মোনেম অপু
Published : 26 Nov 2011, 05:29 PM
Updated : 26 Nov 2011, 05:29 PM

উদ্বেগ ও হতাশা থেকে মুক্ত এবং সুন্দর ও দৃঢ়তাপূর্ণ জীবনের জন্য জীবনে ভক্তির স্থান ও গুরুত্ব বিচার করে দেখা যেতে পারে। ঠিকভাবে তা চিহ্নিত ও নির্ধারিত করতে ব্যর্থ হলে ভক্তির কারণে জীবন আবার অসুন্দর, শৃঙ্খলবন্দী ও অবমাননাকর হয়ে উঠতে পারে। ভক্তি আমাদেরকে যেমন মুক্ত করতে পারে, তেমনই বন্দী করতেও তা সক্ষম। ভালবাসা থেকে যেমন অনেক সময় হত্যার ইচ্ছা উৎপন্ন হয়, তেমনই ভক্তি থেকেও হিংসার উৎপত্তি হতে পারে।

ভক্তি বলতে আমি ধর্মীয় ভক্তিভাবকেই কেবল বুঝচ্ছি না। প্রকৃতি, জীবন বা ঈশ্বর – এদের যে কোনটির প্রতি একটি ইতিবাচক আবেগাত্মক মনোভাবকে বুঝচ্ছি যা ব্যক্তিকে তার সামনে নিজেকে অবনমিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। গঠনমূলকভাবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে এরূপ মনোভাব বজায় রাখতে সক্ষম হওয়া আমাদের জন্য প্রথম প্রয়োজন। এরূপ মনোভাবের অভাব বা বিরাম জীবনকে বিরক্তিকর করে তোলে। আবার ভক্তিশূন্যতার মত অযৌক্তিক ভক্তি জীবনকে উন্নতির দিকে না নিয়ে অধঃপাতের দিকে, নিজেকে অবমাননা করার দিকে, নিজের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

১। বিস্ময়কর জগত

আমরা যে জগতে বাস করি তা বিস্ময়কর। বিস্ময় দুদিক থেকে আসে। একটি উৎস জগত বিন্যাসে ও তার প্রপঞ্চের নিয়ম, বিজ্ঞানীরা যাকে জগতের সাব-টেক্সট বলে থাকেন এবং পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান এই সাবটেক্সট উন্মোচনে নিয়োজিত থেকে একাজে বিপুল অগ্রগতি ইতোমধ্যেই অর্জন করেছে। বিস্ময়ের দ্বিতীয় উৎসটি হচ্ছে মানুষের নিকট প্রতীয়মান জগতের মধ্যে বিদ্যমান সৌন্দর্য। শিল্প-সাহিত্যসহ অন্যান্য নান্দনিক অনুভূতির চর্চাক্ষেত্রের প্রধান প্রধান মনীষা এর সুষমামণ্ডিত অভিব্যক্তি করেই চলেছেন তাদের শিল্পকর্ম ও লেখনীর মাধ্যমে।

২। বিস্ময়কর জীবন

আবার মানুষ নিজেও একটি বিস্ময়কর সত্ত্বা। মানুষের চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি, অনুভূতি, সৃজন ক্ষমতা, কর্ম ক্ষমতা সব মিলিয়ে এই মানব সত্তার বিশালতা, বিপুলতা সব কালেই দার্শনিক, কবি, চিত্রশিল্পীদের চিন্তা, কাব্য ও শিল্পকর্মের বিষয় বস্তু হয়ে ছিল ও আছে। এই বিশালতা ও সৌকর্যের বিবরণ ও চিত্রণে শিল্প জগত নিজেও বিশাল বিস্তার পেয়েছে।

৩। জীবনের মূল্য

মানুষ এটিও দেখছে যে, জগতে তার রয়েছে এক বিশিষ্ট স্থান। অনুপম চৈতন্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সে নিজেকে দেখে একটি অচেতন কিছুর উপরি-কাঠামোগত প্রকাশ বা উন্মেষ হিসেবে। ভিত্তির এই অচেতন অবস্থা মানুষের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে – তাহলে কি এটি কেবলই এক অন্ধ শক্তির উপরে ভেসে ওঠা ক্ষণিকের বুদ্বুদ? এর তাৎপর্য কী? এর মূল্য কী? নাকি তাৎপর্য ও মূল্যের অন্বেষণটাই অবান্তর? নাকি খোদ প্রশ্নগুলোই অবৈধ?

৪। ভক্তি ও জীবন যাপন

যদি জগতকে বাস্তব ও মানবজীবনকে ইতিবাচকভাবে যাপনের উপযুক্ত একটা কিছু হতে হয় তবে ভক্তি একটি আবশ্যকীয় বিষয়ে পরিণত হয়। ভক্তি করার মতো যদি কিছু না থাকে তবে মরে না গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করব কেন? এই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর বেছে নিলে – অর্থাৎ ভক্তিকে বাস্তব ভিতসহ বলে গ্রহণ করলে প্রশ্ন আসে: কার ভক্তি করব?

৫। ভক্তিশূন্যতা, মিথ্যা ভক্তি

জগত ও জীবনের পরিচয় থেকে উৎপন্ন হয় ভক্তি, মনের ভক্তিভাব। জগত ও জীবন যত নিখুঁতই হোক, যত বিরাটই হোক – এদের মধ্যে তাৎপর্য ও মূল্যের অভাব ঘটলে জীবনের মহিমা আবার সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে, ভক্তি মিথ্যা হয়ে ওঠে। ভক্তিশূন্যতা অথবা ভিত্তি বিবর্জিত ভক্তি মানুষের জীবন যাপনকে কেবল সুখভোগের একটি সুযোগ ছাড়া আর কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে? আর এই সুযোগ নিয়েই সন্তুষ্ট মানুষ কেবল বেঁচে থাকে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। এ হলো এরূপ চেতনার অধিকারী হয়েও কেবল জানা যাচ্ছে না বলে বাধ্য হয়ে নিছক প্রজাতির ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণ।

৬। প্রকৃতি-ভক্তি

আমরা প্রকৃতিকে বা প্রকৃতির অংশকে খণ্ডিতভাবে ভক্তির পাত্র সাব্যস্ত করতে পারি। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের জন্য এরূপ ভক্তি কতটুকু সম্মানজনক? অন্ধ, অজ্ঞান প্রকৃতির প্রতি ভক্তিতে প্রণত হওয়া এমন চৈতন্যসম্পন্ন ব্যক্তি সত্তার অবনমন ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রকৃতি-ভক্তি চৈতন্যকে জড়ের নীচে স্থান দেয়, প্রকৃতির উপর তার উচ্চ অবস্থানকে অস্বীকার করে। এটি একটি বিজ্ঞান ও যুক্তি বিরুদ্ধ সংস্কার। এটি বুঝার জন্য ঐতিহ্যের দাসত্ব করতে অস্বীকৃত স্বাধীন কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট, সুগভীর দার্শনিকতা বা পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না।

৭। জীবন-ভক্তি

স্বয়ং জীবনকেই বা প্রাণকেই আবার আমারা ভক্তির পাত্র হিসেবে দেখতে পারি। নিজের সত্তার প্রতি এই ভক্তি অবাস্তব ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত। যে আমি হটাত দেখি যে আমি আছি, আমাকে নিয়ে আমার কিছুই করার ছিল না যখন আমি ছিলাম না – সেই আমি আমাকে ভক্তি করব কিসের যুক্তিতে? এটিকে একটি স্বেচ্ছাচারীর অহংকারও বলা যায়। আবার এভাবেও পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। যারা সুখে আছেন, সম্পদে আছেন তাদের না হয় এই অহংকার থাকলই। কিন্তু যারা সুখী মানুষের সুখের সম্ভার উৎপাদন করতে গিয়ে ব্যবস্থার দাসে পরিণত হয়েছেন, তাদের জীবনের মূল্য কোথা থেকে আসবে?

৮। ঈশ্বর-ভক্তি

ঈশ্বর থাকুক আর না-ই থাকুক, যুক্তির বিচারে ঈশ্বরভক্তিই কেবল টিকে থাকতে পারে। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাদের কাছে ঈশ্বরই জগতের বাস্তবতার (reality), নৈতিক মূল্যবোধের যথার্থতার, জীবনের তাৎপর্য ও মূল্যের উৎস। জীবনের তাৎপর্য ও মূল্য কী? এ প্রশ্নের উত্তর ঈশ্বরভক্ত দিতে অক্ষম, তবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী এটুকু বুঝতে পারে যে, এই তাৎপর্য ও মূল্য যা-ই হোক তার বিদ্যমানতা অনিবার্য – যা ঈশ্বরের ধারণা থেকেই নিঃসৃত হয়।

৯। ভক্তি ও হিংসা

ভক্তি থেকে হিংসার উৎপত্তি হতে পারে। যারা ঈশ্বর ছাড়া অন্যকিছুকে – তা সে প্রকৃতিতে মূর্ত কিছু হোক বা মানুষের চিন্তায় বিদ্যমান বিমূর্ত কিছু হোক – ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের ভিত্‌তল (baseplane) হিসেবে দেখেন তারা সহজেই আপন-পর তৈরি করতে পারেন। হিংসার জন্য একটি ভেদ-ধারণা দরকার। কিন্তু এক ঈশ্বরে বিশ্বাসীদেরকেও আমরা দেখতে পাই হিংসাত্মক হয়ে উঠতে। এটির বেলায় তাদেরকে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, তোমরা তোমাদের নিজের নীতি থেকেই বিচ্যুত হয়েছ নিজের নীতিকে সঠিকভাবে অবধারণা করতে ব্যর্থ হবার কারণে। ঈশ্বর যদি এক হন, তবে জগত এক, জীবন এক, মানবজাতি এক।

১০। আবেগের কারাগার

ভক্তির অভাব মানব জীবনকে জীব স্তরের উপরে তুলতে পারে না। জীবন একটি নেতিবাচক ভার অথবা বাসনার তাড়নার ক্ষেত্র হতেই বাধ্য হয়। প্রথম অবস্থাটি একটি করুণ অবস্থা বা ট্র্যাজেডি, পরেরটি তমসাচ্ছন্নতা। মিথ্যা ও ভিতবর্জিত ভক্তিও মানুষকে ঠেলে দেয় সংস্কার, অসচেতনতার কারাগারে। খণ্ডিত ভক্তি মানুষের মধ্যে তৈরি করে বিভেদের দেয়াল, হিংসার সূতিকাগার। মিথ্যা ভক্তি ও হিংসা মানব মনের এমন কারাগার যা তা থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা ও শক্তিকেও এক সময় নিঃশেষিত করে দিতে পারে।