৪। আল্লাহ বিচার দিনের অধিকর্তা।
৪.১। এর প্রথম অর্থ হলো শুভসংবাদসূচক। আমরা যা-ই ভাল কাজ করি না কেন, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা চূড়ান্ত বিচারে নিষ্ফল হবে না। কাজেই নৈরাশ্যের কোনো স্থান আমাদের জীবনে অনর্থক। জগত কেবল বাস্তবই নয়, কেবল ক্ষণিকের মমতা ও করুণার উপরই প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং স্থায়ী সুবিচারের উপরও প্রতিষ্ঠিত—যা টিকে থাকবে মহাকালের পটভূমিতে। আর এই ফল থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা কোনো সৃষ্টিরই নেই।
৪.২। এর দ্বিতীয় অর্থ হলো সতর্কীকরণ সুলভ। আমরা যা-ই মন্দ কাজ করি না কেন, তার চূড়ান্ত ফল থেকে পালাতে পারব না। আমাদের কর্মের ফল আমাদের অস্তিত্বের সাথেই লেগে থাকবে অনাগত কালের জন্য। কাজেই নিজের কর্মাকর্মের দায়-দায়িত্ব বিষয়ে অমনোযোগী বা গাফিল থাকার কোনোই অবকাশ নেই। আর এই ফল থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা কোনো সৃষ্টিরই নেই।
৫.১। আমরা কেবল তোমারই উপাসনা করি।
৫.১.১। আগের ২.২.১ অনুচ্ছেদে ছিল মনোগত স্বাধীনতার সম্বিত। এখানে আমরা পাই সমগ্র জীবন প্রসারিত স্বাধীনতার মূল মন্ত্র। এখানে আমরা সকল সিস্টেমের আনুগত্য, দলীয় আনুগত্য এবং সব রকমের মানসিক ও বাস্তবিক দাসত্ব থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার কথা ঘোষণা করি।
৫.১.২। আল্লাহর উপাসনা বলতে আল্লাহর নিকট নিজেকে সমর্পণ করা, আল্লাহর প্রতি ভক্তিমূলক মনোভাব রেখে চলা, জীবনের সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর পথের দিশাটি অনুসরণে সতর্ক ও সজাগ থাকা বুঝায় এবং বাস্তবিক সে পথে চলাকে বুঝায়।
৫.১.৩। আল্লাহর উপাসনা করার আর একটি অর্থ হলো আল্লাহর দেয়া প্রতিনিধিত্বের অফিসটি গ্রহণ করা এবং মানব জাতির লালিত মূল্যমানগুলোকে কাঁধে তুলে নেয়া। জীবনে সুখ আনন্দই প্রধান নয়, এর উৎসগুলো দখলে আনা এবং তা উপভোগে জীবন ব্যয় করা নয়, বরং মূল্যবোধ আশ্রয়ী জীবনের জন্য সাধনা করা, অন্যের কল্যাণে জীবন ব্যয় করাই আল্লাহর উপাসনার ফলিত দিক।
৫.২। আমরা কেবল তোমারই নিকট সহায়তা প্রার্থনা করি।
৫.২.১। এখানে আমরা আল্লাহর এবং কেবলমাত্র আল্লাহর উপাসনার সামর্থ্যের জন্য তাঁর সহায়তা প্রার্থনা করছি। এ প্রার্থনা জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ ও সফল করার নিমিত্তে প্রার্থনা; বাসনার পরিপূরণে ধন-যশ-ক্ষমতার জন্য প্রার্থনা এটি নয়। এটি আল্লাহর ইচ্ছার নিকট নিজেকে সমর্পণের প্রার্থনা, বিপরীতটি নয়।
৫.২.১। এটি মানসিক স্বাবলম্বিতার চূড়ান্ত প্রকাশ। আমরা সুবর্ণ বিধির আলোচনায় শেষের দিকে বলেছিলাম যে, অন্যের নিকট থেকে প্রত্যাশা একটি মনোগত দারিদ্র্যের নির্দেশক। এখানে সেই দারিদ্র্য থেকে মুক্ত থাকার মনোভাবটি প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ মানসিকভাবে ততখানি সাহসী ও স্বাবলম্বী যতখানি সে আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা বজায় রাখতে পারে। মানুষ ততখানি ভীরু ও পরনির্ভরশীল যতখানি সে প্রকৃতিকে ভয় পায় ও অন্য মানুষের নিকট প্রত্যাশী হয়।
৫.২.২। মুসলিম জীবনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো তার মানসিক সন্ন্যাস দশা ও নিষ্কাম কর্ম প্রয়াস। সে আল্লাহর কাছে ছাড়া অন্য কারও কাছে কিছু প্রত্যাশাই করে না। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও উপর সে নির্ভরই করে না—ভয় বা লোভে পড়ে তোষামোদ করে বা ভক্তি দেখিয়ে মন গলানোর কোনো চেষ্টাই সে করে না।
৬। আমাদেরকে সরল ও সুপ্রতিষ্ঠিত পথ দেখাও।
৬.১। সরল ও সুপ্রতিষ্ঠিত পথ হলো কাণ্ডজ্ঞানের কাছে বোধগম্য অথচ যুক্তিসঙ্গত পথ। এ পথ হেতুবর্জিত, অযৌক্তিক ও ভয়জনিত সংস্কারের পথ নয়, পিতৃপুরুষদের অন্ধ আনুগত্যের পথ নয়। এ এমন পথ যে পথে চলতে গিয়ে পথিকের জন্য নিজেকে অপমান করা আবশ্যক হয় না, অপরকে অপমান করারও প্রয়োজন পড়ে না।
৬.২। এখানে আমরা পাচ্ছি সঠিক পথের প্রার্থনা যা একজন মুসলিম সারা জীবন ধরে করে থাকে। এর একটি দার্শনিক দিক রয়েছে। মুসলিম কখনো নিজের বোধ ও কৃত কাজের বিষয়ে মতান্ধ, পথান্ধ থাকে না। সে সবসময় নিজের মনে একটি বিচারশীল ও সংশয়ভাব নিয়ে চলে—ঠিকটি বুঝেছি তো?—ঠিক পথে এগোচ্ছি তো? এর ফল হলো উন্নতি। নয়তো কখন যে ভুল পথকে ঠিক পথ ভেবে কোথায় হারিয়ে যাব তার সম্বিতটিও থাকবে না। সব মতান্ধতা, পথান্ধতা মানুষের জীবনকে স্থবির করে, হুমকির সম্মুখীন করে।
৭। আমাদেরকে সে পথ দেখাও যে পথে তোমার অনুগ্রহভাজনেরা গিয়েছে, সে পথে নয় যা অভিশপ্তদের বা যা পথহারাদের।
৭.১। যাচিত সুপথটি কোনো খণ্ডিত বা বিভক্ত আদর্শের পথ নয়—এটি সকল কালের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য সুপথ, যে পথে আল্লাহর সকল অনুগ্রহভাজন গমন করেছেন।
৭.২। অন্যের উপর অত্যাচারের পথ হচ্ছে অভিশপ্তের পথ। যারা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার, অন্যকে মর্যাদায় অবনমিত করার, অন্যের উপর অত্যাচার করার পথাবলম্বী তাদের পথই অভিশপ্তের পথ। অহংকার, অপরের উপর অত্যাচার ও নিজের সাথে মিথ্যাচারই অভিশাপ।
৭.৩। অপর দিকে নিজের উপর অত্যাচারের পথ হচ্ছে পথভ্রষ্টতা। যারা অন্য মানুষ বা বস্তুকে ভক্তি করার পথ, নিজেকে অপমান করার পথ ও এভাবে নিজের উপর অত্যাচার করার পথ অবলম্বন করে তারাই পথহারা। এসব পথের পথিক নিজের বুদ্ধিকে আচ্ছাদিত করে রাখে সংস্কারের পর্দায়, নিজেকে অবনমিত করে অন্যের সামনে, নির্বিচারে অনুসরণ করে চলে ভ্রান্ত সংস্কার ও ঐতিহ্যকে।
৭.৪। মধ্যম পথটি হলো আত্মমর্যাদাবোধ ও বিনয়ের পথ। নিজেকে অন্যের চেয়ে ছোট মনে না করাই আত্মমর্যাদা সম্বন্ধে সচেতনতা বজায় রাখা। অপরকে নিজের চেয়ে ছোট মনে না করাই হচ্ছে বিনয়। অন্যকে নিজের চেয়ে মর্যাদায় বড় মনে করাই ভক্তি এবং অন্যকে নিজের চেয়ে মর্যাদায় ছোট মনে করাই অহংকার।