মানপত্র ও অনুকরণ

মোনেম অপু
Published : 23 July 2011, 05:13 PM
Updated : 23 July 2011, 05:13 PM

আমাদের পূর্ব পুরুষেরা হাঁটতেন সামনের দিকে তাকিয়ে; মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাতেন—যেন খেই হারিয়ে না ফেলেন। আমরা হাঁটি উল্টোভাবে, পিছন দিকে মুখ করে; মাঝে মাঝে সামনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই, যদি হোঁচট খাই—এই ভয়ে।

আমরা তৈরি করি পূর্ব পুরুষদের সমাধি। আমরা লিখি জীবনী, লিখি ইতিহাস, লিখি অতীতের সমালোচনা। করি বার্ষিকী পালন। আর লিখি মানপত্র। হিজ হাইনেস, হিজ মেজেস্টির জাতি ইংরেজরা ভালই শিখিয়ে গেছে, তুর্কি-সাফাভিদ-মোঙ্গলদের শিক্ষাকে আরও পালিশ করে দিয়ে গেছে! আমাদের সব সৃজনী প্রতিভা তাই মানপত্রের সৌকর্যে সীমাবদ্ধ। যেখানেই যাবেন সেখানেই পাবেন ধুলিমলিন কীটভক্ষিত মানপত্রের শৈল্পিক সম্ভার।

অতীত দেখা সহজ—এটি সার্কাস দেখার মতো। দেখে দুদিকেই যেতে পারা যায়—মর্জি মাফিক, খায়েশ মাফিক। কী সাংঘাতিক! কী আশ্চর্য! জিনিয়াস বটে! আবার উল্টোদিকেও যেতে পারেন। ধড়িবাজ! ভেবেছে চালাকিটা বুঝতে পারি নি? আমার চোখকে ফাঁকি দেয়?

কিন্তু ভবিষ্যৎ দেখা কঠিন—এটি শিল্পকর্মের মতো, সৃজনী প্রতিভা লাগে। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ঈশ্বরকে দেখেছেন, প্রকৃতিকে দেখেছেন একেবারে যাকে বলে সরাসরি, প্রত্যক্ষভাবে, নিজেদের চোখে; আমার দেখি বা দেখতে চাই তাঁদের চোখ দিয়ে।

আমাদের কেন ঈশ্বরের সাথে, প্রকৃতির সাথে নিজস্ব সম্পর্ক থাকবে না? আমাদের কেন নিজস্ব কবিতা, নিজস্ব দর্শন থাকবে না?—যে দর্শন তৈরি হয় অন্তর্দৃষ্টি থেকে; যা কেবল ঐতিহ্যের কঙ্কাল সর্বস্ব অবশেষ মাত্র নয়।

আজও সূর্য আলো দেয় সবাইকে সরাসরি। তাহলে ঈশ্বরের বাণী আমাদেরকে আলো দিতে পারবে না কেন সরাসরি? ফসলের মাঠে, ফলের বাগানে আজ ফলন বেশী। ঈশ্বরের তৈরি প্রকৃতি থেকে আজ যদি আমরা বেশী কিছু আনতে পারি, তবে ঈশ্বরের বাণী থেকে কেন পারব না?

গোলাপেরা হেসে উঠতে চায় মানুষের মতো, আর মানুষ কেবলই শঙ্কিত হয়ে গুটিয়ে যায় অশনি সংকেতের ভয়ে। পাহাড়েরা নানা বৈচিত্র্যে মানুষ হয়ে আকাশের দিকে উঠতে চায়, আর মানুষ কেবলই নত মুখে অবনত হয়ে পড়ে থাকতে চায় মাটি কামড়ে। হাঁটতে গেলে পা ভাঙবে—এই ভয়ে কোন মা তার সন্তানকে নন্দলাল করে রেখেছে? উড়তে গেলে ডানা ভাঙবে—এই ভয়ে কোন মা তার সন্তানকে সরীসৃপ করে রেখেছে?

জগত তৈরি প্রকৃতি ও আত্মা দিয়ে। জগতের সব বস্তু, আমাদের সব কর্ম, আমাদের সব নিপুণতা, আমাদের সব সৃষ্টি, আমাদের দেহটি পর্যন্ত সবই প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি হলো ফেরেশতারা আর আত্মা হলো আদম। ফেরেশতারাই আদমকে সেজদা করেছিল। আদম কবে ফেরেশতাদের সেজদা করতে গিয়েছিল?

আদমের যে সন্তানেরা উল্টো দিকে সেজদা করে নিজেদের অপমান করবে, তারা নিজেদেরকে উন্নত করতে পারবে না—এটাই নিয়ম। যে মানসিকতা মাথাকে উল্টো দিকে ঠেলে দেয়, সে মানসিকতা মানুষের মধ্য থেকে ভবিষ্যৎ দেখার, নিজের সম্ভাবনাকে দেখার, এবং তা গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সৃজনশীল ক্ষমতা কেড়ে নেয় বা বিকশিত হতে দেয় না।

[Ralph Waldo Emerson এর Nature এর দেড় পৃষ্ঠার ভূমিকা অবলম্বন করে লেখা। প্রায় অর্ধেকটাই তাঁর নয়। কাজেই মিলিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। আমার লেখার ভুল/খুঁত তাঁর লেখায় নেই।]