পরাজয় মানে না মানুষ (৬ষ্ঠ পর্ব)

হাবীবুল্লাহসিরাজী
Published : 27 Sept 2020, 01:47 PM
Updated : 27 Sept 2020, 01:47 PM


০১.৮.২০২০
শনিবার

মহাশোকের মাস আগস্ট। আমাদের চেতনাকে ছিন্ন করার মাস আগস্ট। আমাদের বোধকে ভিন্ন করার দিন ১৫ই আগস্ট। আর সাল হিশেবে ১৯৭৫ এক চরম দুর্যোগের, এক অভাবনীয় আত্মবিস্মৃতির কাল। বাঙালি সত্তার মধ্য থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ নিয়ে এক ছিনিমিনি খেলার ক্ষণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভার্চ্যুয়ালি জুম এ্যাপসের মাধ্যমে মাসব্যাপী স্মরণ-অনুষ্ঠানের আয়োজন ক'রেছে 'আবৃত্তিকার'। ১লা আগস্ট প্রথম প্রহরে অর্থাৎ মধ্যরাত পার ক'রে ১২টা ১ মিনিটে কবি নির্মলেন্দু গুণের সূচনা-বক্তব্য ও কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্মৃতিচারণ করেন অভিনয়শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম, বক্তব্য রাখেন নাট্যব্যক্তিত্ব ম হামিদ, বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গীকৃত কবিতাপাঠ করেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আবৃত্তিতে অংশ নেন আবৃত্তিজন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিজন ডালিয়া আহমেদ। বিশ্বব্যাপী তথা বাংলাদেশে করোনার ভয়াল প্রকোপ আমাদের সকল স্থিরবিন্দুকে মূল থেকে প্রায় উপড়ে ফেলেছে। জীবনযাত্রার চিত্রটিও স্থবির কিংবা ভিন্ন মাপে প্রতিভাত হ'চ্ছে।

আজ ঈদ-উল-আযহা। কুরবানির ঈদ। ঢাকাসহ বাংলাদেশের এবারের ঈদের রূপটি একদম ভিন্ন। পোশাক-মশলা থেকে সৌখিন কেনাকাটার কথা বাদ দিলেও মুসলমানদের জন্য কুরবানির পশুক্রয়কে তো আর হেলাফেলায় বাদ দেয়া যায় না। সেখানেও যোগ হ'য়েছে নতুন মাত্রা, কর্মপদ্ধতিতে এসেছে সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
ঈদ নিয়ে ঘরের আয়োজন ব'লতে অতিথি আপ্যায়ন ও পরিজনসহ মধ্যাহ্নভোজ। কিন্তু এবারের দৃশ্যপটে তো অতিথি অনুপস্থিত। আবার পরিজনের সীমানাও পুত্র-কন্যায় স্থির। তারপরও আরো এক মিলনরেখা তো পুত্রবধূ- জামাতাকে স্পর্শ ক'রে দৌহিত্র-দৌহিত্রী পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্চি-সাবাবা কানাডায়, বৃষ্টি মাথায় ক'রে সজীব এলো মগবাজার থেকে। কানাডায় গতকাল ঈদ-উৎসব পালিত হ'য়েছে। মা ও মেয়ে ছবি পাঠিয়েছে। আজ রাত ১২ টায় জিটিভি-তে সজীবের অনুষ্ঠান : 'গানওয়ালার আড্ডা'। অদ্রিকে নিয়ে তীর্থ-আদবানা যখন দরোজার ঘণ্টা বাজালো তখন খাবারটেবিল প্রস্তুত। আদবানার ব্যাগ থেকে টেবিলে নামলো টিকিয়া-কাবাব। যোরার পোলাও-মুরগি-গোরু-ডিমের সঙ্গে রসনা তুষ্টির আরেক নতুন উপকরণ। টমেটো-শশা-পেঁয়াজ-কাঁচালংকায় যা-ও বা চাওয়া-চাওয়ি, সেমাই-মিষ্টি যে চোখ এড়িয়ে গেলো। বেলা ঢ'লে প'ড়তে ইয়ার্দিন-ইয়াভিনের সাড়া মিললো, পেছনে মা-বাবা অর্থী ও সনি। খুব ছোটো, তা-ও অসম্পূর্ণ বৃত্তটি নিয়ে ঈদ-উদযাপনের মধ্যে কোথায় যেন একটা কাঁটা কেন্দ্রকে বারবার ঘেঁটে দিচ্ছিলো।

০৫.৮.২০২০
বুধবার

বাংলাদেশের বর্ষার তোড় বসতি যেন বন্যাকে উস্কে দেয়। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের দাপটে প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল। ফসল ও গবাদিপশুর বিনষ্টির পাশাপাশি জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্গতি। এ বছরের বন্যায় উত্তরাঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান সব ধারণাকে অতিক্রম ক'রে গেছে। করোনা মহামারির সায় পেয়ে যেন মৃতের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা লড়াই ক'রতে জানি, এ কথা হাজারবার সত্য। তবে তারও তো একটি দিকনিশানা আছে!
ভেতর-দহনের মধ্যেই শরীর ভার হ'চ্ছে, চোখে ক্লান্তি আসে সামান্য মনোযোগী পাঠে আর খাদ্যাভাসের পরিবর্তনে দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা। দহনের আশেপাশে চিৎকাৎ পড়ে থাকে স্বার্থভষ্ম, দ্বন্দ্বক্ষত ও শ্রীকাতর অভিঘাত। ভারদেহ তাই শরীর বহনেই বিধ্বস্ত, মন খোলার অবকাশ তার কোথায়! চোখের জ্বালা অনেকদিনের। চিকিৎসার ফলাফল যেন কোনোমতেই মেলার নয়। আশাহীন না হ'য়েও মাঝে-মাঝে দৃষ্টিশূন্যতায় অবসন্ন হই। খাদ্যতালিকার পরিবর্তনে রক্তের চিনি সামাল দেয়া কষ্টকর পর্যায়ে চ'লে গেছে। ইনস্যুলিনের মাত্রা নিয়ে হিমসিম খেতে-খেতে আরেক উপদ্রুব রক্তচাপ বাঁধ মানছে না।
এ তামাশারাজির মধেই 'নীরদ সি চৌধুরীর মন-ইসলাম, সাম্রাজ্য ও হারানোর বেদনা' ইয়ান অ্যালমন্ডের কলমে আড়মোড়া ভাঙছে। ভাঙার অংশগুলো জোড়া লাগালে মানসপটে ফুটে ওঠে এক বিস্তৃত চিত্র। যেখানে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান স্কন্ধ দুটি একেবারেই অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া। ১৯৩২ সালে পূর্ববঙ্গের দাঙ্গার বর্ণনায় যেমনটি মেলে-"এই সবই একটি দীর্ঘস্থায়ী ও দেশব্যাপী সহিংসতার সৃষ্টি করে যা কিনা দেশভাগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ঢাকায় যখন মুসলমানরা যেখানেই পেত সেখানেই হিন্দুদের ছুরি মারত, হিন্দু ছেলেরাও, এমনকি পনেরো বছরের স্কুলছাত্ররাও হঠাৎ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে মুসলমান খুন করার কাহিনি উপভোগ করতে করতে রাতের খাবার খেত। সবার আচরণ ছিল যেন তারা নেকড়ে-মানব।" (নীরদ সি চৌধুরী, দ্য কন্টিনেন্ট অব সার্সে : অ্যান এসে অন দ্য পিপলস অব ইন্ডিয়া – জাইকো ২০০১, পৃ.২৮২)।

চৌধুরীর লেখা পাঠ কিংবা তাঁর উপর যাবতীয় রচনা যোগ ও বিয়োগের অন্তরালে এক গুণ-ভাগের জন্ম দেয়।
কৃক্ষভাবনা দিয়ে যে যাত্রা তা তো 'দাও বৃক্ষ দাও দিন'-এ এসে মোম গলাতে শুরু ক'রেছিলো। সেই যৌবনে দ্বিজেন শর্মা, মানে দ্বিজেন দা সুদূর মস্কো থেকে যে ঔৎসুক্য প্রকাশ ক'রেছিলেন তার রেশ আজো লেগে আছে' জমিনে ফারাক নেই'-তে। তিনি নেই, তবু তাঁর বৃক্ষেরা বলে 'জল দাও আমার শিকড়ে'। বাগান করার মতো আমার কোনো ভূমি নেই। তবে টবে মাটি রেখে সাধ পূরণ তো করা যেতেই পারে। ফুলের সৌরভের সঙ্গে ফলও মিলেমিশে বাড়ির ছাদকে ক'রে তোলে অতি মনোহর। বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হ'য়ে কাণ্ড আড়মোড়া ভাঙে, পাতারা ডাক দেয়- আয়!
গাছ এবং মাছ নিয়ে টইটম্বুর বর্ষাকাল যে আমাদের ভালোবাসার দিন ও রাত্রি।
"নারী ও পুরুষ যেন ভাদ্রমাসে পদ্মার ইলিশ/
ঝাল-ঝোল উপচে পড়া আমিষ ও সব্জির মিলমিশ।"


২৬.০৯.২০২০
শনিবার

২০০ বছর পূর্ণ ক'রলেন মহামহিম ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। আমাদের বিদ্যাসাগর।
এক বহুমাত্রিক সৃজনপ্রতিভা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলাগদ্যের জনক, শিক্ষাসাধক, সাহিত্যিক, নারীহিতৈষী, সমাজসংস্কারক, সর্বোপরি বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানবপ্রেমী। 'বর্ণ পরিচয়' থেকে বাঙালি শিশুর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের যে মেলবন্ধন শুরু হয় তা তো একজীবনে শেষ হবার নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে যথার্থই ব'লেছেন : "তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে…তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড় ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।"
'বিদ্যাসাগর' শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম বছর পাঁচেক আগে। কবিতটি আমার 'যে শ্রেষ্ঠ একা' গ্রন্থে আছে। বিবেচনা করি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত বর্ষ পালনের মুহূর্তে কবিতাটি নিবেদন করা যায়।
"বিদ্যাসাগর
বৃক্ষটি তর্জমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে
কবি তাকে মাথায় নিলেন
মাটি সরিয়ে মূল থেকে শুরু ক'রলে
গাদাগাদি বালির মধ্যে ছিটেফোঁটা পলি
তাতেও লোহার খবরদারি
কাণ্ড স্পর্শ ক'রতেই ছেঁকে ধ'রলো লাল পিঁপড়ে
তুঁত ও মধুর দাতব্য-চিকিৎসা
ডালে গোত্রমতো ফুল
পাতায় কালো-আলো মেশামেশি
নেত্রপথে যতোদূর ফল, কর্ণে বাঁশি, দেশি
কবি কাঠপেন্সিলের জন্য অপেক্ষা ক'রছেন
তর্জমা শেষে বৃক্ষটি বিশ্রামে গেলে
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হ'লেন কবি"