স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত বয়ান

মোনেম অপু
Published : 13 Jan 2012, 12:59 PM
Updated : 13 Jan 2012, 12:59 PM

স্বাধীনতা বিনে কে বাঁচিতে চায় হে। কিন্তু এ স্বাধীনতার অর্থ কী? শ্রেণীগত স্বাধীনতা? জাতিগত স্বাধীনতা? সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা? ব্যক্তি-স্বাধীনতা ছাড়া সকল স্বাধীনতাই আখেরে অফলপ্রসূ। আমরা যতদিন ভাবব যে, আমি বা আমরা প্রতিটি ব্যক্তি একটি শ্রেণী, সম্প্রদায়, দল, জাতি বা প্রজাতির সাংগঠনিক উপাদান মাত্র, ততদিন আমারা স্বাধীনতার সম্বিত থেকে বঞ্চিত থাকব।

বিষয়টি সহজে আমাদের বোধগম্য হয় না। হাতিরা দল বেঁধে থাকে, দল বেঁধে থাকে পিপড়ারাও। মানুষ সামাজিক জীব – একথা দিয়ে শুরু হয় সকল সমাজবিজ্ঞানের বই। সমাজ-বিচ্ছিন্ন সন্ন্যাসীদেরকে আমরা সাধারণত মডেল হিসেবে দেখিনা। তাহলে ব্যক্তির স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায়? একটি শ্রেণী, সম্প্রদায়, দল বা জাতির পক্ষ নিয়ে তার স্বার্থে যা ইচ্ছা তা-ই করার বা যা ইচ্ছা তা-ই বলার স্বাধীনতা? অথবা, শ্রেণী, সমাজ, ধর্ম, জাতি বা রাষ্ট্রের সেবাদাস হবার স্বাধীনতা?

চিন্তাশীলতা ছাড়া স্বাধীনতা হয় না। দেকার্ত বলেছিলেন, "আই থিংক, দেয়ারফর আই এম।" বিদ্যমানতার নিশ্চয়তায় তিনি পৌঁছেছিলেন এই 'কোজিটো'-এর মাধ্যমে। কিন্তু এই 'কোজিটো'-এর ভিন্ন একটি তাৎপর্যও রয়েছে। আমি চিন্তায় যতটা নিজস্ব, আমি অস্তিত্বে ততটা স্বাধীন। জাতি বা প্রজাতির সুরে গান গেয়ে মানুষ কোরাস শিল্পী হয়, স্বাধীন মানুষ তথা ব্যক্তি হয় না।

আত্মমর্যাদাবোধ নিজেকে প্রকৃতি, বীর বা জাতির অধীন করে তোলা থেকে বিরত রাখে। আদমের পাপের কারণে আদমের সব সন্তান সমভাবে পাপী হয় না; কিন্তু আদমের মর্যাদার কারণে আদমের সব সন্তান সমভাবে মর্যাদাবান হয়। পাপ উত্তর-ভার নয়, কিন্তু মর্যাদা উত্তরাধিকার। আত্মমর্যাদাবোধ ও অহংকার এক নয়। আত্মমর্যাদাবোধ নিজেকে অন্যের সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে; অহংকার অন্যের সমমর্যাদাকে অস্বীকার করে। অহংকার একটি দায়িত্বহীনতা।

আত্মমর্যাদাবোধ ছাড়া আত্মনির্ভরশীলতা হয় না; আত্মনির্ভরশীলতা ছাড়া স্বাধীনতা হয় না। দায়িত্বশীলতা ছাড়াও স্বাধীনতা হয়না। আমি যতখানি আত্মনির্ভরশীল, আমি ততখানিই স্বাধীন। আমি যতখানি দায়িত্বশীল, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা থেকে ততখানি বিরত।

দাসত্ব হলো প্রধানত একটি মানসিক অবস্থা। নিজেকে অন্যের চেয়ে হীন ভেবে নেয়া থেকে দাসত্বের শুরু। আমরা নিজেরা স্বেচ্ছায় নিজেদের প্রভুদের বেছে নেই এবং তারপর তাদের উপাসনায় নিয়োজিত হই। রুশো বলেছিলেন, "মানুষ জন্মায় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।" একথার উদ্ধৃতি যাদের মুখ থেকে শুনি, তাদের কণ্ঠেই আবার শুনতে হয় প্রকৃতি-বন্দনা, বীর-বন্দনা, জাতি-বন্দনা বা প্রজাতি-বন্দনার গীত। আসলে বিষয়টি মানুষ নয়, বিষয়টি ব্যক্তি। ব্যক্তি হচ্ছে জাতি, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি বা রাষ্ট্রের পূর্বগামী; ব্যক্তির উপরে কেউ নয় – কেবল ঈশ্বর ব্যতীত। ঈশ্বরকে সীমিত করা যায় না, ব্যক্তির সম্ভাবনাকেও তাই সীমিত করা যায় না।

পৃথিবীর অন্য সকল মানুষের ব্যর্থতা আমার জীবনকে ব্যর্থ করতে পারেনা। অনুরূপভাবে পৃথিবীর অন্য সকল মানুষের সাফল্য আমার জীবনকে সফল করে তুলতে পারবে না। আমি যদি আমার জীবনকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেই, তবে পৃথিবীর অন্য সকল মানুষ মিলে আমার জীবনকে সফল করে দিতে পারবে না। আমি যদি আমার জীবনকে সফল করতে চাই তবে পৃথিবীর অন্য সকলে মিলে আমার জীবনকে ব্যর্থ করতে পারবে না। এই বোধ ও বিশ্বাস ছাড়া স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জিত হয় না।

জন্মের পর মানুষ পরনির্ভরশীলতা থেকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু সে ক্রমাগতভাবে নিজেকে অধিক থেকে অধিকতর পরিমাণে স্বাধীন করে তুলতে পারে। এমনকি সে নিজেকে একটি দ্বীপের মত করে তুলতে পারে যেখানে সে সার্বভৌম একটি সম্পূর্ণ সংস্থা বা রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে। যে যতদূর পারে সে ততদূর স্বাধীন। যে যতটুকু স্বাধীন সে ততটুকু ব্যক্তি। এই স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে একটি মানসিক অবস্থা। অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশার অবলোপন থেকে এটি পাওয়া যায়।

অন্যেরা আমার জীবনকে সার্থক ও সফল করে দিক। আমি যা চাই অন্যেরা আমাকে তা সরবরাহ করুক। এটি একদিক থেকে জমিদারসুলভ মনোভাব, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এটিই চরম ভিক্ষাবৃত্তি। যে যতটুকু দাস সে ততটুকু ভিক্ষুক। ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করার অর্থ হচ্ছে নিজের সম্ভাবনাকে সীমায়িত না করা। ঈশ্বরের সাথে অন্যকে অংশীদার করা একটি সহজবোধ্য যৌক্তিক অসঙ্গতি। অন্যকে ঈশ্বরের স্থানে বসানোর অর্থ হচ্ছে নিজের মর্যাদা বিসর্জন দেয়া।