বিভক্ত আদর্শ – স্বরূপ ও পরিণাম

মোনেম অপু
Published : 19 July 2011, 03:58 AM
Updated : 19 July 2011, 03:58 AM

যে আদর্শ সকল মানুষের জন্য নয়, সকল কালের জন্য নয়, সমগ্র জীবনের জন্য নয় তা-ই খণ্ডিত বা বিভক্ত আদর্শ। খণ্ডিত আদর্শগুলো মানব সমাজকে বিভক্ত করে। তাছাড়া এরা একজনের জীবনকেও কালগত ও দেশগত উভয় ক্ষেত্রেই বিভক্ত করে—গতকাল যা আদর্শ ছিল আজ তা পরিত্যাজ্য, ধর্মের দেশে এক আদর্শ ও সংসারের দেশে ভিন্ন নানা আদর্শ।

আমরা ঈশ্বরকে বিভক্ত করতে পারি—এক এক বাসনার লক্ষ্য বা আরাধ্য হিসেবে এক একটি ক্ষুদ্র বা উপ-ঈশ্বর নির্ধারণ করা সম্ভব। একই ভাবে আমরা বিভক্ত করতে পারি মানব জাতিকে—প্রত্যেক জাতি তার নিজের জন্য অন্য জাতিগুলোর ঈশ্বরের থেকে আলাদা ঈশ্বর ঠিক করে নিতে পারে। আমরা জীবনকে বিভক্ত করতে পারি—জীবনের বিভিন্ন অংশের জন্য বিভিন্ন ঈশ্বর নির্ধারণ করা সম্ভব।

জীবনকে একমুখী করতে হলে বাসনার রাশে টান পড়ে, এ টান মনকে বিদ্রোহী করে। তাই আমরা জীবনকে গড়তে চাই চাকার মত করে যেখানে প্রতিটি স্পোক নির্দেশ করে এক একটি বাসনাকে, প্রতিটি বাসনার জন্য থাকে স্বতন্ত্র দিক, স্বতন্ত্র অভিভাবক, স্বতন্ত্র আরাধ্য ও স্বতন্ত্র আদর্শ।

আর এভাবে আমরা আদর্শকে বিভক্ত করতে পারি। এ ক্ষেত্রে জীবন হয় নানা ঈশ্বরের যুদ্ধ ক্ষেত্র। এসব নানা খণ্ডিত আদর্শের সমাহারকে একটি ইউনিফাইড ইউনিট আদর্শ বলা যায় না। এই খণ্ডিত আদর্শগুলোর প্রত্যেকটিই অপূর্ণাঙ্গ আদর্শ। ঈশ্বরের একত্ব, মানবজাতির একত্ব ও জীবনের একত্ব নীতি ছাড়া পূর্ণাঙ্গ আদর্শ সম্ভবই না।

এই অপূর্ণ আদর্শগুলোর স্বরূপ কী? এগুলোর কিছু হলো ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদ অথবা আধিবিদ্যিক বা নীতিতাত্ত্বিক মততন্ত্র মাত্র—এরা মানুষকে বিশেষ করে আমাদের মত সাধারণ মানুষকে নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো পথ বা পদ্ধতি দিতে পারে না। এগুলো সাধারণত কতগুলো ধারণা, ধারণাগুলোর সংজ্ঞা ও সংজ্ঞাগুলোর ব্যাখ্যার সমাহার—যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের বোধ শক্তির বাইরে থেকে যায়। তাই এখানে দরকার হয় পুরোহিততন্ত্র বা তার মতো কিছু। এখানে অনুসারীরা নিজের পথ নিজে দেখতে পায় না, পুরোহিতদের জিজ্ঞেস করে করে চলে।

আর কিছু হলো নিতান্তই রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সিস্টেম গড়ে তোলার প্রোগ্রাম মাত্র—ব্যক্তি মানুষের আচরণের নীতি এগুলো দিতে পারে না। সমন্বয়টি দাঁড়ায়: সিস্টেম + উদারনীতি। অর্থাৎ এখানে অনুসারীকে বলা হয় যে, সিস্টেমে যুক্ত থাকো এবং তারপর যতটুকু স্বাধীনতা থেকে যায় সেখানে বাসনার অনুসরণ কর; কেবল খেয়াল রেখ সিস্টেম যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এখানে থাকে প্রোএকটিভ সিস্টেম রক্ষা বাহিনী।

এসব খণ্ডিত আদর্শগুলো কাজ করে কিভাবে? এগুলো কাজ করে এক ধরণের অভিভাবকতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরা মানুষকে আহ্বান করে তাদের চারপাশে জড় হতে এবং তারা মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেয় নতুন ও ভাল সিস্টেম গড়ে দেয়ার। মানুষ তখন ভাল সিস্টেমের আশায় সৈন্যদের মতো লাইন্ড-আপ হয়। তারপর বিরোধীদের আক্রমণ করে যুদ্ধে জয়লাভের আশা নিয়ে।

এখানে মানুষকে দেখা হয় অক্ষম শক্তিহীন হিসেবে, যার জীবনের সফলতা নির্ভর করে সিস্টেম গড়া ও সিস্টেমে যথাযথভাবে প্লাগ্ড-ইন থাকার উপর। সফলতার রসদ আসে সিস্টেম থেকে। অর্থাৎ সিস্টেম ছাড়া জীবনকে সফল করার আর কোনো উপায় আছে বলে তারা দেখাতে পারে না এবং নিজের জীবনকে প্রতিকূল পরিবেশেও সফল করার সম্ভবপরতা তারা দেখে না।

সামনে আছে শুভদিন, অমুক-তমুকের গলায় মালা দিন। দুনিয়ার মজদুর এক হও। দুনিয়ার মুসলিম এক হও। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই; এই লড়াই বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে। জিহাদ জিহাদ জিহাদ চাই, জিহাদ করে বাঁচতে চাই; এই জিহাদ বাঁচার জিহাদ, এই জিহাদে জিততে হবে। হুঁশিয়ার সাবধান, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, নিপাত যাক, খতম কর …

উপরের সব শ্লোগান খণ্ডিত মতাদর্শ ও ধর্মতত্ত্বসমূহের আসল রূপ ও দর্শনকে অভিব্যক্ত করে। এ স্লোগানগুলোর সবই একমতাবলম্বীদের নির্বিচার সংহতি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি নির্বিচার, প্রোএকটিভ হিংসার প্রকাশ।

আমরা তবে এখন কী করব? বিদ্যমান সিস্টেম ছেড়ে আমরা তো বাঁচতে পারবো না। তবে সিস্টেমের উপর ভরসা করেও সুন্দর ভবিষ্যৎ পাওয়ার কোনো আশা নেই। সিস্টেমের নকিবেরা আমাদেরকে কেবল মিথ্যা আশা ও প্রতিশ্রুতি দেবে। যার নিজের ভবিষ্যতের উপরও নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই, সে মিথ্যাবাদী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন না হলে তোমার আমার সুখের ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কিভাবে? এদের নেতৃত্বে সিস্টেমগত সকল রূপান্তরই এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে যাওয়া মাত্র। সিস্টেম কেবল আমাদের দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখে আর আমাদেরকে ব্যবহার করে অন্য উদ্দেশ্যে—সুখবাদী অভিজাতদের সুখের সামগ্রীর 'পাওয়ার বেইস' হিসেবে।

আমাদের সমস্যার সমাধান আমদেরকেই যতদূর সম্ভব করতে হবে। আমরা যারা কষ্টে আছি, একে অপরের কষ্ট না বাড়িয়ে বরং লাঘবে সচেষ্ট হতে পারি। আমরা যদি একে অপরকে ভালবাসতে পারি তবে সিস্টেম নির্ভরতা কমবে এবং একদিন হয়তো এমন দিন আসবে যখন অবস্থার অনেক উন্নতি হবে। নয়তো আমরা যেমন হয়ে থাকব আমরা তেমনদের দ্বারাই ক্রমাগত পরিচালিত হতে থাকবো। আমরা যদি মূর্খ হই তবে মূর্খরাই আমাদেরকে পথ দেখাবে। আমরা যদি অত্যাচারী হই তবে অত্যাচারীরাই আমাদেরকে শাসন করবে।