রায়ের ভবিষ্যৎ

আসিফ মুনীর
Published : 8 June 2011, 07:31 AM
Updated : 19 Sept 2014, 08:21 PM

মুক্তিযুদ্ধের সময় 'দেইল্যা' রাজাকার, পরবর্তীতে তুখোড় ও জনপ্রিয় ইসলামি ওয়াজকারী, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ জামায়াত-এ-ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলের নায়েব-এ-আমির, আরও সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃত যুদ্ধাপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত আসামি। চাঁদে দেখা তার চাঁদবদন। পাশাপাশি রয়েছে ওয়াজের ক্যাসেট নিয়ে মুখরোচক সমালোচনা ও ব্যাঙ্গাত্মক গান, অথবা 'মেশিন চলবে'-এর মতো পরনারীর সঙ্গে তার যৌন-ফোনালাপের ফাঁস হয়ে যাওয়া অডিও। আরও কিছু গুণ-বেগুণ বাদ গিয়ে থাকলে পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন।

সবকিছু মিলিয়ে নিঃসন্দেহে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের মিডিয়া ও আপামর জনগণের আলোচনায় বিখ্যাত ও কুখ্যাত। ইন্টারনেটের বদৌলতে এই ব্যক্তির বিস্তার বিশ্বময়-– সামাজিক মিডিয়া আর ইউটিউবে। আলামত দেখে মনে হচ্ছে এই 'সাঈদী মেশিন' চলবে আরও অনেক বছর। আমৃত্যু শুধু নয়, তার পরেও, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। এখন জীবন্ত কিংবদন্তী, ভবিষ্যতের শুধুই কিংবদন্তী। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

যুদ্ধাপরাধের জন্য মহামান্য আদালতের রায়ের পরে দেশ-বিদেশ তার পক্ষে-বিপক্ষে আবার মাতোয়ারা। এ যেন বাংলাদেশের এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। হরতাল, ভাঙচুর, কাঁদানে গ্যাস, পত্রিকার পাতা, চায়ের কাপে ঝড় (বাস্তবে, আন্তঃজালে), টকশো বিতর্কে-– সারা দেশ মেতেছে সাঈদী জ্বরে। এই জ্বর কমতে সময় লাগবে না, অচিরেই আমরা নতুন কোনো আলোচনায় মেতে উঠব আর ভুলে যাব তার কথা।

তবে তিনি আছেন, থাকবেন আর আমাদের আনন্দ দেবেন বা জ্বালাবেন অনেক দিন, থেকে থেকে। আশঙ্কায় আছি, কবে আমৃত্যু কারাবাসপ্রাপ্ত সাঈদী তার মেহেদিরাঙা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে গলায় মালার বোঝায় কষ্টে নুয়ে পড়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এসেই জামায়াতের নায়েব-এ-আমিরের গুরুদায়িত্ব বা আরও বড় রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করবেন, আর নতুন উদ্যমে তার সমালোচকদের পিণ্ডি চটকে সিডি আর ইউটিউব ভিডিও ছাড়বেন। কোনো একসময় দেখব দেশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী! এই স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন একেবারে অসম্ভব মনে করি না।

নারী-পুরুষ সাঈদীভক্তরা হরতাল করবেন, তার মুক্তির জন্য আইনি-বেআইনি সবকিছু চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে সর্বোচ্চ আদালতের রায় ঘোষণায় যখন সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগের প্রায় সবগুলো প্রমাণিত বলা হল, দেশের এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে এই অপরাধগুলো মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্যযোগ্য অপরাধ হলেও কোনোটির ক্ষেত্রেই যখন সেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা না হয়, তখন আত্মসমালোচনাই করা উচিত আমাদের, মানে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নৈতিক সমর্থনকারীদের।

দয়া করে ভাবুন গলদটা কোথায়। সেই কাদের মোল্লার রায় থেকে যে সংশয় শুরু, স্কাইপ কেলেঙ্কারি দিয়ে যা আরও সংকটাপন্ন, সাক্ষী নিখোঁজ হয়ে যাওয়া দিয়ে যে প্রক্রিয়া আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারংবার।

আমি নিজে এই আদালতের একজন সাক্ষী হিসেবে কাছে থেকে দেখেছি প্রচণ্ড নিষ্ঠাবান কিছু মানুষ তথ্যানুসন্ধান, তদন্ত, প্রমাণাদি দিয়ে যুক্তিতর্ক তৈরি করে প্রতিটি কেস কীভাবে উপস্থাপন করছেন এবং লড়ছেন। কিন্তু এটিও অবাক হয়ে এবং দুঃখ ভরে দেখেছি, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, যুদ্ধাপরাধের বিচার তদন্তে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের অভাব এবং প্রফেশনালিজমের চেয়ে ইমোশনের আধিক্য।

এই যে সারা বিশ্বে (দেশেও কেউ কেউ) বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিরূপ সমালচনা করেন, তার বিরুদ্ধে মানহানি বা আদালত অবমাননার মামলা হয় এবং তা প্রচার করা হয়। অথচ আজ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের সমালোচনাগুলোর যৌক্তিক খণ্ডন প্রকাশ্যে, গণমাধ্যমে ট্রাইব্যুনালকে করতে দেখলাম না। বরং বাইরে থেকে অনেক বেশি যৌক্তিক খণ্ডন করে চলেছে অনেক নিবেদিতপ্রাণ, যুদ্ধাপরাধের বিচারকামী মানুষ। অবাক লাগে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়ার কোনো চাক্ষুষ মিডিয়া সেল ও গণসংযোগ বিভাগ নেই। যদি থাকেও, আমার মতো অনেকেই জানেন না তারা কী করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে সাঈদীর বিচারের রায়ে জনগণের আশাহত হবার কথা বলেছেন এবং অন্যান্য সাংসদরা সায় দিয়েছেন। কিন্তু কোনো রায়ে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি বা দুর্বলতাগুলো কমানোর ক্ষেত্রে সরকার ও সংসদের কোনো আলোচনা, উদ্যোগের কথা আমরা জনগণ প্রকাশ্যে জানতে পারি না।

আবার যারা রাজপথে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন, রায়ে অসন্তুষ্টি থেকে প্রতিবাদ করেন, রায়ের আগে বা পরে তাদের কোনো গঠনমূলক তৎপরতা দেখি না। যেমন বিদেশে ব্যাপৃত বাঙালি তরুণদের একটি নেটওয়ার্ক গবেষণা দিয়ে যুক্তিনির্ভর সেমিনার, ব্লগ, ভিডিও নিরলসভাবে প্রচার করে চলেছেন। নব্বই-এর দশকের গবেষণানির্ভর একটি ইংরেজি প্রামাণ্যচিত্রের কারণেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অনেক প্রমাণ ও সাক্ষী আদালতে পেশ করা গেছে। আবার সেই হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি প্রবাসী হওয়ায়, তাকে দেশে পাঠানোর জটিলতা থাকায়, একদিকে সেই দেশে চলছে তার অপরাধের ব্যাপারে প্রচার, অন্যদিকে জনমত গঠনের জন্য স্বাক্ষর গ্রহণ।

কিন্তু দেশে মনে হয় আমরা অনেক ব্যাপারেই বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে হুজুগে চলি। দ্রুত প্রচণ্ড আবেগে আনন্দ বা ক্ষোভে ফেটে পড়ি, তারপর এক সপ্তাহ বা এক মাস পর সেই আবেগ থিতিয়ে আসে আর যেন ভুলেই যাই কেন ওই আবেগ প্রকাশ করেছিলাম। অবস্থার বিশ্লেষণ করে কোনো সুদূরপ্রসারী, সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন খুব দুর্লভ। সেই কাদের মোল্লার প্রথম রায় থেকে সর্বশেষ দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রায় পর্যন্ত সবগুলো রায়ের বিশ্লেষণ করে প্রচার ও জনমত গঠন হতে দেখি না।

গবেষণা করলে দেখা যাবে যে এইসব রায়ে তাদের বিরুদ্ধে আনীত সবগুলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায়নি। তার মানে প্রমাণিত হয়নি যে, তারা ওই অপরাধগুলোর ব্যাপারে নির্দোষ। বরং এই ভাবনা অমূলক হবে না যে, তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সম্ভাব্য সকল প্রমাণাদি সংগ্রহ করা যায়নি অথবা যা পাওয়া গেছে তা সুদৃঢ়ভাবে আদালতে উপস্থাপন করা যায়নি। কেন যায়নি, কীভাবে চলমান বিচারকার্যে সেগুলো আরও বলিষ্ঠ করা যায়, সংশ্লিষ্ট সকলের সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আর রায় পছন্দ-অপছন্দের জন্য সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেই খালাস হলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের, সংসদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বিচার প্রক্রিয়াকে ত্রুটিমুক্ত, তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবক্তা সরকারের উদ্যোগে এই ট্রাইব্যুনালে সঠিক ও মানসম্মত আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ নিশ্চিত করা উচিত।

সরকারের ভেতরে-বাইরে এই উদ্যোগগুলো যথেষ্ট না করে সাময়িক আবেগের জোয়ারে ভাসতে থাকলে বাংলাদেশের সকল শহীদের পরিবার, বীরাঙ্গনা আর আসল মুক্তিযোদ্ধা সরকার ও দেশবাসীকে ক্ষমা করবে না। দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল যুদ্ধাপরাধীর সুষ্ঠু চিহ্নিতকরণ, তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন, বিচার, রায় ও রায়ের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

যত বছর লাগে লাগুক, কিন্তু সুষ্ঠুভাবে হোক।

আসিফ মুনীর: শহীদ সন্তান, উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক কর্মী।