ঈদ ও আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমালা

মোনেম অপু
Published : 7 July 2016, 09:40 AM
Updated : 7 July 2016, 09:40 AM

পুঁজিবাদী আধুনিকতাবাদ আমাদের জন্য বৈষম্য ভিত্তিক যে মূল্যবোধ তৈরি করেছে ও সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছে তার পরিপূর্ণ প্রতিফলন রয়েছে ঈদে টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমালায়। আর এই প্রতিফলনের গণ ভিত্তিও রয়েছে—আমরা আমজনতা তা-ই দেখতে চাই, 'খেতে' চাই। যদিও 'ইসলাম আমাদেরকে সাম্য, সহমর্মিতা শিক্ষা দেয়'—এরকম সব কথা সারা রোজার মাস জুড়ে চ্যানেলগুলোর নানা আলোচনা অনুষ্ঠানে বলা হয়ে থাকে, কিন্তু ঈদের দিন চ্যানেলগুলো যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে দৌড়তে থাকে সম্পূর্ণ উল্টো পথে।

আজ পর্যন্ত কোনো একটি চ্যানেলেও আমি দেখতে পাইনি দরিদ্র, প্রান্তিক, গ্রামবাসী মানুষের প্রতিনিধিত্ব। কিন্তু বৈষম্য ভাবনা এতো ব্যাপক যে, যদি কোনো চ্যানেলে বঞ্চিত করে রাখা সমাজের মানুষদেরকে নিয়ে একটি রিয়েলিটি শো আয়োজন করা হয় তবে আমরা হত-গরীবরাও বিরক্ত হবো। হয়তো ক্ষেপে গিয়ে মন্তব্য করে বসবো, কই সিনেমা-নাটকের স্টারগো দেখমু, তাগো কতা হুনমু! না, ধইরা লইয়া আইসে কতকগুলা হাভাইত্যারে। কিন্তু প্রচলিত মূল্যবোধে সমস্যা থাকলে তা ক্রমান্বয়ে দূরীভবনের দায়িত্বও মেডিয়াগুলোর রয়েছে।

আমাদের বৈষম্যবাদী মূল্যবোধ এতো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, এক হত দরিদ্র তার মতোই অন্য আরেক জনকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে, ঠিক যেভাবে এদের উভয়কেই অভিজাত সমাজের সদস্যরা দেখে থাকে। এবং এরা দুজনেই অভিজাতকে দেবতুল্য মনে করে তাকে তথোচিত ভক্তি-সম্মান করে থাকে। কিন্তু সব ধর্মের নৈতিকতা মূলত অন্যের সাথে সমতা-মমতার সম্পর্কে সংযুক্ত হবার নীতিটির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ভিত্তিতেই মানুষের সাফল্যের বিচার। এর বিপরীত হচ্ছে সমাজের অভিজাত শ্রেণির সংস্কৃতিগত মানদণ্ড, আনন্দ-বিনোদনের রীতিনীতি, সম্পদ-ক্ষমতার পরিমাণ ইত্যাদির ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব ও সফলতার বিচার। জ্ঞান জগতের এলিটরা ও বিনোদন জগতের সেলিব্রিটিরা তাই এখানে একধরণের দেবদেবীতূল্য আইকন।

একবার আমাকে আমার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন, সলিমুদ্দীন-কলিমুদ্দীন সব বেহেশতে চলে যাবে, আর জাহান্নামে গিয়ে মরবে সব আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ? এ কেমন বিচার? সলিমুদ্দীনরা সব বেহেশতে যাবে কিনা, আর রবীন্দ্রনাথরা সব জাহান্নামে যাবে কিনা সে আমার জানা নেই, তা নিয়ে আমার আগ্রহও নেই। কিন্তু বন্ধুর প্রশ্নটির নিচে যে মূল্যবোধ ক্রিয়াশীল রয়েছে, যে প্রাক-ধারণা বিদ্যমান রয়েছে, সেটা নিয়েই আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল। তাহলে তোমার ধারণা যে যত বড় কবিতা লিখতে পারে, যে যত বড় বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কার করতে পারে, আল্লাহর কাছে সে তত বড় মানুষ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত? রুমি, ফারাবি, ইবনুল হাইসাম'রা আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তি হওয়া উচিত শুধু এজন্য যে তারা কবি, দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক? বলা বাহুল্য, আমরা কেউই কারও প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি।

টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতি আবেদন করা যেতে পারে, আগামী ঈদ থেকে শুধু এলিট-সেলিব্রিটিদের নিয়ে অনুষ্ঠান না করে, সমাজের বঞ্চিত বর্গগুলোকে নিয়ে, সর্বস্তরের মানুষকে নিয়েও অনুষ্ঠান করুন। তাদের জন্যও ভাল পরিমাণে সময় বরাদ্দ করুন। ধর্ম নির্বিশেষে সব আর্থ-সামাজিক শ্রেণির যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব থাকুক ঈদের অনুষ্ঠানমালায়। এমনকি একই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্রস-কম্বিনেশন করা হলে আরও ভাল হবে। সব শ্রেণির মানুষের ভাবনা, চিন্তা, অবস্থা, ঈদের দিন তারা কিভাবে উদযাপন করে ইত্যাদি আমরা জানতে পারবো। অন্তত ঈদের অনুষ্ঠানমালা হয়ে উঠুক সার্বজনীন।