অমর্ত্য সেনের বই ‘পরিচিতি ও হিংসা’

মোনেম অপু
Published : 1 August 2016, 01:07 AM
Updated : 1 August 2016, 01:07 AM


 

বইয়ের বাংলা নাম: পরিচিতি ও হিংসা।
লেখক: অমর্ত্য সেন।
অনুবাদক: ভাস্বতী চক্রবর্তী।
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
মূল বই: Identity and Violence: The Illusion of Destiny.

 
 

বইটিতে লেখক অমর্ত্য সেন ব্যক্তির বর্গীয় পরিচিতি, এরূপ পরিচিতির ইতিবাচক দিক, একই সাথে তা থেকে জাত বিভেদ ও হিংসা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং কিভাবে এই হিংসা থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ করে তোলা যায় তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের কালে অনন্য, নির্বিকল্প, ঐকান্তিক, একমাত্রিক বর্গীয় পরিচিতির উপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং এভাবে ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে মানবজাতিকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট, স্থায়ী ও তীক্ষ্নসীমা ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এরূপ বিভাজনকে ধরা হয়েছে সভ্যতার স্বাভাবিক বিভাজন হিসেবে এবং সভ্যতার সংঘাতকে ধরা হয়েছে ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়ামক হিসেবে।

বৈশ্বিক রাজনীতিকেও সাজানো হয়েছে এই স্থায়ী বিভাজনের উপর ভিত্তি করে। ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় এরূপে বিভক্ত গোষ্ঠীর সদস্যভুক্তির মধ্যে নিহিত করা হয়েছে। বিশ্বকে এভাবে কয়েকটি প্রধান বলয়ে স্থায়ী ভাগে ভাগ করে ফেলা সম্ভব, যেমন: পশ্চিমা বিশ্ব, মুসলিম বিশ্ব, কালো বিশ্ব, হিন্দু বিশ্ব, বৌদ্ধ বিশ্ব ইত্যাদি। এ বলয়গুলোর ভেতরেও আবার ক্ষুদ্র জাতি ও গোত্র সত্তাও তৈরি হয়, যা ব্যক্তিদের প্রধান পরিচয় হয়ে উঠতে পারে। তবে অনন্য ও প্রধান পরিচিতির ভিত্তি ক্ষুদ্র বা বৃহত্তর যে বর্গই হোক না কেন, আন্তঃবর্গ প্রতিযোগিতা, সংঘাত ও হিংসাই যেন এই পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠিত ও সমুন্নত করার একটা উপায় হয়ে গিয়েছে।

নিজস্ব পরিচিতি বোধের একদিকে উপকারিতা রয়েছে এবং অন্যদিকে তা হিংসার মতো গুরুতর সমস্যার উৎস হিসেবেও কাজ করে। ভাল দিক হচ্ছে এই যে, এই পরিচিতি আমাদের আনন্দ, মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের উৎস। নির্দিষ্ট অনন্য আত্মপরিচয়ের ধারণাটি সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে থাকার তাই কারণ রয়েছে। এটা প্রতিবেশী-প্রীতির জনপ্রিয় ধারণার মধ্যে যেমন বিদ্যমান, তেমনই সামাজিক পুঁজি ও জাতীয়তাবাদী আত্মনিরূপণের উঁচু মার্গের তত্ত্বের মধ্যেও বিদ্যমান। এভাবে গড়ে উঠা সমপরিচিত আমাদের এককে অন্যের কাছে আনে, সামাজিক সংহতি সৃষ্টি করে, সামাজিক সম্পর্কে দৃঢ়তা, সজীবতা ও উষ্ণতা আনে, পারস্পরিক বন্ধনকে মজবুত করে। এটা ব্যক্তিকে দেয় একটি সমাজ ও সমাজ ব্যক্তিদের জীবনমানকে উন্নত করে।

অন্যদিকে, ঐকান্তিক পরিচয়বোধ থেকে ভয়াবহ হিংসার উৎপত্তি হয়, লক্ষ লক্ষ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। কোনো গোষ্ঠীতে দৃঢ়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হবার চেতনা ও তার সাথে জড়িত অনন্যতার বোধ অনেককে সৌহার্দ্যে কাছে টানলেও অন্য গোষ্ঠীগুলোর সাথে দূরত্ব ও বৈরিতা বাড়ায়। গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ সংহতি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধে ইন্ধন যোগায়; অহমিকা, আত্মপ্রসাদ, নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা, অকল্যাণকামিতা, জিঘাংসা তৈরি করে। মুসলিম-হিন্দু বা হুটু-টুটসি বিরোধ থেকে খুনাখুনি, অত্যাচার-নির্যাতনের নজির তো কম নয়। নরহত্যার সর্দারদের ইন্ধনে সরলমতি মানুষেরাও 'নিজেদের লোকের' পক্ষ নিয়ে শত-সহস্র 'অন্য লোকদের' বাড়ি-ঘর থেকে বিতাড়িত করেছে, সম্পদে আগুন দিয়েছে। সন্ত্রাসের দক্ষ কুশীলবরা কোমলমতি মানুষদের উপর একমাত্রিক পরিচয় চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে জঘন্য হত্যাকাণ্ডে।

কাজেই সুনির্দিষ্ট একমাত্রিক পরিচয়বোধের পক্ষে যেমন জ্ঞানীজনদের জোরালো সমর্থন রয়েছে, এর যেমন সুফল রয়েছে, তেমনই এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বিপদ, সন্ত্রাস। তাহলে এখন সমাধান কোথায়? সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে মানবজাতির ঐক্যের উপর জোর দেয়া। কিন্তু অমর্ত্য সেন মানবজাতির ঐক্যের ধারণার উপরই কেবল জোর দেয়াকে খুব সুফল প্রদায়ী কিছু বলে মনে করেন না। আলোচ্য বইটিতে তার মূল বা কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য বিষয়টি হচ্ছে এই যে, একটি সংঘাতপ্রবণ পরিচয়ের শক্তিকে বহু প্রতিদ্বন্দ্বী পরিচয়ের ক্ষমতা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব। মানবজাতি এক জাতি—এই মানবিক পরিচিতিকে ব্যক্তির বহু পরিচয়ের একটি মাত্র হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

লেখক বইয়ের সূচনাতেই যে বড় বাস্তবতাকে বিশদভাবে তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই একই সাথে ছোট-বড় বহু ও বিচিত্র গোষ্ঠীর সদস্য। একজন যেমন মুসলিম, তেমনই আবার সুন্নি, এবং হানাফিও হতে পারেন। সেই তিনিই আবার বাঙালি ও বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারেন। সে সাথে তিনি এশিয়ও বটে। শুধু তা-ই নয়, তিনি হয়তো কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন এবং সব খেলার মধ্যে ফুটবলকে বেশী পছন্দ করেন। গোষ্ঠীভুক্তির এরূপ বৈচিত্র্য নানারকম ক্রস-কম্বিনেশন ঘটায়। মুসলিম হিসেবে একজন অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে আলাদা। কিন্তু বাংলাদেশী হিসেবে তিনি আবার দেশের অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে এবং মধ্যবিত্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি দেশের সকল অর্থনৈতিক শ্রেণির সাথেও এক গোষ্ঠীভুক্ত। একজন টুটসি একই সাথে টুটসি, কালো, খ্রিস্টান, আফ্রিকিয়, নারী ইত্যাদি সবই হতে পারেন এবং একজন মানুষও বটে।

কোনো ব্যক্তি তার বিচিত্র সব পরিচিতির মধ্য থেকে একটি মাত্রকে বড় করে তুলে সেটার ভিত্তিতে গভীর ও স্থায়ী বিভেদ রেখা আঁকলে তাকে একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন করা যায়: তুমি অন্যসব পরিচিতিকে হিংসার ভিত্তি হিসেবে না নিয়ে একটিকে নির্বাচন করে কেন সেটাকে একাজে ব্যবহার করছো? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর থাকার কথা নয় এবং একক পরিচিতিকে বড় করার প্রবণতাকে লেখক তাই একটি বিভ্রম বলেই আখ্যায়িত করেছেন। এ দশা থেকে মুক্তির জন্য তিনি তিনটে সুপারিশ করেছেন: ১. পরিচিতির বহুমাত্রিকতা ও তার নানাবিধ দ্যোতনা উপলব্ধি করা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন, ২. পরিচিতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্বাচন বা চয়নের ভূমিকা অনুধাবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ৩. আমাদের বহুমাত্রিক পরিচয়গুলোর মাত্রা, যুক্তিযুক্ততা ও প্রাসঙ্গিকতা বিচার করা একান্ত জরুরী। লেখক মনে করেন, এভাবেই আমার আমাদের নানা পরিচিতিকে সামনে এনে সেগুলো থেকে উপকৃত হবার পাশাপাশি সব ধরণের উগ্রতায় নিপতিত হওয়া থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারবো। অমর্ত্য সেন তার এ বইতে তাই পরিচিতির বহুমাত্রিকতা, চয়নের ভূমিকা এবং প্রাসঙ্গিকতার যুক্তিশীল বিচারের বিশদ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।

ব্যাপারটা সহজবোধ্য হলেও বিভ্রম দূরীকরণে যে বাধাটা রয়েছে বলে লেখক মনে করেন তা আসে প্রধানত কট্টর কৌমবাদী বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে। আমার ধারণা, একক ধর্ম ভিত্তিক উম্মাহবাদীরাও এদের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা চলে। কৌমবাদীরা জোর দিয়ে বলে থাকেন যে, কৌম ভিত্তিক পরিচিতি বিষয়গতভাবেই প্রধান পরিচয়ের উৎস, যেখানে নির্বাচন বা চয়নের কোনো ভূমিকা নেই; এটা পূর্বতভাবেই বিদ্যমান, যা নিছক আবিষ্কারের বিষয়। এ যেন নিউটনের সূত্রের মতো—প্রকৃতিতে আগে থেকেই আছে, যা আমরা পরে আবিষ্কার করি মাত্র এবং নিছক বেছে নেয়ার সুযোগ যেখানে আমাদের হাতে নেই। অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিকেরা মানবজাতিকে পিতৃপুরুষদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতির ভিত্তিতে ভাগ করে কতকগুলো ছোট ছোট খোপে পুড়ে দেন। এবং এসব তাত্ত্বিকেরা ধর্ম, জাতীয়তা, ঐতিহ্য ও রীতিনীতির মধ্যে একটি মহিমা আরোপ করে একটা একপেশে অযৌক্তিক আবেগ তৈরি করেন।

কিন্তু নিতান্তই সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও পরিণামে খুবই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে এই তাত্ত্বিক সমর্থন। শক্তিশালী বয়ানের জোরে এ বিভাজন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে গণমানসে। ফলে বিভাজনের এ স্থায়ী অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা শক্ত। যারাই এরূপ বিভাজনের বিরোধিতা করবেন তারা সহজেই জাতিদ্রোহী বা ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত হবেন। ফলে একজন নিজেকে কিভাবে দেখতে চান তা তার কাছে পরিষ্কার বা স্পষ্ট হলেও, অন্যদেরকে সেটা গ্রহণ করানোর বেলায় সমস্যায় পড়তে হয় বলেই লেখক মনে করেন। নিজস্ব পরিচিতি নির্ধারণের স্বাধীনতা তাই শক্তিমান অন্যদের বিচার দ্বারা বাস্তবে অতিমাত্রায় সংকুচিত হয়ে পড়ে।

[এই লেখাটির অনেক ক্ষেত্রে বইটির (বাংলা অনুবাদের) বাক্য, বাক্যাংশ হুবহু গ্রহণ করা হয়েছে।]