এক সমর্থকের আত্মকথা

মোনেম অপু
Published : 23 Oct 2016, 08:44 PM
Updated : 23 Oct 2016, 08:44 PM

চলিতেছে ব্রাজিল—আর্জেন্টিনা। আমি দেখিতেছি। কাহারও তেলেসমাতি কাহারও অপেক্ষা কম নহে। ঠগের দুনিয়ায় জন্মিয়া কপাল পুড়িয়াছে সদৃশ কত কথা! কপালের দাহ দেখিয়া দেখিয়া আর দহনের কথা শুনিয়া শুনিয়া চক্ষু-কর্ণ এতটাই ঝাপসা-ভোতা হইয়া গিয়াছে যে, আজকাল পাশ দিয়া বিকট শব্দে রেলগাড়ি যাইতেছে কি সকলে মিলিয়া নীরবে পড়িয়া ধ্যানে বসিয়াছে—কিছুই ফারাক করিতে পারি না। আর কোথায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সুতা-প্রস্থ সূক্ষ্ম ফারাক! উভয়েই যখন দেখাইতে সমান উস্তাদ, তখন দুইয়ের তেলেসমাতির সমস্তটাই নয়ন জুড়াইয়া, মন ভরাইয়া বসিয়া বসিয়া দেখিলেই হয়। ফারাক না করিলে কি চলে না? কিন্তু না, তাহাতে চলিবে কেন? ডিম্ব ঠেকায় পড়িয়া ভাঙ্গিতে হইলেও হজম করিবার বেলায় আমার ষোলআনা চাই—একআনা তো অনেক কথা, এক কানা কড়িও নাহি ছাড়ি যুদ্ধ বিনা। আর যেইখানে ঠেকা নাই, সেইখানে ঠেকা বানাইয়া, আটআনা স্বেচ্ছায় দূরে ঠেলিয়া দুইয়ের মাঝখানে একখানা খাল না কাটিলে আমার চলিবে কেন? আমি যে মনুষ্য—খাল না পাইলে মানুষ মানুষ হইয়া সাঁতরাইবে কী করিয়া?

অতএব আমি সমর্থক হইলাম। কোনো পণ্ডিত আসিয়া হুঁশিয়ারি দিয়া কহিলেন না: সমর্থক হউন, নইলে আপনি মূর্খ। ফেরেশতা আসিয়া দিব্যি দিয়া কহিল না: সমর্থক হও, নইলে তোমার জাহান্নাম। কোনো আগুনে-নয়ন খুনি আসিয়া নাঙ্গা ছুড়ি গলায় ধরিয়া চোখ রাঙ্গাইয়া শাসাইল না: সমর্থক হ, নইলে তোর জান গেল। তবুও আমি সমর্থক হইলাম। ব্রাজিল ডাকিয়া কহিল না, সমর্থন কর, রাজ্যার্ধ দিব। আর্জেন্টিনা ডাকিয়া কহিল না, সমর্থন কর, রাজকন্যা দিব। তবুও আমি সমর্থক হইলাম। যদিও আমি কুত্রাপি কদাচ কড়ি না দেখিলে নড়ি না—অন্য কথাটি না হয় না-ই বা বলিলাম—তবুও আমি কামিনী-কাঞ্চনের মোহে না-পড়া পরমোৎকৃষ্ট নিষ্কাম সাধুর ন্যায় সমর্থক হইলাম। হইয়া অর্ধেক ছাড়িলাম, অর্ধেক ধরিয়া তাহার প্রজা হইলাম, প্রজা-কর্মে আত্মনিয়োগ করিলাম। তাহারা জিতিল, জিতিয়া সোনার হার গলায় পরিল, সোনার ট্রফি আকাশে তুলিয়া সকলকে দেখাইল। দেখিয়া চিত্ত আমার আত্মহারা হইল। হারাইয়া আমি তৃপ্ত হইলাম, প্রতিপক্ষের চক্ষে শূল বিঁধাইয়া ফুটানি করিলাম, বাপেরটা খাইয়া পড়শিদের সড়কে দিন কতক নাচিয়া বেড়াইলাম।

মনে পড়িয়া গেল—ক্ষমা করিবেন—তাই বৃত্তান্ত করিতেছি। আমার দাদার বয়সী এক বৃদ্ধ সুজন কোন জেলায় যেন বহুকাল পূর্বে তাহার পেয়ারের দল হারিয়া যাওয়ায় চক্ষু সমক্ষে পুলসিরাতের দোল দেখিয়া আতংকে হৃৎপিণ্ড সামাল দিতে না পারিয়া মরিয়া গিয়াছিলেন। অপিচ স্মরণে আছে, সেই দল ক্ষুরাপেক্ষা ক্ষুরধার, কেশাপেক্ষা ক্ষীণতর পুলসিরাত পার হইয়া সোনার মালা শেষতক পরিতে পরিয়াছিল। এই যদি হইবে আখেরি কাণ্ড, তবে মরিলাম কোন দুঃখে?—নিদারুণ কষ্ট ও বিস্ময় লইয়া ভাবিয়াছিলাম, তিনি কি কবরে বসিয়া মর্মভেদী এই প্রশ্ন লইয়া ব্যাটে-বলে খেলা করিতেছেন? নাকি আহ্লাদে ভাবিতেছেন, আমি শহিদ হইলাম? তুলাদণ্ডে মাপিয়া দেখিবার আবশ্যকতা নাই; আমি অকপটে স্বীকার করিতেছি, হাঙ্গামা বাধাইতে আমার মনের ভীমগতির তুলনায় তিনি নগণ্য নস্যি। বলিতে দ্বিধা নাই, হৃৎপিণ্ডের তাল না হারাইয়া গাজি হইয়া আমি আজও যে বাঁচিয়া আছি তাহা কেবল যৌবনের জোরে।

শুনিয়াছি যুক্তির দাঁড়িপাল্লায় মাপিয়া বচনের ওজন করিয়া চাল-তুষের ফারাক খুঁজিতে ব্যস্ত পণ্ডিতবর্গের তাবৎ হাঙ্গামার সূচনাই নাকি হইয়াছে এতাদৃশ সূত্র দিয়া যে, রহিম আর রহিম এক, রাম আর রাম অভিন্ন। রাম-রহিমের মত আমজনতা যেকথা কখনও কল্পনা করিয়া বানাইতে পারে নাই, কিন্তু শুনিবামাত্র ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া থাকিয়া হক কথা বলিয়া মানিয়া লইতে বিলম্ব করে না, তাহারা এই কালামে পাণ্ডিত্য কোথায় তাহা ভাবিয়াও বিলক্ষণ অবাক হয়। কিন্তু ব্রাজিল ও রাম কী করিয়া এক হইল আর আর্জেন্টিনা ও রহিম কী করিয়াই বা অভিন্ন হইয়া গেল তাহার ব্যাখ্যা এই পণ্ডিতেরা দিতে পারিবেন কি না জানি না, তবে আমার তাবৎ একিন-তামান্না-সার্থকতা 'সমর্থক'য়ের লাঙ্গুলে আটকাইয়া থাকা 'অর্থ'য়ের খোলসরূপে আসমান ভাঙ্গিয়া, জমিন কাঁপাইয়া নাচিয়া বেড়াইতেছে—ঘোল খাইলেও দুঃখ নাই, গোল খাইলে সর্বস্ব সর্বনাশ।

আদম যে আদম ফেরেশতাদিগের সেজদা পাইয়াছিলেন—তাহা তো তিনি লভিয়াছিলেন নাম-জ্ঞানের অধিকারেই। তর্ক করিব না, তুমি নিজেই তো ইহা জান: নিজ হইতে নামের কোনো অর্থ নাই, অর্থারোপেই অর্থ। তুমি বিজ্ঞজন। অতএব, বুঝিতেই পারিতেছ, মূর্খলোকে এতকাল ধরিয়া কী ভ্রমের বশেই না বলিয়া আসিতেছে, অর্থই অনর্থের মূল। অশ্বের অগ্রে শকট জুড়িয়া দেওয়া মানবের বহুকালের সনাতন খাসলত। আসলে কথা হইতেছে, অনর্থই অর্থের মূল। কাজেই অনর্থকের মূলে জল ঢালিয়া সার্থকতার পুষ্পসকল ফুটাইতে না পারিলে, এতদুদ্দেশ্যে একখানা বেজায় হাঙ্গামা বাধাইতে না পারিলে আমি কিসের আদম-সন্তান? কিসের মানুষ? আমি অবল, জাতির মর্যাদা রক্ষা করিতে পারি কিংবা নাই বা পারি, নির্বোধ তো নই যে, তাহার অমর্যাদা করিয়া পুতুলের ন্যায় নীরবে বসিয়া বসিয়া কেবল চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে থাকিব।

কৈফিয়ত

কত কাল ধরিয়া কত যে মুখস্থ করিয়াছি একটি বটগাছের আত্মকথা, একটি নদীর আত্মকথা ইত্যাদি ইত্যাদি! পরের কথা মুখস্থ করিয়া করিয়া কালাতিপাত করিতেছিলাম বলিয়া নিজের কথা ভাবিয়া দেখিবার ফুসরত পাই নাই। মুখস্থকরণকাল সমাপ্ত করিয়া আমড়া গাছের ঢেঁকি হইয়া নিষ্কর্মাটি কেবলই ক্যাঁচক্যাঁচ করিয়া চলিতেছে অনেক দিন হইল। ভাবিলাম, বহির্দেশে ছুটিয়া চলা ক্লান্ত-প্রতারিত চক্ষু দুইটিকে এইবার একটু বিশ্রাম দেই, মনশ্চক্ষুপৃষ্ঠে চড়িয়া নিজের কথা কিছু খুঁজিয়া বাহির করি। কিন্তু বনের বিশাল বটবৃক্ষটি হুড়মুড় করিয়া মহাতরঙ্গে বাতাস কাঁপাইয়া ভাঙিয়া পড়িলেও শ্রোতার অভাব ঘটিলে যেমন শব্দ তৈরি হয় না, তেমনই বর্ণসকল কথা হইয়া উঠে না পাঠক না থাকিলে। অধিকন্তু বিপন্ন প্রত্যাশার বিষয় এই যে, নিষিদ্ধ কথার দুষ্ট বর্ণ বিন্যাসের দারিদ্র্য ও শাস্তি ঘুচিতে পারে গুণবান পাঠকের করুণায় ও ক্ষমায়। এতদবিবেচনায় অর্বাচীনের আত্মকথাটি গুণীজনদের ব্লগে উঠাইতে সাহস হইল।

***


আমাদের দাদা-দাদীরা এভাবে কাঁদতেন বাড়িঘর পুড়ে ছাই হলে, ডাকাতে সব নিয়ে গেলে। আমারা এভাবে কাঁদি একটা বল লাথি খেয়ে জালে ঢুকে গেলে।

***

***