গোবিন্দচন্দ্র দেব: আমাদের প্রথম দার্শনিক

মোনেম অপু
Published : 10 August 2011, 12:03 PM
Updated : 10 August 2011, 12:03 PM

আবুল হাশিম ও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এর মতে, যথার্থ দর্শন অর্থই হলো জীবনদর্শন। আবার যে জীবনবোধ বা দর্শন জগতকে, মানব সমাজকে ও জীবনকে একত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না তাও মানুষের জন্য পরিপূর্ণ আদর্শ প্রসূ হয় না। আবুল হাশিম ও আজরফ দুজনই নিজেদেরকে নিয়োগ করেছিলেন কোরানের আলোকে নিজস্ব দর্শন রচনা ও বিশ্লেষণে। যদিও মুসলিমদের জন্য তারা দুজনই উপকারী দার্শনিক, তারপরও বলা যেতে পারে যে, সব ধর্মকে – এমনকি ঈশ্বর-নিরপেক্ষ কিন্তু প্রজ্ঞা সম্মতভাবে মানবতাবাদী বা অস্তিত্ববাদী দর্শনগুলোসহ – সমন্বিত করার পথটি তাঁদের কাছে হয় পরিষ্কার ছিল না, নয়তো সেদিকে খুব মনোযোগ দেননি।

অথচ কোরানে আমরা পাই একটি সমন্বয়বাদী আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। আল্লাহ নিজেই সেখানে প্রকাশ করেছেন ধর্মের ক্রমবিকাশের ইতিহাস। যারা কোরানকে বা নবীকে গ্রহণ করতে চায়নি তাদেরকে লক্ষ্য করে আবেদন করা হয়েছে শান্তির প্রতি, মানবিক মূল্যবোধগুলো লালনের উদ্দেশ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করার প্রতি এবং শান্তি ও ঐক্যকে বিনষ্ট না করার প্রতি আবেদন। দর্শনের আওতায় এমন একটি সমন্বয়ধর্মীতার সফল প্রয়াস যে বাঙালী দার্শনিকের মধ্যে বিদ্যমান তিনি গোবিন্দচন্দ্র দেব।

দর্শনের জগতে ভাববাদ ও বস্তুবাদ এর লড়াই নতুন নয়, অতি প্রাচীন। প্লেটো – যাকে বলা যায় সব সম্ভাব্য দর্শনের বীজ ধারণকারী দার্শনিক – থেকে শুরু করে দেকার্তে, কান্ট, হেগেল, লিবনিজ, ব্র্যাডলি, বার্কলি ইত্যাদি বড় বড় সব দার্শনিক ভাববাদী ধারার। একই সাথে গ্রীকদের আমল থেকেই আমরা দেখি নানা ধরণের বস্তুবাদীদেরকেও। ভাববাদীদের মূল দাবী, আমাদের সব অভিজ্ঞতাই চূড়ান্ত বিচারে মানসিক ক্রিয়াপরতা, বিষয়ীগত এবং স্থান-কালে বিস্তৃত ও বিন্যস্ত ধারণার সমবায়; স্থান, কাল, স্মৃতি সবই যেখানে মনে বিদ্যমান। বস্তুবাদীরা এ দাবীর বিরুদ্ধে কোন চূড়ান্ত মীমাংসা দিতে পারে নি।

কিন্তু বাস্তব জীবনের সাথে ভাববাদের রয়েছে বিস্তর সমস্যা। ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে এটি কোনভাবেই বাস্তবসম্মত করে তুলতে পারে না, বরং একধরনের প্রতীক বাদে পর্যবসিত করে। অন্যদিকে, বস্তুবাদ ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও সেখান থেকে সফলভাবে মানুষের চৈতন্যের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মূল্য, তাৎপর্য ইত্যাদির ব্যাখ্যা দিতে পারে না – শেষ বিচারে মানুষ হয়ে উঠে একটি অত্যুন্নত যন্ত্র বা প্রাণীতে, যেখানে শ্রেণী সংগ্রামই হয়ে উঠে চূড়ান্ত পথ, মূল্যবোধ হয় আপেক্ষিক, আপতিক ব্যাপার। দেব এখানে সমন্বয় খুঁজলেন।

দেব মনে করেন, ভাববাদী উগ্রতা ও বস্তুবাদী আত্যন্তিকতা উভয়ই মানুষের জীবনের জন্য কেবল নিষ্ফলই নয়, ক্ষতিকরও বটে। তাঁর মতে, এই দুইয়ের একটি যথার্থ সমন্বয়ই পারে আমাদেরকে মানব স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যেতে। তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যয়ী ছিলেন যে, সম্প্রত্যয়গত তথা ধারণার বিন্যাসগত দিক থেকে নিখুঁত হওয়া সত্ত্বেও কোন দার্শনিক সিস্টেম মানব কল্যাণে অবদান রাখতে ব্যর্থ হতে পারে। একারণে তাঁর দর্শনে একই সাথে আলোচিত হয়েছে দর্শনের মৌলিক বিষয়াবলী এবং জীবনে এদের প্রয়োগের সম্ভাবনা ও প্রভাব।

ভাববাদ ও বস্তুবাদের মাঝামাঝি দর্শনও আমরা কয়েকটি দেখেছি; যাদের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে অস্তিত্ববাদ ও অন্যটি বাস্তববাদ। অস্তিত্ববাদ মানুষের অস্তিত্ব ও তার জীবনকেই ধরা হলো প্রথম তল হিসেবে; বলা হলো অস্তিত্ব সারধর্মের অগ্রবর্তী। শেষে এটি পরিণত হলো এক ধরণের আত্মিকতায়। বাস্তবতা জ্ঞাতা-নিরপেক্ষ – এই দাবী নিয়ে এগুলো বাস্তববাদ। কিন্তু এটি কাণ্ডজ্ঞান সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছে, নতুন আর কী কথা। দার্শনিক বিচারের শুরুটাই হয় যে বিশ্বাসের যথার্থতা পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা থেকে, তা-ই প্রথমে ধরে নেয়া হলো নির্বিচারে। যতই দেখ আর যতই চিন্তা কর, চক্রের পরিধি ছিঁড়তে পারবে না – সংশয়বাদীদের এই শেষ কথার বিপরীতে দেব তাঁর নিজের সমন্বয়বাদী দর্শনের জন্য গ্রহণ করলেন মানুষের মরমী ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে বা স্বজ্ঞাকে।

দেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেছিলেন তাঁর 'প্রজ্ঞা, স্বজ্ঞা ও বাস্তবতা' বিষয়ক তাঁর থিসিস থেকে। যিনি যে বিষয়ে আগ্রহী তিনি সে বিষয়েই সাধারণত থিসিস রচনা করেন। প্রজ্ঞা আর বাস্তবতার মধ্যে যখন দফারফা হচ্ছে না – তখন দেব মাঝে নিলেন সজ্ঞাকে। সজ্ঞা হলো ইনটুইশন, যাকে কিছু দার্শনিক মনে করেন জ্ঞানের সর্বোচ্চ সূত্র। কার্ল জুঙ এর মতে, স্বজ্ঞা হচ্ছে অচেতন অবস্থার প্রত্যক্ষণ। একাডেমিক দিক থেকে এটি হলো চিন্তা, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ ও প্রজ্ঞার অবলম্বনগুলো ব্যতিরেকেই অর্জিত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা। ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সব প্রধান পুরুষেরা এই সূত্রেই জ্ঞান লাভ করেন। সমন্বয়বাদী দর্শন রচনার জন্য দেব তাই আশ্রয় নিলেন ধর্মের।

হাশিম বা আজরফের মত দেব-এরও বিশ্বাস ছিল যে, সার্থক দর্শন মানেই হলো জীবনদর্শন। তাঁর মতে বস্তুবাদ ও ভাববাদ দুটোই মানুষের যথার্থ কল্যাণ ও প্রগতির পথে সমভাবে অন্তরায়। তিনি খুঁজলেন এমন একটি সমন্বিত দর্শন যা একদিকে আমাদেরকে ভাববাদ থেকে বস্তুবাদে উপনীত করতে সক্ষম হবে এবং একই সাথে বিপরীতক্রমে বস্তুবাদ থেকে ভাববাদে উপনীত করতে পারবে। তাঁর সারা জীবনের সাধনা ছিল এই দর্শন তৈরি করা।

বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা তাঁর শতাধিক আর্টিক্যাল বাদেও তিনি নয়টি বই লিখেছেন। নীচে তাঁর বইগুলোর নাম বাংলা করে উল্লেখ করলাম; অধিকাংশই ইংরেজিতে লেখা ও তাই স্বাভাবিকভাবেই নামগুলোও ইংরেজিতে।

ভাববাদ ও প্রগতি (১৯৫২)
ভাববাদ: একটি নতুন সমর্থন ও একটি নতুন প্রয়োগ (১৯৫৮)
আমার জীবন দর্শন (১৯৬০)
সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা (১৯৬৩)
বিবেকানন্দের দর্শন ও ভবিষ্যতের মানুষ (১৯৬৩)
তত্ত্ববিদ্যাসার (১৯৬৬)
মানবতাবাদী বুদ্ধ (১৯৬৯)
প্রাচ্যের নীতিগর্ভ গল্প (১৯৮৪)
আমার মার্কিন অভিজ্ঞতা (১৯৯৩)

তিনি ভাববাদী দার্শনিক এবং প্রধানত অনুপ্রাণিত ছিলেন সক্রেটিস দ্বারা। তবে তাঁর রচিত সব গ্রন্থই এমন একটি দর্শনকে উপস্থাপন করেছে যা সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টীয় ও ইসলাম ধর্মের দর্শনসমূহের একটি সুসঙ্গত সমন্বয়। তাঁর দর্শনের কাঠামোটি গড়ে উঠেছে বেদ-উপনিষদ এর শিক্ষা, বিবেকানন্দের চিন্তা, বুদ্ধের অহিংসার বাণী, যিশুর প্রেমের বাণী এবং ইসলামের সাম্য, ন্যায় ও সদিচ্ছার বাণীর সমন্বয়কে ভিত্তি করে।

গোবিন্দচন্দ্র দেব এর দর্শন আমাদের জন্য একটি ঐক্য-বিধায়ক দর্শন, কারণ তাঁর দর্শন সকল ধর্মের নির্যাস বা মর্মবাণী। স্বাধীনতা, মানবতা, সাম্য, সুবিচার আর প্রেমের এই দর্শন প্রসারিত হোক দেশময় ও বিশ্বময়।

গোবিন্দচন্দ্র দেব এর জীবনী ও দর্শন নিয়ে বাংলাপেডিয়া'র আর্টিক্যাল।