আল্লাহ কাদেরকে ভালবাসেন

মোনেম অপু
Published : 6 August 2011, 04:38 AM
Updated : 6 August 2011, 04:38 AM
কোরানে ভালবাসা শব্দটি আল্লাহ নিজের বেলায় যেমন প্রয়োগ করেছেন, তেমনই অন্যদের বেলাতেও প্রয়োগ করেছেন। বিশ্বাসীরা আল্লাহকে ভালবাসে, বিশ্বাসীরা আল্লাহর ভালবাসায় অন্যকে দান করে, মানুষ সম্পদ ভালবাসে ইত্যাদি। কোরানের বেশ কিছু আয়াত আছে যেখানে 'ইন্নালাহা ইউহিব্বু …', যার অর্থ 'নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালবাসেন …', পদগুলো সহযোগে বাক্য আছে। এরকম আয়াতগুলো একত্র করলে আমরা, আল্লাহ কোন বৈশিষ্ট্যসমূহের অধিকারীদের ভালবাসেন, তা সম্বন্ধে একটি ধারণা পাবো। এরকম কিছু আয়াত বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করে নিচে উল্লেখ করা গেল।

১। তাওয়াবিন

তাওয়াবিন শব্দের অর্থ হলো 'যারা তওবা করে'। দুঃখিত হয়ে, অনুতপ্ত হয়ে মন্দ, ভুল, অত্যাচার, দুর্নীতির পথ পরিহার করা ও আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করাই হচ্ছে তওবা। মানুষের দায়িত্বভার বিশাল; দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ সর্বদাই দেখতে পান যে তিনি পদে পদে যথাযথভাবে দায়িত্বপালনে সর্বদাই ব্যর্থ হচ্ছেন। কাজেই সদা সর্বদা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও কাজে আরও যত্নবান হওয়ার চেষ্টা করা মানুষের অপরিত্যাজ্য কর্মে পরিণত হয়। যারা সর্বদা তওবা করে আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন। নিচের আয়াতে সেকথাই বলা হয়েছে।

"… নিশ্চয়ই যারা তাঁর প্রতি সর্বদা অনুতপ্তচিত্তে প্রত্যাবর্তন করে, আল্লাহ তাদের ভালবাসেন এবং তাদেরকে ভালবাসেন যারা নিজেদেরকে পরিচ্ছন্ন, পরিশুদ্ধ রাখে।" (কোরান ২:২২২)

এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা প্রত্যেকেই যেহেতু নিজের কাজকর্মে অনেক ত্রুটি করে থাকি, বা যেহেতু মানুষ মাত্রই ভুল করতে থাকে, তাই অন্যদের ভুলত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দরভাবে দেখাও আমাদের জন্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। আমরা অন্যদের বিচার যেভাবে করব, আমাদের বিচারও সেভাবে করা হবে।

২। মুতাতাহ্‌হিরিন

মুতাতাহ্‌হিরিন অর্থ হলো যারা পরিচ্ছন্ন বা পরিশুদ্ধ। সমাজের চাপে, লোকনিন্দার ভয়ে বা পুলিশের ভয়ে মানুষ অনেক সময় মন্দ কাজগুলো থেকে বিরত থাকে ঠিকই, কিন্তু মনকে বাসনার আতিশয্য থেকে মুক্ত করতে যত্নবান হয় না। এই পরিশুদ্ধির বিষয়টি প্রধানতঃ চিত্তশুদ্ধি: মনকে লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, পরের দোষ চর্চার ইচ্ছা সহ সব আবিলতা থেকে মুক্ত করা। অশোভন ও নিন্দনীয় কাজগুলো গোপনে না করাও পরিচ্ছন্নতার অংশ। আল্লাহ পরিচ্ছন্নতা বা পরিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য যারা তৎপর ও যত্নবান থাকে তাদেরকে ভালবাসেন। নিচের আয়াতে সেকথাই বলা হয়েছে।

"… এমন লোক আছে যারা নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে ভালবাসে—আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা নিজেদেরকে পরিচ্ছন্ন, পরিশুদ্ধ রাখে।" (কোরান ৯:১০৮)

৩। মুত্তাকিন

মুত্তাকিন অর্থ যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলেন। তাকওয়া অর্থ আল্লাহ সম্বন্ধে, নিজের কর্মাকর্ম সম্বন্ধে সাবধানতা, সচেতনতা, বিচারশীলতা, সতর্কতা, সজাগ-অবস্থা ইত্যাদি। মানুষের সামাজিক কর্মযজ্ঞের দিক থেকে ইসলামকে যদি ন্যায় বিচারের ধর্ম বলা হয়, তবে মনস্তাত্তিক দিক থেকে বা মনের অবস্থার দিক থেকে ইসলাম হচ্ছে তাকওয়ার ধর্ম। কোরানে তাকওয়া একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যারা মুত্তাকি আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যা কোরানের নিচের আয়াতে বলা হয়েছে।

"যে কেউ তার চুক্তি, অঙ্গিকার, প্রতিশ্রুতি পালন করে চলে এবং আল্লাহ ও চুক্তির বিষয়ে সতর্ক, সচেতন থাকে; তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ সচেতনদের (মুত্তাকিন) ভালবাসেন।" (কোরান ৩:৭৬)

চুক্তি ও তাকওয়া কোরানে জোড়া-শব্দ হিসেবে বহু স্থানে এসেছে। আল্লাহর সাথে চুক্তি, অঙ্গীকারের কথাই হোক বা মানুষের সাথে করা চুক্তি, অঙ্গিকার বা প্রতিশ্রুতির কথাই হোক, যেখানেই একথা সেখানেই তাকওয়া কথাটিকেও দেখা যায়। অর্থাৎ চুক্তি, অঙ্গিকার, শপথ, প্রতিশ্রুতির সাথে তাকওয়া অনুষঙ্গী হয়ে আছে সাড়া কোরান জুড়ে।

ইসলাম ধর্মের পুরো কাঠামোটিই প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের উপর। ব্যক্তির স্বাধীনতা সীমিত হয় স্বাধীনভাবে করা চুক্তির মাধ্যমে। আল্লাহর সাথে ব্যক্তি সচেতনভাবে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যমে। আপনি বিয়ে করবেন? সেখানে চুক্তি। আপনি রাষ্ট্রের নাগরিক? সেখানে চুক্তি। সরকারের সাথে রাষ্ট্রের তথা জনগণের চুক্তি। ব্যবসায় চুক্তি, অফিসে চুক্তি। আপনি বাসে চড়বেন, ট্রেনে চড়বেন বা বিমানে চড়বেন? টিকিটের অপর পাতায় নানা শর্তাবলী। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে চুক্তি। জাতিসংঘের টেবিলে টেবিলে চুক্তি।

আধুনিক জীবন সামাজিক চুক্তির জীবন। কোরানের এপ্রোচটিও আধুনিক। তাই যেখানে চুক্তি সেখানেই তাকওয়ার কথা।

৪। মুহসিনিন

এহসান শব্দ থেকে এসেছে মুহসিন শব্দটি। এহসান অর্থ এমন সামাজিক আচরণ যা সুন্দর, শুভ, কল্যাণকর বা মঙ্গলময়। এক কথায়, মমতাপূর্ণ আচরণ হলো এহসান। যিনি এহসান করেন তিনি মুহসিন; আর মুহসিনিন হলো মুহসিনের বহুবচন। আল্লাহ মুহসিনদের ভালবাসেন, যা তিনি কোরানের নিচের আয়াতগুলোতে বলেছেন।

"যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায়ই অন্যদের জন্য ব্যয় করে, যারা ক্রোধ সম্বরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল থাকে—নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর-কল্যাণের সাধকদের (মুহসিনিন) ভালবাসেন।" (কোরান ২:১৯৫)

"তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংস করো না; সুন্দর-কল্যাণের সাধনা কর—নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর-কল্যাণের সাধকদের (মুহসিনিন) ভালবাসেন।" (কোরান ২:১৯৫)

উপরের আয়াতগুলো থেকে স্পষ্টতই প্রতিভাত হচ্ছে যে, এহসান করার অর্থই হচ্ছে নিজের সামর্থ্য ও সম্পদ নিয়ে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসা, অন্যের প্রতি নমনীয় ও ক্ষমাশীল থাকা। এই হচ্ছে জীবনের পথ, ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষার পথ। এই একই বিষয়ে ইসলাম ধর্মে আর একটি শব্দ রয়েছে—তা হলো সাদাকাহ। এহসান শব্দের মধ্যে যেমন সুন্দরের ধারণা আছে, তেমনই আভিধানিক দিক থেকে সাদাকাহ শব্দের সাথে সম্পর্ক সত্যের।

অর্থাৎ মমতাপূর্ণ দানশীলতা ও ক্ষমাশীলতা একদিকে যেমন সুন্দর, অন্যদিকে তেমনই সত্য। অর্থাৎ এই দানশীলতা ও ক্ষমাশীলতাই টিকে থাকবে কালের অনন্ততার বিপরীতে সুন্দর হয়ে ও সত্য হয়ে। কোরানে আর যে শব্দটি একইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো যাকাহ। যাকাহ শব্দের মধ্যে আছে আত্মশুদ্ধির অভিধা, অর্থাৎ অন্যকে দাও এবং দিয়ে দিয়ে শুদ্ধ হও। মুসলিম তথা বিশ্বাসীর জীবনের ভিত্তির শুদ্ধতা, সত্যতা ও নান্দনিকতা হলো এই যাকাহ, সাদাকাহ ও এহসানের মধ্যে।

আমরা অনেকেই মনে করি, মন্দকে সমরূপ মন্দসহ সাক্ষাৎ করা বুঝি বৈধ। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। ভালসহ মন্দের, প্রেমসহ হিংসার, নম্রতাসহ কঠোরতার, সুবচনসহ মন্দভাষণের সম্মুখীন হওয়াও এহসান বা সুন্দর আচরণের অংশ। এটিই হলো ক্রুদ্ধ না হয়ে মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল থাকার প্রকাশ।

আল্লাহর সাথে যুক্ত থাক এবং অন্যকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে নিজের শক্তি-সম্পদ নিয়ে অগ্রসর হও—কোরানে এদুটি কথা যুগলভাবে বারবার এসেছে এবং একেই নির্ধারণ করা হয়েছে জীবনের সফলতার পথ হিসেবে। এটাই ধর্মের মূলকথা, আর সবই এর সম্প্রসারণ।