কাক ও কোকিল

মোনেম অপু
Published : 27 August 2011, 03:47 PM
Updated : 27 August 2011, 03:47 PM

এটি কাকের রাজ্য – রাজ্যে কাকদের বসবাস। কাকরাই সংখ্যাগুরু আমজনতা – হাজারে হাজার, লাখে লাখ, বেশুমার। রাজ্যটিকে তুমি আবার কোকিলের রাজ্যও বলতে পার – কারণ এ রাজ্যের রাজা কোকিলেরা। এ রাজ্যে কোকিলেরা দেবতা, কাকেরা ভক্ত; কোকিলেরা গায়, কাকেরা শোনে; কোকিলেরা বসে ঝালর লাগানো সোনার সিংহাসনে, কাকেরা বসে মাটিতে। কাকেরা ঘুরে ঘুরে নাচে ও ভক্তি নিবেদন করে। কোকিলেরা সে ভক্তি গ্রহণ করে কাকদেরকে ধন্য করে।

কাকদের স্বভাব ছিল। এক কাক মরলে সব কাক উড়ে এসে জুড়ে বসতো। কাকে কাকে ছেয়ে যেত আকাশ। স্বভাব বদলেছে। রাজা কোকিলেরা কাকদের মনের ভেতরটাকে, মাথার ভেতরটাকে দেখতে পায়, বদলাতে পারে। কোকিলের এমনই নজর, এমনই সম্মোহনী শক্তি, এমনই যাদু। কাকরা টের পায় না। ভাবে – যা ভাবি সে তো আমারই ভাবনা, যা দেখি তা তো আমারই দেখা। কোকিলেরা খায়-দায় কাকেদের ক্ষেতে, ডিম পারে কাকেদের বাসায়। কোকিলদের ডিমে কাকেরা তা দেয়। শুধু কি তাই? কোকিলদের ভাবনামত ভাবেও বটে। আহা! ভাবুক কাকেরা!

বেশুমার কাকের রাজ্যে কাকের মরণে কী আসে যায়? ভাবনার দরকার কী? এ তো সহজ যুক্তির কথা। কাকেরা যুক্তিতে বাস্তববাদী। এ সোজা কথা বুঝতে কাকেদের এতদিন লেগে গেল! সেখানেই বুঝি তাদের দুঃখ। কাকেরা বুঝতে শিখেছে। তারা এখন নান্দনিকতার কদর বুঝে। কোকিলের কণ্ঠে কী সুরেলা গান! গানের কদর জেনেছে বলে কাকদের এখন গর্বের শেষ নেই। তাই কোকিল মরলে এখন আকাশের মেঘেরা ছেয়ে যায় কাকে। কাক মরলে আকাশে ভাসে শুধুই মেঘেরা।

মানুষের মধ্যে এমন অর্বাচীন আছে যে দুধ বেচে সুরা কিনে পান করে। কিন্তু কাকরা তেমন নয়। তারা নিজেদের ক্ষেতের শস্য কোকিলদের ভেট দেয় পূজার অর্ঘ হিসেবে, কেবল গান শোনার জন্য। তারা কাজ করে কোকিলের জন্য, বেঁচে থাকে কোকিলের গানের জন্য।

কাকেদের ভাষা আছে। ভাষার ব্যাকরণ আছে। ব্যাকরণের বই আছে। সে বইতে উপসর্গের তালিকা আছে। কোকিলদের জন্য তারা 'মহা' উপসর্গটি উৎসর্গ করেছে। নিজেদেরকে কাকেরা কাক বললে কী হবে, কোকিলদেরকে তারা সম্বোধন করে 'মহামহিম মহাকোকিল' বলে। আরও আছে প্রয়াণ বনাম মহাপ্রয়াণ, আগমন বনাম মহা-আগমন – আরও কতকী! কাকেরা এখন আর কাক নেই, তারা সুভাষী সভ্য হয়েছে।

বেপরোয়া মানুষেরা অতশত বুঝে না। না জানে কোকিলের মর্ম, না বুঝে কাকেদের দুঃখ। মরা তো মরাই – ভাবে মানুষ। তাই মরা কাক কি মরা কোকিল বাছ বিচার করে না তারা – ফেলে রাখে রাস্তার পাশে দুটোকেই একইভাবে। কিন্তু তা দেখে কাকদের কী দুঃখ – আহা, দেখ নিষ্ঠুর মানুষেরা কোকিলটিকে কাকদের মত করে ফেলে রেখেছে অবহেলায় রাস্তার পাশে। কাকেরা ভাবে, কবে যে বুঝবে ভোঁতা মনের মানুষেরা!