'মার্কেট' ভদ্র শব্দ—শুনতে বেশ লাগে। 'বাজার' হলো গে ইতর—শুনলে গা'টা কেমন যেন নিশপিশ করে। 'মার্কেট' পেলে কার না মন গরবে ভরে উঠে! তাই বলে কেউ 'বাজারে' বলবে? উঁহু, এতো সহ্য হবার নয়। একইভাবে 'ড্রেইন' দিয়ে যেন বয়ে যায় মধুর রস। আর 'নর্দমা' দিয়ে? মাগো! গা তো রি-রি করে। ব্রেইনও কোনো মন্দ জিনিস নয়। আমার ছেলেটা যা ব্রেইনি—বলে সগর্বে মরার সুযোগ কোন বাপ হাতছাড়া করে? কিন্তু ব্রেইন ড্রেইন? নাহ! লোকে এটাকে ভাল চোখে দেখে না।
আয়ন র্যান্ড জীবদ্দশায় মার্কেট পাননি। মৃত্যুর পর পেয়েছেন হয়তো। জারের রাশিয়ায় ১৯০৫ সালে জন্মানো, কমরেডদের সোভিয়েতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা, ১৯২৬ সালে আত্মীয়দের সাথে দেখা করার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়া, আমেরিকান লেখিকা আয়ন র্যান্ড ড্রেইনড ব্রেইন তো বটেই। তবে তার অনপেক্ষ ব্যক্তিবাদীতা, পরার্থবাদ-বিরোধিতা এবং ঘোরতম পুঁজিবাদ-সমর্থন ভিত্তিক রাজনৈতিক মতবাদের সমালোচনা করেছেন অনেকই। তা সত্ত্বেও বলতে হয়, ব্যক্তি-স্বাধীনতা সম্পর্কিত তার অনেক কথাই আজকের বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
সেকালটি ছিল সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের কাল। এমনকি ইন্ডিভিজুয়ালিজমের লালনভূমি মার্কিন এবং মুক্ত ইউরোপীয় মনীষায়ও কালেক্টিভিজমের সংক্রমণ লক্ষ করে তিনি যারপরনাই শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। এ শঙ্কার বিপরীতে তিনি তার পরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আর অবাধ পুঁজিবাদের দর্শন রচনা করে গিয়েছেন। দার্শনিক হিসেবে মোটের উপর তিনি সবল না নিতান্তই দুর্বল—সে প্রশ্ন নাইবা তুললাম। তবে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তার ডায়স্টোপিয়ান ফিকশন 'এ্যানথেম' ভবিষ্যৎকালের আগাম ইতিহাস হিসেবে এখন নজর কাড়ছে অনেকেরই।
বইটি একটি কাল্পনিক ভাবী বৈশ্বিক রাষ্ট্রের পটভূমিতে রচিত। নাগরিকদের চিন্তা-মন থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ পরিপূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সব চিহ্ন স্থান-ভাষা থেকে মুছে ফলা হয়েছে। সকলে মিলে তখন একটি অবিভাজ্য একক, যেখানে সবাই এই এককের সেবক মাত্র। এ রাজ্যে কারও কোনো নাম নেই, স্বাধীনতা নেই, মূল্য নেই। এ হচ্ছে 'আমি'র 'আমরা' হয়ে যাওয়ার নয়া 'অন্ধকার যুগ'য়ের ইতিহাস। কে জানে, 'নিজের' ইচ্ছায় 'সমর্থক' হওয়াই হয়তো 'আমি'র 'আমরা'র রাজ্যে প্রবেশের প্রথম দুয়ার। এতে 'আমি' ও 'আমরা' সমার্থক হয়।
এ রাজ্যের অভিধানে আক্ষরিক অর্থেই 'আমি' বলে কোনে শব্দ নেই। শব্দটি ও এর দ্যেতনাযুক্ত অন্য সব শব্দই রাজ্যের অভিধান থেকে এক্সপাঞ্জ করা। নাগরিকেরা কেউ 'আমি'র সাথে পরিচিত নয়। সেখানে সবাই 'আমরা' ব্যবহার করে। একা বসে মনের সুখে কেউ খেতে বসলেও সে বলে, "আমরা খেতে বসেছি।" বইটি ১৯৮৭ সালে 'হল অব ফেইম এওয়ার্ড' পায় এবং ২০১৪ সালে 'রিট্রোস্পেকটিভ হুগো এওয়ার্ড'য়ের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের 'দি মনস্টার' যদি নিজের জন্য 'আই' এর স্থানে 'উই' সর্বনামটি ব্যবহার করতো, তাহলে মেরি শেলি ও আয়ন র্যান্ড'কে এক নিমেষেই এক সুতোয় গেঁথে ফেলা যেতো এবং দৈত্য ও আমরা-কে সমান চিহ্নের ডানদিকে বামদিকে ফেলে অনেক সহজেই অনেক সমীকরণ মেলানো যেত। আমাদের কালেও এর প্রমাণ রয়েছে। ভদ্র 'আমি'গুলো একা একা রাস্তা দিয়ে চলার কালে পকেটমার সন্দেহে কাউকে পেয়ে যখন 'আমরা' হয়ে যায়, তখন নির্মমতা কী জিনিস তা পাশের অন্ধটিও টের পায়।
সে যাই হোক, আয়ন র্যান্ড ফ্যাসিবাদের পতন দেখেছিলেন। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর একের পর এক বিধ্বস্ত হতে শুরু হবার বেশ কয়েক বছর আগেই তার মৃত্যু হয় ১৯৮২ সালে। ফ্যাসিবাদ ও সমাজতন্ত্র পতনের পর এখনকার বিশ্বে আয়ন র্যান্ডের আর চিন্তিত হবার কোনো অবকাশ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু নিজের ঘোর সমর্থিত ক্যাপিটালিজমের খাদেই তার সাধের ইন্ডিভিজুয়ালিজমের পতন হতে পারে—বেঁচে থাকলে আয়ন র্যান্ড হয়তো এই অভাবিত সম্ভাবনা দেখে শঙ্কার সাথে আশ্চর্যও হতেন নিশ্চয়।