মোনেম অপু
Published : 14 Dec 2016, 06:41 PM
Updated : 14 Dec 2016, 06:41 PM

কচু একধরনের কন্দ জাতীয় গাছ। আমরা কচুর দেখা পাই রাস্তার পাশে, বাড়ির কানাচে, পতিত জমিতে। অনাদরে-অবহেলায় প্রায়শঃই কচু হয়ে থাকতে দেখা যায় কচুকে। কচুর জাত-বৈচিত্র্য আছে এবং কোনো কোনো জাতের কচু আমরা চাষ করে থাকি। বনে-জঙ্গলে জন্মায় বুনোকচু। বুনোদের প্রতি আমাদের বিশেষ বিরাগ থাকায় আমরা বুনোকচু কচু-কাটা করি না। আমরা কাটি ও কামড়াই মুখীকচু, ওলকচু, মানকচু ইত্যাদি। পেটের জ্বালা নিবারণে শুধু নয়, মনের সুখের জন্যও আমরা কচুর কোনো কোনো প্রজাতিকে টবে ও বাগানে ফেলে যত্ন-আত্তি করে থাকি। কতকে দেয় বাহারি পাতা, আবার কতকে ফোঁটায় সুদর্শনা ফুল।


.
কচু নানা গুণে ভরা একটি পুষ্টিকর খাদ্যও বটে। প্রজাতিভেদে কচুর শাক, কচুর মুখী, কচুর লতি সবই আমরা খেয়ে থাকি; পাতা, কাণ্ড বা মূল কিছুই ফেলে দেই না। কচুর মধ্যে প্রচুর ভিটামিন-এ থাকায় দিনকানা লোকেরাও রাতকানা রোগ প্রতিরোধে উপকার পায়। কচুর প্রধান খাদ্য-উপাদান হলো লৌহ, যা রক্তে হিমোগ্লোবিন যোগায়, যা আবার দেহে অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখে। ১০০ গ্রাম কচুশাক থেকে ৩৯ গ্রাম প্রোটিন, ৬.৮ গ্রাম শর্করা, ১৫ গ্রাম চর্বি, ২২৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১০ মিলিগ্রাম আয়রন, ৫৬ মিলিগ্রাম খাদ্যশক্তি মেলে। শক্কর-চর্বি কম থাকায় কার্ডিয়াক ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্যও এটি ভাল। তাই বলে কচুর কোনো স্বাদ নেই তা নয়। স্বাদেও কচুর সব রূপই অনন্য। কলমি লতার মতো নেতানো আঙুল ফুলে কদলী বৃক্ষ হয়ে গেলেও জিহ্বা থেকে কচুর স্বাদ উধাও হয় না।

তা ছাড়াও কচুর আরও নানাবিধ উপকার রয়েছে।


.
বর্ণে কচুপাতা ঘনশ্যামা, আকারে ভালবাসার প্রকাণ্ড একটি চিহ্ন। রূপে তার স্বতন্ত্র লাবণ্য আছে। গায়ে পড়া জলকেও সে সুন্দর আকার দেয়। মোহিত পানিও গোলকের আকার পেয়ে শিহরণে চঞ্চল হয়ে ওঠে। যত্নের অভাব হলে ছলাৎ করে ফেলে দিতেও পাতা দেরী করে না। একারণেই জীবন বা বন্ধুত্বের মতো নারীমনের তুলনাও করা হয় পানির কচুপাতার সাথে। তবে পানিই কালি হয়। কালিই প্রবাদ লিখে। যত্ন-অসচেতন কালির প্রবাদে যেন ছেদটাই, আভূমি পতনটাই ঘন হয়ে বিলাপ করে। সচেতন হলে লভিত স্ফটিকাকার ও গতির আ্যাক্রোবেটিক ছন্দটা যে একটা স্থায়ী রূপ পেতে পারতো সেটাকে সে দেখতে পায় না।

নরম পেলেই কামড়ায়। অকরণেই কামড়ায়। আর কামড়ালে কামড়াবে না! তাই কি হয়? কিন্তু কুকুরের গা তো আর মোমের মতো মসৃণ নয় যে কামড় দিতে ইচ্ছে হবে, বরং গায়ের যা অবস্থা তাতে না হবারই কথা। তাছাড়া শক্তের ভক্ত, নরমের যম কথাটি তো আর এমনি এমনি আসেনি। মান রক্ষার্থে সুমানুষ সেজে তাই সে-বেলা তাকে কবিতা লিখতেই হয়। আপনি কান পাতলেই শুনতে পাবেন, মহামানুষির সে-কবিতায় আহত অভিমান আর কামড়াতে না পারার জ্বালার পরনিন্দাসর্বস্ব গোপন আর্তনাদ। নরমদের মতো কচুর অঙ্গও নম্র। কচুর অঙ্গে শানিত ছুড়ি চালিয়ে অনায়াসে ও বিমলানন্দে সাঁই সাঁই করে তাকে ফালি ফালি করে ফেলা যায়। তাই বাঁশে দা বসিয়ে কেউ খুনের প্রশিক্ষণ নেয় না, কচুর আশ্রয় নেয়। কচু কাটতে কাটতে খুনেচ্ছু একদিন মানুষ-খুনি হয়, অস্ত্রপাণি বীর হয়ে রক্তিম নয়নে কচুর মতো নরম মানুষের খোঁজে ধাবিত হয়।

কচু গাছ মানবের ব্যথায় মানবের সমান হয়ে থাকে। মানবের জীবন ও মৃত্যু দুইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে সে সমান মর্যাদাও দেয়। অন্যকে খুন করার ইচ্ছার মতোই, নিজেকে খুন করার ইচ্ছাও মানবের হয়ে থাকে। কিন্তু জীবন থাকতে এ-ভুবনে মরতে আসলে কে-ই বা চায়! মরার ইচ্ছা ও বাঁচার ইচ্ছা, অথবা, মারার ইচ্ছা ও বাঁচানোর ইচ্ছার সহাবস্থানের কারণে আমরা কচু গাছে ঝুলি অথবা ঝোলার পরামর্শ দেই। কচু গাছও জীবন-মৃত্যুর দুই ইচ্ছাকেই মহানুভবতার সাথে একত্রে পূর্ণ করে থাকে।


.
তবে রাগের বশে আদিম বন্যতায় কাঁচা কচু কামড়ালে গলার খবর হয়। তাই কচু দেখলেই কামড়ানোর স্বভাব ভাল ফল বয়ে আনে না। চোখের সামনে কচুকে সমানে কচুকাটা হতে দেখে কাঁচা-কচু-দংশন-জনিত পোষা রাগের বশে আহ্লাদে বিগলিত হলেও চলে না। অবাধে কচুকাটা করতে দিলে একদিন কচুর অভাব হবে। সেদিন কচুর নিকুচি করে কচুকাটিয়ে অ-কচুদের দিকে যে ধাবিত হবে না তার নিশ্চয়তা পণ্ডিত-জ্যোতিষী কেউই দিতে পারবেন না।

বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, সত্য হচ্ছে, সচেতনতা-সতর্কতা জীবনের জন্য সর্বদাই সর্বত্রই মঙ্গল বয়ে আনে।

[ছবিগুলো আমার নয়, ভাইগ্না চুরি করেছে তার গুগল মামুর বাড়ি থেকে।]