পুঁজিবাদী আধুনিকতাবাদ আমাদের জন্য বৈষম্য ভিত্তিক যে মূল্যবোধ তৈরি করেছে ও সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছে তার পরিপূর্ণ প্রতিফলন রয়েছে ঈদে টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমালায়। আর এই প্রতিফলনের গণ ভিত্তিও রয়েছে—আমরা আমজনতা তা-ই দেখতে চাই, ‘খেতে’ চাই। যদিও ‘ইসলাম আমাদেরকে সাম্য, সহমর্মিতা শিক্ষা দেয়’—এরকম সব কথা সারা রোজার মাস জুড়ে চ্যানেলগুলোর নানা আলোচনা অনুষ্ঠানে বলা হয়ে থাকে, কিন্তু ঈদের দিন চ্যানেলগুলো যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে দৌড়তে থাকে সম্পূর্ণ উল্টো পথে।
আজ পর্যন্ত কোনো একটি চ্যানেলেও আমি দেখতে পাইনি দরিদ্র, প্রান্তিক, গ্রামবাসী মানুষের প্রতিনিধিত্ব। কিন্তু বৈষম্য ভাবনা এতো ব্যাপক যে, যদি কোনো চ্যানেলে বঞ্চিত করে রাখা সমাজের মানুষদেরকে নিয়ে একটি রিয়েলিটি শো আয়োজন করা হয় তবে আমরা হত-গরীবরাও বিরক্ত হবো। হয়তো ক্ষেপে গিয়ে মন্তব্য করে বসবো, কই সিনেমা-নাটকের স্টারগো দেখমু, তাগো কতা হুনমু! না, ধইরা লইয়া আইসে কতকগুলা হাভাইত্যারে। কিন্তু প্রচলিত মূল্যবোধে সমস্যা থাকলে তা ক্রমান্বয়ে দূরীভবনের দায়িত্বও মেডিয়াগুলোর রয়েছে।
আমাদের বৈষম্যবাদী মূল্যবোধ এতো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, এক হত দরিদ্র তার মতোই অন্য আরেক জনকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে, ঠিক যেভাবে এদের উভয়কেই অভিজাত সমাজের সদস্যরা দেখে থাকে। এবং এরা দুজনেই অভিজাতকে দেবতুল্য মনে করে তাকে তথোচিত ভক্তি-সম্মান করে থাকে। কিন্তু সব ধর্মের নৈতিকতা মূলত অন্যের সাথে সমতা-মমতার সম্পর্কে সংযুক্ত হবার নীতিটির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ভিত্তিতেই মানুষের সাফল্যের বিচার। এর বিপরীত হচ্ছে সমাজের অভিজাত শ্রেণির সংস্কৃতিগত মানদণ্ড, আনন্দ-বিনোদনের রীতিনীতি, সম্পদ-ক্ষমতার পরিমাণ ইত্যাদির ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব ও সফলতার বিচার। জ্ঞান জগতের এলিটরা ও বিনোদন জগতের সেলিব্রিটিরা তাই এখানে একধরণের দেবদেবীতূল্য আইকন।
একবার আমাকে আমার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন, সলিমুদ্দীন-কলিমুদ্দীন সব বেহেশতে চলে যাবে, আর জাহান্নামে গিয়ে মরবে সব আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ? এ কেমন বিচার? সলিমুদ্দীনরা সব বেহেশতে যাবে কিনা, আর রবীন্দ্রনাথরা সব জাহান্নামে যাবে কিনা সে আমার জানা নেই, তা নিয়ে আমার আগ্রহও নেই। কিন্তু বন্ধুর প্রশ্নটির নিচে যে মূল্যবোধ ক্রিয়াশীল রয়েছে, যে প্রাক-ধারণা বিদ্যমান রয়েছে, সেটা নিয়েই আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল। তাহলে তোমার ধারণা যে যত বড় কবিতা লিখতে পারে, যে যত বড় বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কার করতে পারে, আল্লাহর কাছে সে তত বড় মানুষ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত? রুমি, ফারাবি, ইবনুল হাইসাম’রা আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তি হওয়া উচিত শুধু এজন্য যে তারা কবি, দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক? বলা বাহুল্য, আমরা কেউই কারও প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি।
টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতি আবেদন করা যেতে পারে, আগামী ঈদ থেকে শুধু এলিট-সেলিব্রিটিদের নিয়ে অনুষ্ঠান না করে, সমাজের বঞ্চিত বর্গগুলোকে নিয়ে, সর্বস্তরের মানুষকে নিয়েও অনুষ্ঠান করুন। তাদের জন্যও ভাল পরিমাণে সময় বরাদ্দ করুন। ধর্ম নির্বিশেষে সব আর্থ-সামাজিক শ্রেণির যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব থাকুক ঈদের অনুষ্ঠানমালায়। এমনকি একই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্রস-কম্বিনেশন করা হলে আরও ভাল হবে। সব শ্রেণির মানুষের ভাবনা, চিন্তা, অবস্থা, ঈদের দিন তারা কিভাবে উদযাপন করে ইত্যাদি আমরা জানতে পারবো। অন্তত ঈদের অনুষ্ঠানমালা হয়ে উঠুক সার্বজনীন।
সুকান্ত কুমার সাহা বলেছেনঃ
একটা সময় হিন্দুধর্মে ব্রাহ্মান্যবাদ এমন অত্যাচারিত হয়ে উঠেছিল যে, ব্রাহ্মানরা নিজেদের এক একজন ভগবান ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, ধর্মের নামে এরা সদ্য বিধবাদের চিতার আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে শুরু করেছিল। এই কাজ করতে তাদের একটুও হাত কাঁপেনি! এর আগে শত শত বছর ধরে হিন্দু রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে লোকক্ষয়ের ইতিহাস তো আছেই। তারপর একটা পর্যায়ে হয়রাণ হয়ে তবেই এরা ক্ষান্ত দিলেন। বুঝলেন এসব করে লাভ নাই। পাপ-পুন্য বিচার করবেন একমাত্র ভগবান। এদের পথ দেখালেন রাজা রামমোহন রায় সহ দেবেন ঠাকুরদের মত একদল যুবক। তারা ধর্মীয় নেতাদের সাথে জিদ করে নিজ ধর্মে রিভোল্ট করলেন। নিজেরা ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ নামে নতুন একটা ধর্মের উৎপত্তি ঘটালেন আর তাতে সেই সময়ের শিক্ষিত ছেলেরা দলে দলে যোগ দিতে লাগলো। আর ছেলেদের স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরের চাপে বাবা-মাদের গোঁড়ামি কাটতে লাগলো যার ফলশ্রুতিতে পুড়ো হিন্দু সমাজ রক্ষা পেল! (কিছু ভুল থাকলেও ইতিহাসটা বোধ হয় এমনই?)
আপনার কথায় ভয় পেলাম, যদি আইনস্টাইন, রবি ঠাকুরা স্বর্গে না যায় তাহলে তো বড়ই মুশকিল? ঈশ্বর কি তবে তাদের এই মর্তে কারুকাজ দেখানোর জন্যই বানিয়েছিল? তাহলে তাদের মাথায় যে বুদ্ধি দেওয়া হয়েছিল সেটা কি তবে ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল? আর তাই যদি হয়, তাহলে তারা নরকে থাকবেন কেন? তাদের ভালবেসেছিলেন বলেই না তাদের তিনি তার নিজের কিছু ক্ষমতা দিয়েছিলেন?
আমি বিশ্বাস করি, একমাত্র ঈশ্বরই ভালমন্দের বিচার করবেন! তিনি বিচারের ভার কাউকে দেননি। আমাদের কাজ হলো, তার নির্দেশনুয়ায়ী সম্ভব সৎকর্ম করে যাওয়া। তারপর বাকিটা তিনি দেখবেন।
ঈদের শুভেচ্ছা সবাইকে! ভাল থাকবেন আর প্লেটখানেক লাচ্চা-সেমাই এদিকে পাঠাবেন! জুজু ভাই আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে, তাই সাবধানে পাঠাবেন! কুরিয়ার যেন আবার ঠাকুর ঘরে চলে না যায়? 😛
মোনেম অপু বলেছেনঃ
সুকান্ত, সর্বনাশ! আমার কথায় আপনি কেন ভয় পেলেন তাই তো বুঝলাম না। আমি তো কাউকে কোথাও পাঠাইনি। এই যে আপনি বললেন, পাপ-পূণ্যের বিচার করবেন ভগবান। আমার কথা তো তার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু আপনিই তো আবার বিষয়টা ভগবানের হাতে না ছেড়ে মুশকিলটা নিজের ঘাড়ে নিয়েছেন, নিজেই একটা মীমাংসা করতে চাচ্ছেন। আমি বলতে চেয়েছি যে, আপনার বিচারে আমি একজন চমৎকার ব্লগার/লেখক হিসেবে স্বীকৃত হলেই কি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে ভগবানের বিচারেও আমি উত্তীর্ণ হয়ে যাব? নিশ্চয়ই না। ভগবানের বিচারের ক্রাইটেরিয়া তো ব্লগার ইত্যাদি হওয়াতে সাফল্য না। আশা করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।
নিতাই বাবু বলেছেনঃ
সম্মানিত মহাগুরুমহাশয়, পবিত্র ইদের শুভেচ্ছা জানবেন ৷ আর গরিবদের নিয়ে চিন্তাভাবনা আপার লেখায় প্রকাশ পায়, এই লেখা লেখাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল মহাগুরু ৷ কারণ: এই ভবসংসারে গরিবদের বেশিরভাগ পয়সাওয়ালা মানুষরাই তুচ্ছ ও ঘৃণা করে ৷ কাজেই ওইসব টিভি চ্যানেলগুলিও বড়লোক শ্রেণিতেই আছ, তাই তাঁরা বড়লোদের নিয়েই থাকে ৷ গরিবরা কী মানুষ? যে তাদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করবে ! ধন্যবাদ মহাগুরু ভালো থাকবেন আশা করি ৷
নিতাই বাবু বলেছেনঃ
ভুল বশতঃ হয়েছে “আছ” হবে আছে ৷শোধরে নিবেন, গুরু ৷
মোনেম অপু বলেছেনঃ
ধন্যবাদ, নিতাই ভাই।
আইরিন সুলতানা বলেছেনঃ
৮-৯ দিন ব্যাপী ঈদ আয়োজন … কিন্তু দিনশেষে কিছু খুঁজে পাইনা দেখার মত। ছোটকাকু দেখার প্লান ছিল, কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আগ্রহ কমে গেল … কিছুক্ষণ পর পর এতো এতো বিজ্ঞাপন!!!!
ঈঈঈদ মোবারক সবাইকে!
মোনেম অপু বলেছেনঃ
আপা,
আমরা তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া শিখলেও শেষ জীবনে ডায়াবেটিসের পাল্লায় পড়ে ভাত দিয়ে তরকারি খেতে শুরু করি। এটাও এরকম কিছু হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন–তাও সয়ে নেয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান!–সে কি আর সহ্য হয়, বলেন? বিজ্ঞাপন সমস্যাটা ইদানিং আরও বেড়েছে। ইফতারের আগে মাগরিবের আযানের আগে এতো বিজ্ঞাপন! এই সময়টায় কই একটু ঈশ্বর-বন্দনা জাতীয় কিছু শুনবো, প্রশান্ত মনে অপেক্ষা করবো। না, এক কাড়ি লারেলাপ্পা বিজ্ঞাপন!
সবার পক্ষ থেকে আপনাকেও ঈদ মোবারক।
সুকান্ত কুমার সাহা বলেছেনঃ
আমার হাতে রিমোর্ট থাকলে আমার মেয়ে বলে, বাবা তুমি ভাল না, খালি রিমোর্ট টেপো, কিছুই দেখো না!
— বলি, আমিই তো ভাল দর্শক রে মা- অল্প সময়ে সব চ্যানেলই দেখি!
মঞ্জুর মোর্শেদ বলেছেনঃ
ঈদের অনুষ্ঠানমালা নিয়ে একবার আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ বলেছিলেন , যে চ্যানেলই ঘুরাই সবটাতেই একই প্রোগ্রাম । একই রকমের নাটক , সাক্ষাৎকার , একই রকমের প্রশ্ন , শুধু চেহারা টা বদলায় এই যা ।একটা চ্যানেল দেখলেই সব চ্যানেলের চেহারা বোঝা যাচ্ছে । তাহলে কেন এত প্রোগ্রাম ।
ছাত্র জীবনে কিছু আদর্শিক তর্ক সবসময়েই ছিল । চ্যানেল গুলো কেন বড়লোকদের নিয়ে এত প্রোগ্রাম করে , ওদের প্রেম , ফ্যাশন ,ঈদ উদযাপন ,খাবার রেসিপি । এক বন্ধু বলত , বড়লোকেরা ট্যাক্স পে করে , প্রোগ্রাম স্পনসর করে ওদের চাওয়া না দেখলে কি চলে । গরিবরা কয় পয়সা ট্যাক্স দেয় ।পাল্টা প্রশ্ন ছিল গরিব যদি পণ্য উৎপাদন না করত তাহলে মুনাফা ,ট্যাক্স বা কনজুমারিসম বলে কি কিছু থাকত । অটোমেশন , যন্ত্রের ব্যবহারে শ্রমের চরিত্র বদলেছে, শ্রমের বিভাজন হচ্ছে , শ্রমিকের কন্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হচ্ছে ।
ধর্ম দিয়ে যতটা মানুষ বিভাজিত , তার চেয়ে বেশি বিভাজিত বিত্ত দিয়ে ।
আর মৌলিক বিষয় গুলো নিয়ে প্রোগ্রাম করলে সেটা সার্বজনীন হতেই পারে । সৃষ্টিশীলতার অভাবে তাও কি খুব একটা হচ্ছে ।
মোনেম অপু বলেছেনঃ
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, মোর্শেদ ভাই।