কোরানে যুদ্ধের নীতিমালা – পর্ব ২

মোনেম অপু
Published : 29 Oct 2011, 03:58 PM
Updated : 29 Oct 2011, 03:58 PM

যুদ্ধ সংক্রান্ত মানবতাবাদী আইনগুলো এসেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে। সামরিক ব্যক্তিরাই এসব নীতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকায় ছিল। যুদ্ধে সংযম ও বিচারশীলতার নীতিমালা নির্ধারণ ও স্পষ্টীকরণই যুদ্ধসংক্রান্ত মানবতাবাদী আইনের লক্ষ্য। খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চীনের সান যু The Art of War বইটি লিখেন। সে বইতে তিনি শত্রুপক্ষের আহত সৈন্য ও যুদ্ধবন্দীদের প্রতি যত্নবান হওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করেন।

খৃষ্টীয় ৬৩৪ সালে খলিফা আবুবকর মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধের নিম্নবর্ণিত বিধিগুলো মুখস্থ করে নিতে বলেছিলেন।

"প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, সঠিক বা ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। তোমরা নিহত সৈন্যের অঙ্গহানি করবে না। শিশু, বয়স্কজন ও নারীদের হত্যা করবে না। খেজুর গাছ বা যেকোনো ফলবান গাছ কেটে ফেলবে না বা তাতে অগ্নিসংযোগ করবে না। কোন গৃহপালিত পশুর দলকে বা উটকে হত্যা করবে না – তোমাদের খাদ্যের জন্য প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা। তোমরা এমন স্থান দিয়ে যাচ্ছ যেখানে তোমাদের সাথে সংসার বিরাগী সাধুজনদের সাথে দেখা হবে, তাদেরকে তাদের কাজে নিয়োজিত থাকতে দেবে।"

আগের কালের বেশিরভাগ আইন বা বিধি-বিধান ছিল সেনাধ্যক্ষ বা রাজাদের আদেশাবলীর আকারে। কালের পরিক্রমায় সকল পক্ষই অনুরূপ আদেশাবলী জারী করায় যুদ্ধে সংযমের নিয়মগুলো সার্বজনীন হয়ে উঠে। তারপর ক্যাথলিক চার্চ লিখিতরূপে ও আরও বিস্তারিতভাবে যুদ্ধের নীতিমালা প্রস্তুত করে, যার কথা কোরানে যুদ্ধের নীতিমাল – পর্ব ১ এ বলা হয়েছে।

নেপোলিয়নের সময় ও ফরাসী বিপ্লবকালে সংযত বা সীমিত যুদ্ধের ধারণা বহুল পরিমাণে অপসৃত হয়। তখন থেকে জাতিগুলো সম্মিলিতভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সৈন্য ও সিভিলিয়ানের পার্থক্য অনেকটাই ঝাপসা হয়ে উঠে। তারপরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রচলিত jus in bello কিছু হলেও প্রতিপালিত হয়েছে। গণবাহিনী সঞ্চালনের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক বাহিনীর জন্য আরও সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

১৮৬২ সালে হেনরি ডুনান্ট যুদ্ধের ভয়াবহতার উপর তাঁর লেখা বই Memoir of Solferino প্রকাশ করেন। এতে তিনি যুদ্ধকালে মানবিক সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি রিলিফ এজেন্সি গঠন এবং এই এজেন্সির নিরপেক্ষতা মেনে নেয়া ও যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে নিরাপদে কাজ করতে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রসমুহের চুক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

অধ্যাপক ফ্রান্সিস লাইবার ১৮৬৩ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় Instructions for the Government of the Armies of the United States in the Field প্রণয়ন করেন। এটিই প্রথম পদ্ধতিগতভাবে সমৃদ্ধ যুদ্ধনীতি সংবিধিকরণ। এতে তিনি যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী যুদ্ধে করণীয় ও নিষিদ্ধ কাজগুলো উল্লেখ করেন। তিনি প্রতিটি আইনের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন তাঁর নির্দেশমালায়।

১৮৭৪ সালে ব্রাসেলস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা ১৮৯৯ ও ১৯০৭ সালের হেগ সনদ প্রণয়নের প্রাকপ্রস্তুতি স্বরূপ কাজ করেছে। কিন্তু হেগের সনদ বা বিধিমালা খুব স্পষ্ট ছিল বলা যায় না। ১৮৬৪ সালের প্রথম জেনেভা সনদ সত্যিকার অর্থে একটি বহুপাক্ষিক চুক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। জেনেভার আইনগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্য, চিকিৎসাকাজে নিয়োজিতগণ, রেড ক্রসের ইউনিট ও যানবাহনের নিরাপত্তা প্রদান করে। জেনেভার আইনসমূহ ১৮৯৯, ১৯০৬, ১৯২৯, ১৯৪৯ ও ১৯৭৭ এ পরিমার্জন করা হয় ও তাতে বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তার মত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়।

জেনেভা কনভেনশন বলতে চারটি চুক্তি (১৯৬৪, ১৯০৬, ১৯২৯ ও ১৯৪৯) ও অতিরিক্ত আরও তিনটি প্রটোকলের সমন্বয়কে বুঝায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে কনভেনশন বৈশ্বিক চুক্তি হয়ে ওঠে। সাধারণত প্রটোকলগুলোসহ সবকটি কনভেনশনের সম্পূর্ণ সেটকেই 'জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯' বা, আরও সংক্ষেপে, 'জেনেভা কনভেনশন' বলা হয়। বর্তমানে ১৯৪টি দেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে; তবে কোন কোন দেশ কিছু কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ স্বাক্ষর করেছে।

মানবজাতি দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পরে বাস্তব ধ্বংসের স্তূপের পটভূমিতে নিজেকে নগ্নভাবে দেখতে পায়। পশ্চিমের মানবতাবাদী দর্শনগুলো এবং চিন্তকেরা তখনই প্রথম যুদ্ধ থেকে কী করে বেরিয়ে আসা যায় তার উপায় অন্বেষণ করে আন্তরিকতার সাথে ও কার্যকর পন্থায়। জাতিসঙ্ঘের চার্টার, জেনেভা কনভেনশন তার মহৎ বাস্তবায়ন।

জেনেভা কনভেনশনের বিধিগুলো যুক্তিসংগত যুদ্ধের বা যুদ্ধে ব্যবহৃত শক্তির পরিমাণ ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছুই ব্যক্ত করে না। এটি যেকোনো কারণেই যুদ্ধ সংঘটিত হোক না কেন, যুদ্ধকালে আহত সৈন্য, যুদ্ধবন্দী, বেসামরিক লোকজন এবং চিকিৎসা ও ধর্মীয় কাজে নিয়োজিতজনদের নিরাপত্তা বিধান করে মাত্র। ইতোমধ্যে যুদ্ধের কৌশল ও ব্যবহৃত অস্ত্রের শক্তিমত্তায় অনেক পরিবর্তন সাধিত হলেও জেনেভা কনভেনশন এখনও যুদ্ধকালে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ভিত্তিভূমি হিসেবে এখনও বিবেচিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা আগামী পর্বে (শেষ পর্ব) দেখতে চেষ্টা করব কোরানের ও ইসলামের যুদ্ধ সংক্রান্ত নীতিমালা।