ভেঁপু, কবুতর ও ঝড়

মোনেম অপু
Published : 2 July 2011, 02:38 PM
Updated : 2 July 2011, 02:38 PM

আমার পাশের বাড়ীর আব্দুল্লাহ নামের ছেলেটি শ্বেতকান্ত, অর্থাৎ গাত্রবর্ণে একেবারে গোরা। সারা মাথায় আফিমের নেশা আর সারা গায়ে যত্রতত্র ডজন খানেক পকেটে অর্থের অভাব একসাথে দেখা দিলেই তবে তার দেখা মেলে। বলে: বড় ভাই! বুঝতেই তো পারছেন।

না খেয়ে থাকা মানুষের খোঁজ না নিলে কী হবে, দুনিয়ার এতো এতো মানুষের যন্ত্রণা ও বঞ্চনাকে পিছনে ফেলে দু'হাত বৃথাই আসমানের দিকে তুলে নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে নাচতে লজ্জা না লাগলে কী হবে—উচিৎ শিক্ষা দেয়ার সুযোগের অপেক্ষায় সদা নিশপিশ করে আমার হাত দুটো, আর মুখিয়ে থাকে মুখটা; নাকটা ডুবিয়ে রাখি মানুষের দোষের স্তূপের ভেতর, যদি নতুন আবিষ্কারের গন্ধ মেলে। আমার মুখের ভাবটি দেখলেই আব্দুল্লাহ বলে বসে, মন গলানো ভাষায়: কেমন আছেন বড় ভাই! ভাবী ভাল তো?

ভাবীর উল্লেখে মেজাজ বেঁকে বসে—ডালমে কুচ কালা হ্যাঁয়। যে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যায় না তা কিভাবে ম্যানেজ করতে হয় তা আমি শিখেছি আমার গ্রামের ছেলে মেয়েরা মায়ের পেট থেকে পড়েই যেভাবে সাঁতার শেখে ঠিক সেভাবেই। রাঙা চোখ দেখে আব্দুল্লাহ কাতর হয়ে উঠে: আচ্ছা থাক দাদা! আর আসবো না, এখন চলি।

ফিরে যেতে উদ্যত হয়েই আবার ঘুরে বসে পড়ে মেঝেতে। তারপর সেই একই কথা, গত রাতের স্বপ্নের কথাটা শুনবেন? আচ্ছা থাক, বরং আবোল-তাবোল বকি কতক্ষণ।

আমি তার পছন্দের শ্রোতা।

শোনেন বড় ভাই! বেশী রাত করে ঘুমলে যা হয় আমার, আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে না—ভাঙে হৈ চৈ আর গাড়ীর ভেঁপুতে। ট্রাফিক জ্যাম। স্কুল। অফিস। জ্যাম-ক্লিষ্ট মানুষের প্রতিযোগিতা; তারস্বরে ভুল ধরিয়ে দেয়ার, আর রেডিমেড সমাধান দেখিয়ে দেয়ার। অধৈর্য গাড়ী চালকের হাতের কাছেই হর্ন। সামনের গাড়ীর যাওয়ার জায়গা থাক আর না থাক, বাজাতে তো আর পয়সা লাগে না। ভাবে আমি যখন জেগেই আছি অন্যে ঘুমবে কেন? ঘুম ভাঙতেই রেডি হ, দে ছুট, নইলে যে আবার অন্নাভাব!

শুনেছি পশ্চিমের বড় বড় দেশে গাড়ীর হর্ন শোনা যায় না। ভাল মানুষেরা একেবারে ঠেকায় না পড়লে তা বাজায় না। মানুষকে বিব্রত না করে যতটা থাকা যায়। দু'একটি পাঁজি লোক সব স্থানেই পাওয়া যায়। ওরা হর্নকে কাজে লাগায় অন্যকে শরম দেয়ার জন্য। তবে সে সুযোগও নাকি মেলে কালেভদ্রে। পাঁজিগুলো তক্কে তক্কে থাকলে হবে কী, খায়েশটা মেটে হয়তো সারা জীবনে গোটা পাঁচেক বারের জন্য। কারণ, হিসেবে ভুল হলে সবার ভ্রুকুটি সইতে হয় যে উল্টো।

কাজ শেষে ফিরছিলাম ঘরের দিকে। রিক্সা করে। সব তাতেই উঠতে ভয়। যতই বুঝাই—এতো মানুষ যাওয়া আসা করে! কে কয় বার পড়েছে রিক্সা থেকে? কয়জন কয়বার ভেঙেছে পা মিনিবাস উল্টিয়ে?—কিন্তু কাজ হয় না। বুঝলেন দাদা, ডাক্তার কেবলই বকে! টেনশন করো না, টেনশন করো না। অবচেতন ভয়, অবচেতন টেনশন নাকি প্রেশার বাড়ানোয় বেশী উস্তাদ। শঙ্কা কিডনি পর্যন্ত গড়ায়।

আকাশে মেঘেরা কখন যে কালো হয়ে উঠছে আর সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে খেয়াল করিনি। এক কবুতর ওয়ালাকে দেখলাম আমার দিকে কেন জানি তাকিয়ে আছে। ভাবলাম, দেখি না কী বলে। রিক্সা থেকে নামলাম। মুখ দেখে বা কথা শুনে কী জানি কী বুঝলো সে। কবুতরের দিকে তাকিয়ে কী একটা বললো—কবুতর হাঁটতে শুরু করলো থরে থরে সাজানো ভাগ্য-খামের উপর দিয়ে। কবুতরের চলার ঢংয়ে সম্রাটের আভিজাত্য নজরে পড়ার মতো। বেটা শিখিয়েছে ভাল!

কিন্তু এরই মধ্যে ঝড়ের আলামত নজরে পড়লো বড় বড় গাড়ীর ঝনঝনয়ে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া থেকে। আজকাল কার গান কে লিখে, কে সুর দেয়, আর কে গায় বোঝা শক্ত। আগের কালে বড় বড় করে লেখা থাকতো রাজ্জাক-ববিতা, আজকাল শুধুই ছবি। সকলেই গান গায় ভেঁপু বাজিয়ে, পাল্লা দিয়ে; কোনটায় কে, কে জানে! মনটা বিষণ্ণ হয়ে ছিল সকাল থেকেই। কিছু না বুঝেই দিলাম দৌড় বাড়ির দিকে। থাকল পড়ে কবুতর আর তার ঠোঁটে আমার জন্য অপেক্ষমাণ খাম। বৃষ্টির ছাঁটে ততক্ষণে কবুতর ওয়ালার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! ঘরে এসে দেখি বউ-কন্যা ঝড় দেখে শঙ্কিত মনে বসে আছে দুয়ার-জানালা সব বন্ধ করে।

গল্প শেষ করে ছেলেটি চলে গেল। গল্পের নেশায় আমি তাকে হাতছাড়া করতে চাইনে বলে আব্দুল্লাহও খুশি। কারুনের ধন যোগায় ঘুমন্তরা, আর নেশার পয়সা যোগায় নেশা। জানি আবার আসবে সে সময়মত। আমিও থাকি তার অপেক্ষায়।