মোনেম অপু
Published : 11 Sept 2011, 09:57 AM
Updated : 11 Sept 2011, 09:57 AM

লালনের প্রশ্ন: খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়? যেন লালন খাঁচাটাকে ভালই চিনতেন! খাঁচা দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, তাই তাঁর নিকট পাখিটাই কেবল অচিন। কিন্তু এই 'দেখা'কে ও 'ছোঁয়া'কে ভাল করে ধরার চেষ্টা করলে তিনি হয়তো বলতেন: অচিন খাঁচায় অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এ প্রবাদটি যারা সাধারণত বলে থাকেন তারা 'বস্তু' বলতে ঈশ্বরকে বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু দার্শনিকেরা জানেন, কথাটি খোদ বস্তুর বেলাতেও সমভাবে প্রযোজ্য। বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস কর, বস্তু ধরা দেবে। প্রশ্ন কর আর প্রশ্নের উত্তর বুদ্ধি দিয়ে খুঁজতে বের হও – দেখবে বস্তু কিভাবে উধাও হয়।

জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো মানুষ তাই কোন না কোন বিশ্বাস অবলম্বন না করে কিছুতেই করতে সক্ষম হয় না। তাকে এটা অথবা ওটা – একটা কিছু বিশ্বাস করতেই হয়। 'টু বি অর নট টু বি' সংশয় নিয়ে বাস্তব জীবন চলে না। যারা জ্ঞানের ক্ষেত্রে সংশয় নিয়ে চলেন তারাও জেনে হোক অজান্তে হোক এ দল বা ও দলের বিশ্বাস মতই কাজ করে প্রাণ ও বংশ রক্ষা করে চলেন। আর যদি কোন সংশয়বাদী গলায় দেয়ার জন্য দড়ির খোঁজ করেনই, তাহলেও তাকে এ বিশ্বাসে উপনীত হতে হয় যে, জীবন অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন।

কিন্তু আমরা যারা সব কিছুতেই অতি নিশ্চিত ভাব নিয়ে চলি তারাও যে নিজেকে বোকা বানিয়েছি, যাকে বলে নিজেকে প্রতারিত করে বসে আছি, সে বিষয়ে দার্শনিকদের কোন সন্দেহ নেই; অন্তত বার্ট্রান্ড রাসেলের কথায় তাই বোঝা যায়। এই অতিনিশ্চয়তাবোধে ফাঁকিটা কোথায় তা বুঝার চেষ্টা থেকেই শুরু হয় প্রজ্ঞার পথে যাত্রা। কি গ্রীক-রোমান'রা, কি পার্সি-ভারতীয়-চীনা'রা – সব দার্শনিকের মুখে এই একই কথা। গায্‌যালী বা ডেকার্টের দর্শন তো শুরুই হয়েছে সংশয় থেকে।

জগতে বস্তু আছে, প্রাণীরা আছে আর আছে মানুষেরা। এখানে নেতিবাচক ধারণা আছে কেবল মানুষের চিন্তায়। বস্তুকে তো আমরা মনে করি চিন্তাবর্জিত। প্রাণীরা অভিজ্ঞতায় সাড়া দেয়; বন্ধু দেখলে কাছে যায় নয়তো নিরুদ্বিগ্ন বেখেয়াল নিয়ে থাকে; আর শত্রু দেখলে তেড়ে আসে নয়তো পালায়। কিন্তু এখানেও নেতিবাচক ধারণার কোন অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না; যা কিছু করা হয় ইতিবাচকভাবে, ইনস্টিংক্ট অনুসারে।

মানুষের চিন্তায় আছে সব নেতিবাচক ধারণা, যেমন: মিথ্যা, অন্ধকার, মন্দ, অনুচিত ইত্যাদি। কাজেই মানুষের সামনে সমস্যা বেশী। তাকে ভাবতে হয় ও বাছাই করতে হয়। আর এখানেই চলে আসে বিশ্বাস ও নীতির প্রশ্ন। এই বিশ্বাস ও নীতিই হলো মানুষের ধর্ম বা আদর্শ। এ-ই তাকে গড়ে তোলে ও এরই উপর ভিত্তি করে তৈরি করার চেষ্টা করা হয় বিশ্বাস ও নীতির সাথে প্রতারণার পরিণাম।

মনে করা হয় যে, কিছু আপ্ত বাক্যে বিশ্বাস করি বলে মনে করা বা প্রকাশ করা, কিছু আচার-অনুষ্ঠানের আকারকে জীবনে অভিব্যক্ত করা, একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ঢং বজায় রাখা এবং তার জন্য সহায়ক দল বা সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকার নাম ধর্ম বা আদর্শ। মানুষ অন্তর্যামী নয় বলে মানুষের বিচারে আদর্শ বা ধর্ম বলে এটি পরিগণিত হতে পারে। শুধু তা-ই না, মানুষের বেলা এছাড়া গত্যন্তরও নেই।

কিন্তু আল্লাহ তো অন্তর্যামী। তাঁর বেলা তো একথা খাটে না। তিনি দেখেন অন্তর। অন্তরের দিকেই তিনি তাকিয়ে থাকেন। তাই আল্লাহয় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মের আসল খেলাটাই ওখানে। কোরানে বিচারের দিনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে লিখিত আছে যে, সেদিনটি হবে অন্তরকে উন্মোচিত করার দিন। যে বিশ্বাসী গাফেল থাকে, অসচেতন থাকে সে বিশ্বাস করেও নিজেকে জড় বস্তুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এখানে মানুষ নানবিধ তাড়নায় গড়াতে থাকে, যেভাবে বস্তু গড়ায় অভিকর্ষের টানে। যে বিশ্বাসী ইন্সটিংক্ট অনুসারে সাড়া দেয় বা প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত থেকে জীবন যাপন করে সে নিজেকে প্রাণীদের স্তরে নামিয়ে আনে।

আল্লাহয় বিশ্বাসীরা তো আল্লাহয় নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে। তারা কি তাহলে মতান্ধ ও অতিনিশ্চিতদের দলে পড়ে না? কোরানে বিশ্বাসীদের নিশ্চিত বিশ্বাসের প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু এটি বিশ্বাসীর নিজের সাথে নিজের সম্পর্কের বিষয় অথবা আল্লাহর সাথে বিশ্বাসীর সম্পর্কের বিষয়। যারা বিরোধী তাদের সাথে ব্যাপারটি অন্যরকম। এখানে অতিনিশ্চিত অহংকারী, মিথ্যাচারী ও ন্যায় ভঙ্গকারীর প্রকাশ ঢং থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা বিপরীত ভাবে কথা বলে বিশ্বাসীরা।

বিশ্বাসী শুধু বলে: ভাই, অবস্থা সঙ্গিন – আমারও তোমারও। চোখ দুটো অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখে না, বুদ্ধিটা শূন্যেই কেবল উড়ে বেড়ায়। বিশ্বাস না হয় তো তোমাদের সেরা সেরা সব দার্শনিক বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করে দেখ। আমরা জীবনের সার্থকতা ও সফলতা খুঁজছি। জীবনকে সুন্দর করে গড়তে চাচ্ছি। মুহম্মদকে আমরা সে পথেই মানুষকে ডাকতে শুনেছি। তিনি সত্যবাদী এবং শারীরিক, মানসিক ভাবে সুস্থ – এরকম মনে করার যথেষ্ট কারণ আমাদের কাছে আছে। তাই আমারা তাঁকে তাঁর কথায় বিশ্বাস করেছি।

চূড়ান্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা রয়েছে বিশ্বাসীর কথায় তা সম্বন্ধে সচেতনতা ও সতর্কতা থাকে এবং নিজ বিশ্বাসের ভিত্তিতে সে তাই আগ্রাসী হয় না। সে অপরের কাছে তার বিশ্বাসকে প্রকাশ করে ডিফেন্সিভ ও বিনয়ী মনোভাব নিয়ে। আর বিশ্বাসের যথার্থতাকে প্রকাশ করতে চায় স্বীয় জীবনের সৌন্দর্য দিয়ে: দুখানেই, আল্লাহর কাছে ও বিরোধীদের কাছে।

জীবন একটি সমগ্র। চিন্তা, কথা, বিশ্বাস তার অংশ মাত্র। শুধু চিন্তার মাত্রা, কথার সৌকর্য বা বিশ্বাসের যুক্তিসিদ্ধতা বা এসবের বুদ্ধিগত বা বাচনিক মালিকানার চেয়ে বাস্তব জীবন বেশী গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের মাপ হচ্ছে কর্মপ্রয়াসের উদ্দেশ্যের ভাল-মন্দ দিয়ে, কর্মের শুভ-অশুভ দিয়ে। ভাল-মন্দের মাপ হচ্ছে প্রধানত অন্যের সাথে সম্পর্কের ধরণের ভিত্তিতে – এ সম্পর্ক নিজের সুখের মতলবে, না-কি অন্যের জন্য মমতার প্রকাশে, অর্থাৎ অন্যকে শাসন-শোষণ করা, না-কি নিজেকে উৎসর্গ করা।

আল্লাহ মনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আল্লাহ কর্মের যুক্তি, আল্লাহ আশার ভিত্তি, আল্লাহতেই পরিণাম, আল্লাহতেই নির্ভরতা, আল্লাহই উদ্দেশ্য। এ-ই বিশ্বাসের ভূমি, জীবন সে ভূমির উপর বিকশিত হওয়া সুন্দর ও উপকারী মহীরুহ। আর বাকি যা থাকল তা যা তা তা-ই; আজ যা আছে কাল তা থাকবে না; আজ তার থাকা এবং আজ তার না থাকার মধ্যেও কোন ফারাক থাকবে না।

যদি আল্লাহ না-ও থাকেন (এ মতের অধিকারীদের কথা যদি মেনেও নেই) তবুও ক্ষতি কী? যেখানে আল্লাহ নেই সেখানে মিথ্যা আল্লাহতে বিশ্বাস করার পাপেরও কোন শাস্তি নেই। লাভের লাভ হলো সুন্দর একটি জীবনের পথ তো পাওয়া গেল। বস্তুর ভার, প্রাণের ভার থেকে মূল্যবোধের ভার অনেক ভাল।