশ্যই নয়।

উদ্দেশ্যটি তাই প্রতিরক্ষায় প্রয়োগযোগ্য শক্তির পরিমাণ নির্দেশ করে। উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কী কাজ করা যায়?

ক) প্রথম কাজ দাঁড়াচ্ছে নেগোশিয়েট করা যেন অত্যাচারী ফিরে যায়।
খ) যতটুকু শক্তি নিয়ে অত্যাচারী এসেছে ততটুকু পাল্টা শক্তি প্রয়োগ করে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করা, এতে অত্যাচারী ফিরে যাবে।
গ) যদি তার কম শক্তিই যথেষ্ট হয় তবে বেশী শক্তি প্রয়োগ করা যাচ্ছে না, কারণ কমেই যে উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে।
ঘ) নেগোসিয়েশনের পথ রুদ্ধ না করা বা অত্যাচারী অত্যাচারের নীতি/পথ থেকে সড়ে গেলে আর না এগুনো। ইত্যাদি ইত্যাদি।

(আমি এখানে যা উল্লেখ করলাম তা বুঝার সুবিধার্থে উদাহরণ হিসেবে মাত্র। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে বা জাতীয় পর্যায়ে বড় রকমের বিরোধের ক্ষেত্রে অনেক ফ্যাক্টর/প্যারামিটার বিবেচনা/গণনা মধ্যে আসতে বাধ্য। কিন্তু মূল কথাটা বা প্রক্রিয়াটা বা অর্জিতব্য উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝেছেন।)

৬. নবীর কথাটিকে কোনোভাবেই আগ্রাসনের সমর্থনে প্রয়োগ করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। যদি কেউ করে, তবে তা হবে সীমা লঙ্ঘনের দিকে যাত্রা, ও নিজেই অত্যাচারী হয়ে ওঠা; এতে অত্যাচারীর হাতে পাল্টা আরও অত্যাচারের যুক্তি তুলে দেয়া হয় ও তৈরি হয় অত্যাচারের বৃত্ত।

৭. এটি অত্যাচারীকে ঘৃণা করার বৈধতা দিচ্ছে না, কারণ ঘৃণা করে অত্যাচারীকে প্রতিহত করা যায় না, অর্থাৎ উদ্দেশ্য অনর্জিত থাকছে। উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন কেবল জ্ঞান, মনের দৃঢ়তা ও বস্তুগত সমর শক্তি। বরং ভালবাসা উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক বিধায় ও আগের রূপ বাতিল না হওয়ায় ভালবাসাকে বাধ্যতামূলক রাখছে।

৮. এটি আবার বিচারের নীতিও হয়ে উঠে, কারণ এখানে সর্বদা সতর্কতা, বিচারশীলতা ও মাত্রাজ্ঞান বজায় রাখতে হয়। প্রতিরক্ষা হলো নিজের প্রতি ন্যায় বিচার; এখানে অত্যাচারী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অত্যাচার করতে এসে, নিজের প্রয়োগ করা মোট শক্তির বিপরীতে অত্যাচারিতের কাছ থেকে ন্যূনতম সম্ভব শাস্তিটুকু নিয়ে ফিরে যায়। এ শাস্তি/ক্ষতি অত্যাচারীর নিজের উপার্জন।

৯. তবে সামাজিক ন্যায় বিচার থেকে এটার পার্থক্যটা এখানে যে, নিজেকে রক্ষার জন্য যতটুকু আবশ্যক তার বেশী ক্ষতি অত্যাচারীর উপর আরোপ করার অবকাশ নেই, নির্বিচারে নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগেরও অবকাশ নেই। ক্ষমা সম্ভব হলে তাই সর্বোত্তম।

১০. সামাজিক ন্যায় বিচারের ব্যাপারটি ঘটে অন্য দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা ক্ষেত্রে, এখানে প্রাধিকারের প্রয়োজন হয়। এখানে পূর্ণ সুবিচার বাধ্য হয়ে ওঠে; নালিশের বিপরীতে অত্যাচারিত পক্ষ নিজে যতটুকু ক্ষমা করেন কেবল ততটুকু বাদে। অন্যদিকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পূর্ণ সুবিচার অপরিহার্য।

উপসংহার

প্রতিজ্ঞা-৫
সুবর্ণ বিধির রুপালি বা সুবর্ণ রূপ প্লাটিনাম রূপকে প্রতিহত করে না। প্লাটিনাম রূপ রুপালি বা সুবর্ণ রূপকে বাতিল করে না—মনের বিস্তার ও কর্মক্ষেত্রের ব্যাসকে প্রসারিত করে মাত্র।

প্রতিজ্ঞা-৬
প্লাটিনাম রূপ প্রয়োগ করতে গিয়ে যদি রুপালি বা সুবর্ণ রূপ ভেঙ্গে পড়ে তবে বুঝতে হবে প্রয়োগে কোথাও ভুল হচ্ছে।

মুসার ধর্মকে বলা যায় আইনানুগত্যের ধর্ম, যিশুর ধর্মকে প্রেমের ধর্ম এবং মুহম্মদের ধর্মকে ন্যায় বিচারের ধর্ম। কিন্তু এটি বড় সংক্ষিপ্ত প্রকাশ। আসল কথা হলো: মুসার ধর্ম আইনানুগত্যের ধর্ম, যিশুর ধর্ম আইনানুগত্য ও প্রেমের ধর্ম এবং মুহম্মদের ধর্ম আইনানুগত্য, প্রেম ও ন্যায়-বিচারের ধর্ম।

কিন্তু, ইসলাম ধর্ম ন্যায় বিচারের ধর্ম—কেবল এইটুকু শুনতে শুনতে আমাদের হৃদয় পাষাণ হয়ে গেছে।

আবার এভাবেও বলা যায়: মুসার ধর্ম হাতকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখার ধর্ম; যিশুর ধর্ম অত্যাচার থেকে বিরত থাকা ও মনের ভালবাসাকে সর্ববিস্তৃত করার ধর্ম; আর মুহম্মদের ধর্ম অত্যাচার থেকে বিরত থাকা, মনের ভালবাসাকে সর্ববিস্তৃত করা এবং সতর্কতা, বিচারশীলতা ও চিন্তাশীলতা সচল রাখার ধর্ম। সংক্ষেপে বললে: মুসার ধর্ম হাতের ধর্ম, যিশুর ধর্ম হাত-মনের ধর্ম, মুহম্মদের ধর্ম হাত-মন-বুদ্ধির ধর্ম।

কেউ কি সুবর্ণ বিধির কোনো নতুন অথচ উন্নত রূপ কল্পনা করতে পারেন? একথা যথার্থই কি বলা যায় না যে, মুহম্মদে মানুষের ধর্ম পূর্ণ হয়েছে?

(সমাপ্ত)