অনুশোচনা, উদ্বেগ ও আশা

মোনেম অপু
Published : 14 Nov 2011, 06:06 PM
Updated : 14 Nov 2011, 06:06 PM

অনুশোচনা, উদ্বেগ ও আশা মানুষের তিনটি মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া। মানুষের অস্তিত্বের সাথে এরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। যারা দরিদ্র তারা যেমন এ নিয়ে বাস করেন, তেমনই বিত্তবানেরাও এ থেকে মুক্ত নন। উদ্বেগ সম্পর্কিত হয়ে আছে ভবিষ্যতের সাথে, আর অনুশোচনার সম্পর্ক অতীতের সাথে। আহা! এমনটি করেই তো মরলাম; তেমনটি করলে তো বেঁচে যেতাম! বড় কিছু হারালে আমরা আক্ষেপ করি, অনুশোচনা করি। আগামীকাল কী হবে? ভবিষ্যতের ভাবনায়, দুশ্চিন্তায় আমরা অস্থির। কি জানি কী হয়!

তারপরও মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। আশাবাদ আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে নেই। এ বিশ্বাস হারানো পাপ। পণ্ডিতজনদের কাছ থেকে হামেশা আমরা এই আশার বাণী শুনে আসছি। এর যৌক্তিক ভিত কী তা আমরা জানি না; কিন্তু তারপরও আশা করতে আমরা পছন্দ করি, আশার ইচ্ছা আমরা পরিহার করি না, করতে চাইও না।

মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। বেঁচে থাকার ইচ্ছা মানুষের অদম্য। এটিই প্রজাতির চরমতম ইচ্ছা। আমরা এই ইচ্ছার কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করে রেখেছি। আশাবাদ সেই আদিম ইচ্ছার যুক্তি; অথবা বলা যায় আশার বাণী দিয়ে আমরা প্রজাতির ইচ্ছার কাছে আমাদের আত্মসমর্পণকে যুক্তিসিদ্ধ করেছি। মানুষ তো মানুষ, চিন্তা করতে পারে; তাই তার যুক্তি চাই, যুক্তির ইচ্ছাও সে পরিহার করে কী করে?

এই অনুশোচনা, উদ্বেগ ও আশার দুটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র আছে। একটি বস্তুর জগত, প্রাণের তাড়নার জগত। অন্যটি নৈতিকতার জগত। প্রথমটি বাসনার, স্বার্থপরতার জগত – এখানে নিজের সুখের জন্য বস্তু আহরণ ও সঞ্চয়ই লক্ষ্য ও তাতেই মোক্ষ; এখানে পার্থিব স্বার্থহানিতে অনুশোচনা, এর জন্যই উদ্বেগ, এর আশাতেই জীবনপাত। অন্যটি নৈতিকতার জগত – বস্তুর টানকে, প্রাণের টানকে অতিক্রম করেই যে জগতে উপনীত হওয়া যায়। এখানে পরার্থপরতাই ধর্ম, নিজের যা আছে তা অন্যের জন্য যত পারা যায় বিলিয়ে দেয়াই লক্ষ্য ও তাতেই মোক্ষ; এখানে দিতে না পারার জন্য অনুশোচনা, নৈতিক অধঃপতনের বিপরীতে উদ্বেগ, চিরকালের সাফল্যের আশায় জীবনপাত।

এই তিনটির মধ্যে অনুশোচনার আবার একটি বিশেষ প্রয়োগও আছে। আমরা যদি এমন কোন কাজ করে ফেলি মানুষের সামনে যা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় সমাজে মুখ দেখাতে পারি না, তার জন্যও তীব্র অনুশোচনা হয়ে থাকে। এটিকেও প্রজাতির ইচ্ছার মধ্যে ফেলে ব্যাখ্যা করা যায়। বেঁচে থাকার ইচ্ছা যেমন প্রজাতির ইচ্ছা, তেমনই লোকলজ্জাজাত এই অনুশোচনাও প্রজাতির অনুমোদন না পাওয়ার বা প্রজাতির নিন্দার প্রতিক্রিয়া।

আশারও আর একটি প্রয়োগ আছে। আমরা মানুষ কর্তৃক পুরস্কৃত হতে ভালবাসি। মানুষের অনুমোদন, বাহবা পেতে আমরা জীবনকে প্রাণান্ত করে তুলি। এতে সফলতার মাঝেই যেন জীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা। এটিও প্রজাতির অনুমোদন তথা ইচ্ছার নিকট নিজেকে সমর্পণ করার নির্দেশক। এভাবে শেষ বিচারে আমাদের অনুশোচনা, উদ্বেগ ও আশা প্রজাতির ইচ্ছাকে কেন্দ্র করে তার চারদিকে আবর্তিত হতে পারে সমস্ত জীবন ব্যাপী।

সর্বোপরি, প্রজাতির ইচ্ছা হচ্ছে বহু-আননা দেবী; আফ্রোদিতির মুখ এই দেবীর মধ্য আনন। আমরা আমাদের সৃষ্টিক্ষম প্রতিভার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সিংহতিসিংহভাগ নিবেদন করেছি আফ্রোদিতির মন্দিরে বিদ্যমান উৎসর্গের বেদীতে। আমাদের হাতে ফ্যারওয়ের যাদুর কাঠি, মুখে সাপ নাচানোর বীণ এবং আমরা ক্রমাগত তৈরি করে চলেছি এই বেদীতে আত্মাহুতি দেয়ার সত্তা।

ব্যক্তিমানুষ যতই রুটি খুঁজে বেড়াক, ঔষধ খুঁজে বেড়াক, বেঁচে থাকার জন্য যতই সংগ্রাম করুক না কেন, সে বেঁচে থাকতে পারবে না – তাকে মরতেই হবে। মানুষের অন্তরে, স্মৃতিতে একজন যতই বেঁচে থাকার চেষ্টা করুক, সে বেঁচে থাকতে পারবে না। এই বিশ্ব একদিন মনুষ্য প্রজাতিকে স্থান দিতে অস্বীকার করবে। প্রজাতির বিচারের সামর্থ্য, স্মৃতির সামর্থ্য ও রক্ষা করার ক্ষমতা কতই না সীমিত! প্রজাতির ইচ্ছার কাছে ব্যক্তির আত্মসমর্পণ এক অসহায়ের কাছে আরেক অসহায়ের করুণ আত্মসমর্পণ। বাঁশী বিলাপ করে করে হয়রান হোক, ভায়োলিন কেঁদে কেঁদে নিজেকে ছিন্ন করুক; তবুও এরা এ করুণদশার মাপ খুঁজে পাবে না।

ঈশ্বরের শাশ্বত বাণী: মানুষ কেবল রুটি খেয়ে বাঁচতে পারবে না, পারবে কেবল ঈশ্বরের মুখ থেকে নিঃসৃত কথার মাধ্যমে। (মথির গসপেল ৪:৪)

ঈশ্বর আরও বলেন: তোমরা উপাসনার জন্য দুই ঈশ্বরকে একত্রে গ্রহণ করো না। প্রকৃত ঈশ্বর তো কেবল তিনিই একজন। কাজেই কেবল আমার সম্বন্ধেই সর্বদা সচেতন থেকো। (কোরান ১৬:৫১)

এটাই যুক্তির পথ, এটাই আলোর পথ, এটাই জীবনের পথ; অন্যসব পথ কেবলই ভিতবর্জিত কল্পনার, কেবলই অন্ধকার – মরণেই যার সমাপ্তি। হে মন! নষ্ট হয়ে যাওয়া রুটির জন্য আর অনুশোচনা করো না, অনুশোচনা কর তা অন্যকে দিতে ব্যর্থ হবার জন্য। আমার সকল অনুশোচনা, সকল উদ্বেগ ও সকল আশা কেবল ঈশ্বরের জন্য হোক, প্রজাতির ইচ্ছার নয় বরং ঈশ্বরের কথার অনুবর্তী হোক – আমার জীবনে ক্রমে ক্রমে একথা সত্য হয়ে উঠুক:

আমার ভক্তি-যোগ, আমার উৎসর্জন-বিসর্জন, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক ঈশ্বরের জন্য নিবেদিত। (কোরান ৬:১৬২)