কোরানে সামাজিক আচরণের সার্বজনীন বিধি

মোনেম অপু
Published : 3 Oct 2011, 03:41 PM
Updated : 3 Oct 2011, 03:41 PM

৪৯:১১। হে বিশ্বাসীগণ! কোন জাতি অন্য জাতিকে[১] উপহাস করবে না – এটি সম্ভব যে, তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম। নারীগণ অন্য নারীদের উপহাস করবে না – এটি সম্ভব যে, তারা উপহাসকারিণীদের চেয়ে উত্তম।[২] তোমরা পরস্পরের উপর দোষারোপ করবে না[৩], মন্দ নামে একে অপরকে সম্বোধন করবে না। বিশ্বাসীদের পক্ষে এরূপ দুরাচার নিজেদের জন্য সুনাম ক্ষুন্নকারী। যারা এ থেকে বিরত হতে অস্বীকৃত হবে তারাই অত্যাচারী।

৪৯: ১২। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সন্দেহ[৪] করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কতক সন্দেহ তো পাপ। তোমরা অন্যের গোপনীয় বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হবে না।[৫] এবং তোমরা কারও মন্দ বিষয় অন্যের নিকট প্রকাশ করবে না – তোমরা কি নিজের ভাইয়ের শবদেহ থেকে মাংস ভক্ষণ করবে? বস্তুতঃ এ তো তোমরা ঘৃণাই কর।[৬] আল্লাহ সম্বন্ধে সচেতন থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ মন্দ পরিহারকারী ও শুভ পথে অভিসারীদের গ্রহণ করেন এবং তিনি করুণাময়।

৪৯:১৩। হে মানবজাতি! বস্তুতঃ আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে এবং উন্মেষিত করেছি নানা জাতি ও গোত্র, যেন তোমরা পরস্পরকে বুঝতে প্রয়াসী হও। তোমাদের মধ্যে তারাই আল্লাহর বিবেচনায় মর্যাদার অধিকারী যারা সতর্ক ও সচেতন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে পরিজ্ঞাত ও সকল তথ্যের অধিকারী।[৭]
***

[১] এখানে 'কউম' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কউম অর্থ জাতি বা সম্প্রদায়। যেকোনো দল বা গ্রুপকেও এখানে কউম অর্থে নেয়া যায়। যেহেতু পরের বাক্যে নারীদের কথা বলা হয়েছে তাই অনেকে এখানে কউম অর্থে পুরুষদেরকে বুঝেছেন। তবে উপহাস কারার বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তি, বর্ণ, শ্রেণী, গোত্র, সম্প্রদায়, জাতি সকলের বেলাতেই প্রযোজ্য।

[২] এখানে উপহাসের নিষেধাজ্ঞার যুক্তি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, একজন কী করে অন্যজনকে উপহাস করতে পারে? যেখানে উপহাসকারী জানেই না যাকে উপহাস করা হচ্ছে সে না-কি উপহাসকারী নিজে – এদের মধ্যে কোন জন চূড়ান্ত বিচারে উত্তম বা সেরা বলে বিবেচিত হবে। কাউকে উপহাস করার অর্থই হলো নিজেকে তার চেয়ে ভাল বলে দাবী করা। একমাত্র অহংকারী ও মিথ্যাচারীর পক্ষেই এই দাবী করা সম্ভব। অন্যের প্রতি শত্রুতা বা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মানুষ উপহাস করার পথ বেছে নেয়। অন্যের প্রতি শত্রুতা বা বিদ্বেষভাব লালন করা একটি মানসিক বিকার ও অত্যাচার এবং এই মনোভাব মানুষকে বাচনিক ও কার্যতঃ অত্যাচারের পথে চালিত করে, শুধু সুযোগের অপেক্ষা মাত্র। এপ্রসঙ্গে কোরানের ৫:২ ও ৫:৮ আয়াতে বলা হয়েছে:

… তোমাদের প্রতি কোন সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সীমা লঙ্ঘনের দিকে চালিত না করে। … (৫:২) … তোমাদের প্রতি কোন সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায়ানুগ আচরণ থেকে বিচ্যুত না করে। … (৫:৮)

অন্যকে উপহাস করা একটি সীমা লঙ্ঘন মূলক ও অন্যায় আচরণ এবং বাচনিক নির্যাতন। তাছাড়া, কোন উপহাসকারী একথা বলতে পারবে না যে, ভবিষ্যতে অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যাবে না। মনে করুন, আমি আজ পরীক্ষায় ভাল করছি এবং একজনকে তার পরীক্ষায় ফেল করাকে পূঁজি করে উপহাস করছি। কিন্তু কে বলতে পারে, আগামী পরীক্ষায় আমি ফেল করবো না এবং সে ভাল ফল করবে না? আজ উপহাস করার মধ্য দিয়ে আমি ভবিষ্যতে নিজেকে নিজেই উপহাসাস্পদ করে তোলার সম্ভাবনাই তৈরি করছি। আর এরূপ সম্ভাবনা অস্বীকার করে কেবল মূর্খ, আত্মম্ভরি ও দুর্বিনীত জন।

[৩] কোরানে যে শব্দটির অর্থ এখানে 'দোষারোপ' নেয়া হয়েছে, সে শব্দটির অর্থ আরও ব্যাপক – অপদস্থ করা, অপমান করা – এসবও তার অর্থের অন্তর্গত। এখানে মূল আরবীতে এভাবে বলা হয়েছে – "তোমরা নিজেদের উপর দোষারোপ করো না"। তবে সবাই এর অর্থ বুঝেছেন 'একে অন্যের উপর দোষারোপ করো না' হিসেবে। একে অন্যের উপর দোষ আরোপ করাকেই আল্লাহ নিজেদের উপর দোষারোপ করা বুঝিয়েছেন। মনে করুন, একটি দেশ দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং অন্য দেশে গিয়ে উভয় অংশের লোকেরা অপর অংশের নানা দোষের কথা বলতে শুরু করলো। দোষের বিবরণ সত্য হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। একের কথা সত্য ও অন্যের কথা মিথ্যা – এমনটিও হতে পারে। কিন্তু অন্য দেশটি তো এর বিচার করতে যাবে না – সে তো দেখবে পুরো জাতির উপরই দোষ আরোপিত হয়েছে এবং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর তা আরোপ করেছে। একটি প্রজ্ঞাবান জাতি প্রথম জাতির এই প্রবণতাকেই দোষের বলে ভাববে – আর এতে করে পুরো জাতি নিজেকে কলঙ্কিত করবে মাত্র, নিজের সুনাম নিজেই নষ্ট করবে।

[৪] এখানে আরবিতে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে অনুমান করা, সন্দেহ করা, জল্পনা-কল্পনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত টানা। শত্রুর দোষের বিবরণ পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই চট করে বিশ্বাস করার প্রবণতা আমাদের একটি সহজাত প্রবণতা। এই প্রবণতার বশবর্তী না হওয়াও এই অনুজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। আবার বিষয়টি আরও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দোষ বিষয়ক কারও বিবরণের যথার্থতা পরীক্ষা করতে নামাও অন্যের দোষ অন্বেষণের নামান্তর – এটি এক রকম দোষারোপ প্রবণতা, যা পরিহার করতে আগের আয়াতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, এই অন্বেষণ এক ধরণের গোয়েন্দাগিরি মাত্র – যা পরিহার করার কথা পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে।

[৫] এখানে অন্যের প্রাইভেসিতে নাক গলাতে নিষেধ করা হচ্ছে। অন্যের গোপনীয় বিষয় জানতে আগ্রহী হওয়া ও তা জানার জন্য গোয়েন্দাগিরি করাও এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।

[৬] এখানে যা পরিহার করতে বলা হয়েছে তা আরবিতে বলা হয় গীবত। গীবত শব্দটির সাথে আমরা বাংলাভাষীরাও পরিচিত। এটিকে মৃত ভাইয়ের শব থেকে মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। গীবত করা বলতে মিথ্যা দোষারোপ করা বোঝায় না। একজনের বাস্তব দোষের কথা তার নজরে না এনে অন্যের কাছে প্রকাশ করাকে বুঝায়। এই দোষ-বিবরণ যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তবে তা আরও গুরুতর অপরাধ হয়ে থাকে, যার কথা আগের আয়াতে বলা হয়েছে।

[৭] এ আয়াতে মানব জাতির একত্বের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর বিষয়গত ভিত্তি হিসেবে আনা হয়েছে এক পরিবারের ধারণাকে বা বাস্তবতাকে। ব্যক্তিরা যেমন স্বতন্ত্র হয়েও এক মানব সমাজের অন্তর্ভুক্ত এবং এই অন্তর্ভুক্তির মধ্যে একটি ঐক্য নীতি বিদ্যমান, ঠিক তেমনই পরিবার, গোত্র, জাতি, ধর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে উঠা সকল সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্র্য স্বত্বেও তারা সকলে মিলে এক মানব জাতি। আমাদের সামাজিক সম্পর্কের অক্ষুণ্ণতা ও কর্মকাণ্ডে নৈতিক সফলতা আসে অন্যকে বুঝতে পারা ও সমঝোতার মাধ্যমে। কাজেই অন্য ব্যক্তিকে বুঝতে প্রয়াসী হওয়া এখানে আমাদের প্রথম কর্তব্য হয়ে পড়ে। ব্যক্তির গণ্ডি পেরিয়ে গোত্র ও জাতির ক্ষেত্রেও কর্তব্যটি একই – অর্থাৎ পরস্পরকে বুঝতে প্রয়াসী হওয়া।
***

কোরানের মাধ্যমে আল্লাহর এই শিক্ষার আর একটি সুন্দর প্রকাশ আমরা পাই নবী যীশুর কথায়। তিনি বলেছেন, "তোমরা অন্যের বিচার করো না।" অন্যের বিচার করার প্রবণতা পরিহার করতে পারলে আমরা উপহাস করা, দোষারোপ করা, গীবত করা ও অন্যের প্রাইভেসিতে হানা দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারব। যীশুর মাধ্যমে আল্লাহ যে কথাটি একটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, কোরানের মাধ্যমে আল্লাহ তারই বিশদ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।

এখানে আর একটি কথা বলে রাখা ভাল। উপরের শিক্ষার বাস্তবায়নক্ষেত্র সমাজ, আদালত নয়। আদালতে বিচারের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব বিচারকের। কিন্তু আমরা দৈনন্দিন সামাজিক কথাবার্তায় ও আচরণে সেরূপ বিচারকের ভূমিকায় নামতে পারি না। যে সমাজ এই দোষগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না, সে সমাজ ক্রমাগতভাবে বৈরিতা তৈরি করে চলে এবং অসুস্থ মনের মানুষের আড্ডায় নিজেকে পর্যবসিত করে। এবং এসব মানুষের ভিড় কোন মহৎ সংস্কৃতি নির্মাণ করতে পারে না।