তথ্য অধিকার

মোনেম অপু
Published : 1 Nov 2016, 09:46 AM
Updated : 1 Nov 2016, 09:46 AM

ভূমিকা

নাগরিক চিন্তায় 'জানার অধিকার (Right to Know),' 'তথ্যের স্বাধীনতা বা মুক্তাবস্থা (Freedom of Information),' 'Right of Access to Information,' 'তথ্য অধিকার (Right to Information),' 'তথ্যের মুক্ত প্রবাহ (Free Flow Of Information)' ইত্যাদি টার্ম ব্যবহৃত হচ্ছে, যা মূলত তথ্য পাওয়ার অধিকার সম্পর্কিত। প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে তা পাওয়াকে একটি অধিকার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে আধুনিক বিশ্বে। তথ্য অধিকার সম্বন্ধে সজাগতা বৃদ্ধি এবং এ অধিকারকে আইন দ্বারা সুরক্ষিত করা ও ব্যবহারিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি উজ্জীবিত গতিধারা বিশ্ব জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে। নাগরিক সমাজ, এনজিও এবং জনগণের কাছ থেকে তথ্য অধিকারে পক্ষে দাবী ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।

জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস, কাউন্সিল অব ইউরোপ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ তথ্য অধিকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং মানুষের জন্য এ অধিকারকে নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করছে। কোনো সরকার বা পাবলিক প্রতিষ্ঠান বা এমন কি এনজিও'র পক্ষেই মানুষের তথ্য অধিকারকে এখন অস্বীকার করা খুবই দুরূহ।

তথ্য অধিকারকে সংক্ষেপে RTI রূপে লেখা হয় এবং এ-বিষয়ক আইনকে সাধারণত RTI Act বলা হয়। তবে আরও সাধারণভাবে এ সংক্রান্ত আইন-কানুনকে Freedom of Information Law, সংক্ষেপে FOI Law, বলা হয়ে থাকে। একে অনেক দেশে Open Records Act বলেও অভিহিত করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে একে Sunshine Act বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

তথ্য অধিকারের বিষয়টি প্রধানত সরকার ও তার অধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের তথ্যের সাথে সম্পর্কিত। তবে ব্যাপারটি নাগরিকদের সাথে সম্পর্কিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর—যেমন: ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিকম কোম্পানি, শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবহণ কোম্পানি ইত্যাদি—বেলায়ও প্রযোজ্য হতে পারে। আবার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বা ব্যক্তির অন্য কোনো মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে এমন কারণে, যথাক্রমে, কোনো কোনো পাবলিক সংস্থাকে বা কোনো কোনো ধরণের তথ্যকে এরূপ আইনের আওতার বাইরেও রাখা হতে পারে। তবে দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সকল প্রতিষ্ঠানই এ আইনের আওতায় তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকতে পারে।

তথ্য স্বাধীনতার গুরুত্ব

মানবিক মর্যাদায় সমতা ও সমরূপে সম্মান প্রাপ্তি প্রত্যেক মানুষের জন্য মৌলিক অধিকার। এ অধিকারের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত মানুষের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার। তাই তথ্য অধিকারও মানুষের একটি মৌলিক অধিকার।

শিক্ষা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। শিক্ষা হচ্ছে লোকদের মধ্যে জ্ঞানের হস্তান্তর, বিস্তার ও প্রসার। জ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে আদতে তথ্য ও উপাত্ত। এদিক থেকে বিবেচনা করলেও তথ্য অধিকারকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা যায়। তথ্য গোপন করার অর্থ দাঁড়ায় জ্ঞানকে গোপন করা।

চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এ স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বিবেচিত হয়েছে।

গণতন্ত্রের প্রথম কথাই হচ্ছে, জনগণই রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক। এই মালিকানা কার্যকর করার জন্য এবং জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক।

জনগণের অংশীদারীত্বমূলক গণতন্ত্র জোরদার করার জন্য তথ্যের মুক্ত অবস্থা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। তথ্যের অভাবে নাগরিকের পক্ষে যথাযথ নির্বাচনী সিদ্ধান্ত নেয়া যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনই তার পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়াও সম্ভব হয় না।

জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও তথ্য অধিকার জরুরী। গোপনীয়তা হচ্ছে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অব্যবস্থাপনা, সেবা প্রাপ্তিতে হয়রানি, অধিকার বঞ্চনা, দুঃশাসন ইত্যাদির সূতিকাগার।

তথ্য অধিকারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সুইডেনে প্রায় আড়াইশ' বছর আগে ১৭৬৬ সালে 'ফ্রিডোম অব প্রেস এক্ট' জারি করে। এটাকেই তথ্য অধিকার বিষয়ক আইন প্রণয়নের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে তথ্য পাওয়ার অধিকার একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রথম সভাতেই, রেজোল্যুশন ৫৯/১ এর মধ্যে, তথ্যের স্বাধীনতাকে একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং এটিকে সকল অধিকারের কষ্টিপাথর হিসেবে উল্লেখ করে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে গৃহীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার আর্টিক্যাল ১৯ এ মত ও প্রকাশের অধিকারের সাথে তথ্য প্রাপ্তিকেও প্রত্যেকের অধিকার হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৬ সালে ফ্রিডোম অব ইনফরমেশন এক্ট প্রবর্তন করে যা ১৯৬৭ সালের ৫ই জুলাই কার্যকর করা হয়।

ফ্রান্স RTI আইন প্রবর্তন করে ১৯৭৮ সালে; ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য, ২০০২ সালে পাকিস্তান, ভারত ২০০৫ সালে, বাংলাদেশ ২০০৯ সালে। [সূত্র]

২০০০ সালের মধ্যে ৩৬টি দেশ এবং ২০১৬ সালের মধ্যে মোট ১১৩টি দেশ এ আইন প্রবর্তন করেছে। ফিলিপাইন হচ্ছে এখন অবধি সর্বশেষ দেশ। [সূত্র]

২০০২ সাল থেকে বিশ্বের তথ্য মুক্তি আন্দোলনের কর্মীরা প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক জানার অধিকার দিবস (International Right to Know Day) পালন করে আসছে। [সূত্র]

বিশ্ব র‍্যাংকিং (World Ranking)

Access Info EuropeCentre for Law and Democracy (CLD) যৌথভাবে The Right to Information Rating নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের RTI লেজিসলেটিভ ফ্রেমওয়ার্কের সবল-দুর্বল দিক-অঞ্চল খুঁজে বের করে তার ভিত্তিতে একটি মান প্রদান করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এভাবে এসেস করার পর আইনি ফ্রেমওয়ার্কে উন্নয়ন সাধনে দেশটিকে সহায়তা করা। তারা এমনকি এজন্য দেশকে আইন-বিশেষজ্ঞ দিয়েও সহায়তা করতে প্রস্তুত। ৭টি সেকশনে [এ লিংকে পয়েন্ট বিন্যাস ছাড়াও ১১১টি দেশের তথ্য অধিকার সংক্রান্ত আইনের পিডিএফ কপি'ও আলাদা আলাদা ভাবে ডাউনলোডের জন্য দেয়া আছে] মোট ৬১টি ইন্ডিকেটরের ভিত্তিতে তারা মোট ১৫০ পয়েন্টের একটি এসেসমেন্ট করে থাকে।

এ তালিকায় এখন অবধি ১১১ দেশের নাম রয়েছে। মোট ১৫০ পয়েন্টের মধ্যে ১০৭ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশের তথ্য অধিকার আইনী ফ্রেমওয়ার্ক গুণগত দিক থেকে তালিকায় ২৩তম স্থানের অধিকারী। ১৩৬ পয়েন্ট নিয়ে মেক্সিকো র‍্যাংকিংয়ে সবার উপরে এবং ৩২ পয়েন্ট নিয়ে অস্ট্রিয়া সবার নিচে অবস্থান করছে। ভারত ১২৮ পয়েন্ট নিয়ে ৪র্থ স্থানে, শ্রীলঙ্কা ১২১ পয়েন্ট নিয়ে ৯ম স্থানে, ১০৪ পয়েন্ট নিয়ে নেপাল ২৬তম স্থানে, পাকিস্তান ৬৬ পয়েন্ট নিয়ে ৮৯তম স্থানে অবস্থান করছে।

নিচে তালিকার প্রথম ২৫টি দেশের অবস্থান দেয়া হলো:

অবস্থান—দেশ—আইন পাশের সাল—পয়েন্ট
১—মেক্সিকো—২০০২—১৩৬
২—সার্বিয়া—২০০৩—১৩৫
৩—স্লোভেনিয়া—২০০৩—১২৯
৪—ভারত—২০০৫—১২৮
৫—ক্রোয়েশিয়া—২০১৩—১২৬
৬—লাইবেরিয়া—২০১০—১২৪
৭—এল সালভাদর—২০১১—১২২
৮—সিয়েরা লিওন—২০১৩—১২২
৯—শ্রীলঙ্কা—২০১৬—১২১
১০—তিউনিসিয়া—২০১১—১২০
১১—দক্ষিণ সুদান—২০১৩—১২০
১২—মালদ্বীপ—২০১৪—১১৬
১৩—আযারবাইজান—২০০৫—১১৫
১৪—এন্টিগুয়া—২০০৪—১১৩
১৫—মেসিডোনিয়া—২০০৬—১১৩
১৬—কেনিয়া—২০১৬—১১৩
১৭—ইথিওপিয়া—২০০৮—১১২
১৮—নিকারাগুয়া—২০০৭—১১১
১৯—মোলদোভা—২০০০—১১০
২০—দক্ষিণ আফ্রিকা—২০০০—১০৯
২১—ব্রাজিল—২০১১—১০৮
২২—ইউক্রেন—১৯৯২—১০৮
২৩—বাংলাদেশ—২০০৮—১০৭
২৪—কসোভো—২০০৩—১০৬
২৫—ফিনল্যান্ড—১৯৫১—১০৫

নিচে তালিকার শেষ ১০টি দেশের অবস্থান দেয়া হলো:

অবস্থান—দেশ—আইন পাশের সাল—পয়েন্ট
১০২—তাইওয়ান—২০০৫—৫৮
১০৩—ইতালি—১৯৯০—৫৭
১০৪—কাজাখস্তান—২০১৫—৫৭
১০৫—জার্মানি—২০০৫—৫৪
১০৬—জর্ডান—২০০৭—৫৩
১০৭—ইরান—২০০৯—৫০
১০৮—তাজিকিস্তান—২০০২—৪৯
১০৯—ফিলিপাইন—২০১৬—৪৬
১১০—লিখটেনস্টাইন—১৯৯৯—৩৯
১১১—অস্ট্রিয়া—১৯৮৭—৩২