কোরানে যুদ্ধের নীতিমালা – পর্ব ১

মোনেম অপু
Published : 27 Oct 2011, 07:03 AM
Updated : 27 Oct 2011, 07:03 AM

যুদ্ধ নতুন কোন সমস্যা নয়, প্রাচীন কাল থেকে মানুষ যুদ্ধ করে আসছে এবং এখনও করে চলেছে। যুদ্ধ প্রাকৃতিক নাকি মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ও বিচারের ভ্রান্তি থেকে উৎপন্ন তা চিন্তার বিষয়। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে যুদ্ধ প্রাকৃতিক আচরণের গণ্ডীর মধ্যেই বিদ্যমান। কিন্তু মানুষের বেলায় যুদ্ধ সংক্রান্তে কী বলা যায়? যদি মনে করা হয় যে, মানুষের ক্ষেত্রে বোধের ভ্রান্তির জন্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তবে নতুন প্রশ্নের অবতারণা হয়। একদলের ভ্রান্তির জন্য যুদ্ধের সূচনা হলে আক্রান্ত দলের করণীয় কী থাকে? তারা কি আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার অধিকার রাখে না? কেউ কি অত্যাচারীদের হাত থেকে নিপীড়িতজনদের উদ্ধার করার অধিকার রাখে না? মানবজাতির একাংশ কি নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে আক্রমণকারীদের বা অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিযুদ্ধে নামতে পারবে না? এপ্রশ্নগুলোর নেতিবাচক উত্তর যেমন আছে তেমনই আছে ইতিবাচক উত্তর। কিন্তু কেউই সম্ভবতঃ চিরকালের জন্য এবং সকল অবস্থার জন্যই নেতিবাচক উত্তর দেবেন বলে মনে হয় না।

একটি ধর্ম, একটি প্রাকৃতিক ধর্ম এবং একটি সম্পূর্ণ ধর্মের অনুসারী হিসেবে মুসলিমদের নিকট সমস্যাটি সবসময়ই চিন্তার বিষয় হয়ে ছিল। ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর আর দুটো প্রধান ধর্মের একটি বৌদ্ধধর্ম ও অন্যটি খৃষ্টধর্ম। আমরা প্রথমে এই দুই ধর্মের শিক্ষা ও অনুসারীদের কথা প্রথমে আলোচনা করতে চাই।

বৌদ্ধধর্ম

অহিংসা হচ্ছে বৌদ্ধধর্মে চিন্তা ও আচরণের মূলকথা। বৌদ্ধজন কর্তৃক অনুসৃতব্য এই ধর্মের পাঁচ মূলনীতির প্রথমটিতে নিঃশর্তভাবে বলা হয়েছে প্রাণ হত্যা বা যেকোনো প্রাণীকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে। যুদ্ধের ইচ্ছা পরিহার করা এই ধর্মের অনুজ্ঞা। অন্তঃসারের দিক থেকে বৌদ্ধধর্ম একটি শান্তির ঐতিহ্য। বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থগুলোতে এমন কোন শিক্ষা নেই যা বিরোধ নিষ্পত্তিতে হিংসা প্রয়োগকে সমর্থন করে।

দালাই লামার মতো বৌদ্ধ প্রাধিকারের কথা ও কাজ এই বলে যে, হিংসা দিয়ে হিংসাকে রুদ্ধ করা যায় না, যায় কেবল ভালবাসা দিয়ে – এটিই প্রাচীন সূত্র। অনেক বৌদ্ধই কোন অবস্থাতেই অস্ত্র হাতে নিতে রাজি নন, এমনকি এর ফলশ্রুতিতে যদি তারা সবাই নিহতও হন তবুও না। তাদের যুক্তি একসময় বৌদ্ধ বলে কেউ ছিল না, কিন্তু বৌদ্ধরা এসেছে; একইভাবে সব বৌদ্ধকে হত্যা করা হলেও অহিংসার ধর্ম ও বৌদ্ধরা আবার আসবে।

বৌদ্ধ ধর্মের এই দিকটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি সমস্যাই তৈরি করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এরূপ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবন ও সম্পদ বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করবে কিভাবে? এরূপ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনী থাকতে পারে কিনা বা থাকলে প্রতিরক্ষার বাস্তবসম্মত নীতিমালা কী হতে পারে? কিন্তু বৌদ্ধরা কি তাদের ধর্ম থেকে এবিষয়ে কোন পথ-নির্দেশনা লাভ করে? তবে বাস্তবতা হলো এই যে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য আছে যেসব রাষ্ট্রে সেসব রাষ্ট্রেরও প্রতিরক্ষা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা নীতি রয়েছে এবং মধ্যযুগে ও সমকালে বিভিন্ন সময়ে বৌদ্ধদেরকেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম থেকেই আবার যুদ্ধকে যুক্তিসিদ্ধও করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইহুদি ও হিন্দু ধর্ম মূলত অহিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত, তবে কোন কোন হিংসাত্মক কাজের (যেমন চুরি, হত্যা ইত্যাদি) জন্য – যা মানুষের জীবন ও সম্পদের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে – এ ধর্ম দুটোতে স্পষ্ট দণ্ডবিধি রয়েছে। সেইসাথে যুদ্ধের নীতিমালাসহ তার অনুমোদনও রয়েছে এ ধর্ম দুটোয়।

খৃষ্টধর্ম

খৃষ্টধর্ম মমতা, ভালবাসা ও প্রেমের জন্য খ্যাত হয়ে আছে। শত্রুকে ভালবাসা, এক গালে চড় দিলে অন্য গাল পেতে দেয়ার মতো শিক্ষা আমরা খৃষ্টধর্মে পেয়ে থাকি। এরূপ পরম মমতার ধর্মে যুদ্ধকে দেখা হয়েছে জীবনকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার ব্যর্থতার ফল হিসেবে। এবিষয়ে বৌদ্ধ ধর্মমতের সাথে খৃষ্টধর্মমতের অন্তঃসারগত কোন ফারাক নেই। আদি খৃষ্টানদের অনেকেই যুদ্ধ করতে, এমনকি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করতে নারাজ ছিলেন। তবে সকলেই এপথে অটুট থাকেনি। পরবর্তীতে রাষ্ট্রের অধিকারীরা যখন খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করে বা খৃষ্টানরা যখন রাষ্ট্রের অধিকারী হয় তখন এসমস্যার একটি সুরাহা তাদের করতে হয়েছে।

ক্যাথলিক চার্চ যুদ্ধকে ধর্মের আওতায় অনুমোদন দেয়ার জন্য Just War Doctrine প্রবর্তন করে। এখানে তারা কোন ধরণের যুদ্ধ ধর্মতঃ বৈধ তার ব্যাখ্যা দেন, যাকে jus ad bellum (law or justice to war) বলা হয়েছে। তাছাড়া এরূপ যুদ্ধক্ষেত্রে বাহিনীর আচরণের নিয়মাবলী, বিশেষত সংযমের বিবরণ ও আঘাতের সীমারেখা তারা ঠিক করেছেন, যাকে jus in bello (law or justice in war) বলা হয়েছে। অর্থাৎ কখন যুদ্ধ বৈধ হয়, বৈধ বা আবশ্যক যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য বা বিচার নিয়ে jus ad bellum অংশটি গঠিত এবং বাস্তব যুদ্ধে সংযম, শত্রুর পতি আচরণের নিয়ম, আক্রমণ ও আঘাতের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে বিচার ইত্যাদি নিয়ে jus in bello অংশ।

খৃষ্টান তত্ত্বে just war বা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধকে holy war বা পবিত্র যুদ্ধও বলা হয়ে থাকে। কাজেই যিশুর সরাসরি শিক্ষায় যাই থাকুক না কেন, পরবর্তীতে খৃষ্টান ধর্মাধিকারীরা যুদ্ধকে বৈধতা দিয়েছে, তার নীতিমালা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছে এবং প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করে যুদ্ধকে বিধিবদ্ধ করেছে।