ঈশ্বরের নানা মডেল

মোনেম অপু
Published : 13 Feb 2012, 08:02 AM
Updated : 13 Feb 2012, 08:02 AM

জগত উন্মেষের একটি সর্বজন গৃহীত বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও এবং সে ব্যাখ্যাকে প্রয়োগ করে মানুষ নতুন জগত তৈরি করতে সক্ষম হলেও প্রশ্ন থেকে যাবে: যদি জগত নিয়মগুলোর পূর্বগামী হয় তবে জগত না থেকে আছে কেন? যদি নিয়মগুলো জগতের পূর্বগামী হয় তবে নিয়মগুলো না থেকে আছে কেন? পদার্থ বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলোর প্রকৃতি কী? জগতের সাথে এদের সম্পর্ক কী? নিয়মগুলো প্রকৃতির উপর অপারেট করে কিভাবে? ঈশ্বরের বেলাতেও অনুরূপ প্রশ্ন বিদ্যমান। ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে জগতের ব্যাখ্যা সম্ভব। আবার ব্যাখ্যার সম্ভবপরতাও ঈশ্বরকে বাতিল করে দেয় না। কিন্তু ঈশ্বরের মাধ্যমেই হোক বা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হোক – কোন দিক থেকেই জগতের উন্মেষ ও বিকাশ সংক্রান্তে চূড়ান্ত প্রশ্নগুলোর মীমাংসা কখনও সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে যা-ই বলা হোক তা অধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যার অংশ হয়ে উঠবে, পদার্থ বিজ্ঞানের নয়। এই প্রেক্ষাপটে, আমাদের নিকট জগত ও ঈশ্বর সম্বন্ধে যে কটি প্রধান প্রধান মডেল রয়েছে, নীচে চিত্রসহ সে মডেলগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া গেল।

১। বস্তুবাদ

১.১। এখানে ঘটনা ঘটে বস্তুর অন্তর্নিহিত ধর্ম অনুসারে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও অনিবার্যভাবে। কাজেই নিয়মগুলো বস্তুর রূপান্তরের নিয়মতান্ত্রিকতা থেকে মানুষের বুদ্ধির কাছে প্রকাশিত হয়। অথবা, মানুষ গণিতের মাধ্যমে এই নিয়মগুলোকে প্রকাশ করতে পারে। বস্তুকে ধরা হয় কাল তরঙ্গে শাশ্বত কিছু হিসেবে। এটি চিরায়ত বস্তুবাদী মত। নিজেকে রূপান্তরিত করার ক্ষমতাটি বস্তুর অন্তর্নিহিত এবং নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোর কোন সামর্থ্য বস্তুর নেই। অর্থাৎ একাধারে বস্তু অন্ধ শক্তি এবং স্বাধীনতাবর্জিত। পূর্বের ঘটনা পরের ঘটনার কারণ ও কর্তা। পরিপূর্ণ কার্য-কারণ তত্ত্ব বলতে যা বুঝায় এটি তা-ই। গাযযালি কার্য-কারণ তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীতে ডেভিড হিউম-ও গাযযালীর পথ অনুসরণ করেছিলেন।

২। নয়া পদার্থ বিজ্ঞান

২.১। এটিকে বলা যায় নতুন পদার্থ বিজ্ঞানের মডেল। এখানে ঘটনাগুলো ঘটে স্বকীয়ভাবে। পূর্বের ঘটনাকে পরের ঘটনার কারণ বা কর্তা হিসেবে দেখা হয় না। তবে ঘটনার পরম্পরায় সুনির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়ম অনুসৃত হয়। এই নিয়মগুলোই ঘটনার পরম্পরা সৃষ্টি করে। যেহেতু নিয়মগুলো অপরিবর্তনীয়, তাই জগত বিশৃঙ্খল নয়। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানে প্রাচীন কার্য-কারণ তত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়েছে। তার স্থানে আসীন হয়েছে পদার্থের গাণিতিক নিয়মাবলী বা প্রপঞ্চের ব্যাখ্যা। ঘটনার পরম্পরা সৃষ্টিতে এই নিয়ম বা ব্যাখ্যা অপারেটরের কাজ করে; অর্থাৎ তা সক্রিয়। অনেক বিজ্ঞানী তাই গণিত বা পদার্থ বিজ্ঞানকেই ঈশ্বর বলে মনে করেন।

২.২। ধারণা করা হয়, কোন প্রপঞ্চের কোন গাণিতিক ব্যাখ্যায় পাওয়া গেলে তা সৃষ্টির জন্য আর ঈশ্বরের প্রয়োজন হয় না। এভাবেই বিগ ব্যাং তত্ত্বে জগতের আবির্ভাবের জন্য এখন আর ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই বলে বলা হয়; কারণ কোয়ান্টাম ইফেক্ট বিগ ব্যাংয়ের ব্যাখ্যা বা গণিত। যেহেতু জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যা পাওয়া গেল, তাই বলা যায় যে, জগত ঈশ্বর সৃষ্টি করেনি। এ তত্ত্বে যা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে: এই নিয়মাবলী বা সূত্রাবলীর প্রকৃতি কি? এরা আসলো কোথা থেকে? এরা থাকে কোথায়? এরা প্রকৃতির উপর অপারেট করে কিভাবে? ইত্যাদি। এদের অস্তিত্বের প্রকৃতি ও অধিবাস অনেকটা প্লেটোর সার্বিকগুলোর প্রকৃতি ও অধিবাসের মত।

৩। কার্য-কারণগত ঈশ্বর

৩.১। এ মতবাদ বস্তুবাদের মতই, তবে এখানে ঈশ্বরকে দেখা হয় আদি কারণ বা প্রাথমিক গতিদানকারী হিসেবে। এখানে জগতের তুলনা করা যায় একটি ঘড়ির সাথে। ঈশ্বর ঘড়িটিতে দম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন এবং জগত এখন নিজে নিজে চলছে। এরিস্টটল বা নিউটনের ঈশ্বর সম্পর্কীয় ধারণা এরকমই ছিল। জগতের নিজস্ব একটি বাস্তবতা রয়েছে। এখন ঈশ্বর যদি জগত ধ্বংস করার আগে নিজেই লুপ্ত হন, তবে জগত কিন্তু থেকে যাবে।

৪। সর্বেশ্বরবাদ

৪.১। অনেক দার্শনিক মততন্ত্রে ও অনেক ধর্মে সর্বেশ্বরবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। শঙ্কর, স্পিনোজা, হেগেল, ইবনুল আরাবীর মত দার্শনিকরা যে তত্ত্বদর্শন (অনটলজি) অথবা বিশ্বতত্ত্ব (কসমলজি) প্রণয়ন করেছেন সেগুলো সর্বেশ্বরবাদের নানা ধরণের প্রকাশ। সত্তা একটিই – এবং সবকিছু সেই একই সত্তা অথবা সেই একই সত্তার প্রকৃতির স্বতঃ প্রকাশ বা অভিব্যক্তি। বলা হয়ে থাকে, ঈশ্বরই সব কিছু এবং সব কিছুই ঈশ্বর।

৪.২। জগত যেমন তার অস্তিত্বের জন্য ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল, ঈশ্বরও তেমনই তাঁর অস্তিত্বের জন্য জগতের উপর নির্ভরশীল। ঈশ্বর লুপ্ত হলে যেমন জগত লুপ্ত হবে, তেমনই জগত লুপ্ত হলে ঈশ্বরও লুপ্ত হবেন। এখানে ঈশ্বর জগতের অন্তর্বর্তী এবং ঈশ্বর ও জগতের মধ্যে আদতে কোন দ্বৈততা নেই। একে তাই অদ্বৈতবাদও বলা হয়। জগতকে ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে দেখা এখানে খুবই কষ্টকর। সব জগত সান্ত হতে পারে তবে জগত অনন্তভাবে পূনর্ভবিত হয়ে চলছে তা বলতেই হয়।

৪.৩। জগতে পরিলক্ষিত পরিবর্তন ও বহুর মধ্যে নিয়মানুগ সম্পর্ককে দেখা যেতে পারে মায়া হিসেবে; অথবা লোগোস-এর অনিবার্য অপারেশন হিসেবে – যেখানে লোগোস ঈশ্বরের সত্ত্বার 'অভ্যন্তরে' বা প্রকৃতিতে আবশ্যিকভাবে বিদ্যমান। ঈশ্বর, লোগোস ও জগত চূড়ান্ত বিচারে ভিন্ন নয় – সব মিলে এই ত্রৈয়ী একমাত্র পরম, অব্যয় ও সরলতম সত্তা।

৪.৪। মানুষ সত্তার দিক থেকেই ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব। এটি অনেক হিন্দু ঋষি, অনেক মুসলিম সুফি, লালন বা রবীন্দ্রনাথের মত মনীষীদের ধারণায় প্রধান স্থান অধিকার করে আছে। 'তত্ত্বমসি', 'আনাল হক', 'তোর মনের মাঝেই বাস করে পরম যে জন' ইত্যাদি কথার মূল দর্শন এখানেই নিহিত।

৪.৫। সর্বেশ্বরবাদে ঈশ্বরই লোগোস, ঈশ্বরই জগত, ঈশ্বরই মানব-অহং। তাই ঈশ্বর কোন না কোন ভাবে লোগোস, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়মাবলী, মানুষের চিন্তার ক্যাটাগরিসমূহ ইত্যাদির অধীন। কিন্তু সর্বধরেশ্বরবাদে এই সব অধীনতা থেকে ঈশ্বর মুক্ত। তিনি একাধারে জগত থেকে পৃথক, আবার একই সাথে জগত তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য ঈশ্বরের উপর পরমভাবে নির্ভরশীল।

৪.৬। সর্বেশ্বরবাদে অশুভের সমস্যা একটি বড় সমস্যা। জগতে পরিদৃশ্যমান অশুভও কি তাহলে ঈশ্বরের অভিব্যক্তি-স্বরূপ? ঈশ্বর নিজেই কি তাহলে শুভ ও অশুভ দুই-ই? নাকি অশুভের কোন অস্তিত্বই নেই? সবকিছুই যদি স্বয়ং ঈশ্বরের অনিবার্য অভিব্যক্তি হয় তবে মানুষের নৈতিক কর্মজাত অর্জন কার? অনৈতিক কর্মের দায়িত্ব কার? তাছাড়া উপাসনার অর্থইবা কী? ঈশ্বর কি নিজ কর্তৃক উপাসিত হন? মানুষ কি নিজেরই উপাসনা করে?

৪.৭। একজন সর্বেশ্বরবাদী মনে করতে পারেন যে, এক থেকে নিজেকে ও অন্যদেরকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন জ্ঞান করাই জীবনের ব্যর্থতা। তিনি জগত ও জীবনকে ঐশ্বরিক বলে জানেন। তিনি এমন একটি মানসিক অবস্থা বা দশায় উপনীত হতে চান যে অবস্থা বা দশায় সবকিছুকে এক হিসেবে দেখা যায়। এখানেই তিনি পেয়ে থাকেন আনন্দ ও সুখ, এবং জীবনের সার্থকতা।

৫। সর্বধরেশ্বরবাদ

৫.১। সর্বেশ্বরবাদে সবকিছুই ঈশ্বর হয়ে আছে, কিন্তু সর্বধরেশ্ববাদে সব কিছুই ঈশ্বর ধারণ করে আছেন। এখানে ঈশ্বরকে মনে করা হয় একমাত্র স্বনির্ভর সত্তা এবং অন্য সকল সত্তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে সার্বক্ষণিকভাবে ঈশ্বর-নির্ভর। প্রতিটি অণু-ঘটনা বা একক ঘটনা তার সংঘটনের জন্য ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী। তবে ঈশ্বর অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল বা মুখাপেক্ষী নন। ঈশ্বর লুপ্ত হলে জগত স্বয়ংক্রিয়ভাবে লুপ্ত হবে, কিন্তু জগত লুপ্ত হলেও ঈশ্বর লুপ্ত হচ্ছেন না। এখানে ঈশ্বর একই সাথে অতিবর্তী ও অন্তর্বর্তী। ঈশ্বর ও জগত এক নয়, জগতের স্বতন্ত্র বাস্তবতা রয়েছে, যদিও তা সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরনির্ভর।

৫.২। জগতের ঘটনাসমূহের ধারার মধ্যে যে নিয়মগুলো দৃশ্যমান সেগুলো সম্বন্ধে কী বলা যায়? এগুলি ঈশ্বরের নির্বাচন। এই নিয়মগুলো থাকে – কোরানের পরিভাষায় – 'লৌহেমাহফুজ' বা সংরক্ষিত ফলক বা প্রটেকটেড স্ক্রিপ্ট-এ। সংরক্ষণ দুদিক থেকে আসে। প্রথমতঃ এগুলি ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি, ঈশ্বর এ নিয়মগুলোর ব্যত্যয় ঘটান না, তিনি এগুলোকে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টির – না মানুষ, না জিন, না শয়তান – কারও পক্ষে তা করাপ্ট করা সম্ভব নয়।

৫.৩। ঈশ্বর কেবল জগত সৃষ্টির কর্তাই নন, তিনি জগতের সার্বক্ষণিক সাসটেইনেন্স বা ধারণ বা প্রতিপালনের কর্তাও বটে। অদ্বৈতবাদে জগতকে ঈশ্বরের চিন্তা হিসেবে সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু সর্বধরেশ্বরবাদ সেরকম অদ্বৈতবাদ নয়। এখানে ঈশ্বর ও জগতের মধ্যে দ্বৈততা রয়েছে। জগত ঈশ্বরের 'ভাব' বা 'চিন্তা' নয় ঈশ্বরের 'আদেশ'। এরূপ প্রকাশভঙ্গীর মধ্যে দ্বিত্বের দ্যোতনা রয়েছে। কোরানে 'চিন্তা'র বদলে 'আদেশ' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ও এতে দ্বৈততার ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়।

৫.৪। প্রতিটি অণু-ঘটনা, অণু-ঘটনার ধারার উপর ঐক্যের নীতিযুক্ত সত্তা (যেমন বস্তু, গাছ, বিড়াল, বিশেষ ব্যক্তি) এবং প্রাণ, চৈতন্য ইত্যাদি নানা উপরি স্তরের সত্তার উন্মেষ বা সংঘটন ও সংগঠন সবকিছুর কর্তা ও প্রতিপালক স্বয়ং ঈশ্বর। এভাবে সব কিছুই ঈশ্বরের 'আমর' (আদেশ) বা 'কুন' (হও) এবং সকলেই ঈশ্বরের উপর সমভাবে নির্ভরশীল। এটি এমন নয় যে, ঈশ্বর আম গাছ তৈরি করেন ও আমগাছ আম তৈরি করে; বরং আমগাছ ও আম উভয়েই সমভাবে ঈশ্বর-নির্ভর তাদের সৃজন ও অস্তিত্বের জন্য।

৫.৫। মানুষ সত্তাগতভাবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি নয়। মানুষ ঈশ্বরের জাগতিক প্রতিনিধি। শুধু তা-ই নয়, আরও সঠিকভাবে বললে: মানুষ জগতে ঈশ্বরের প্রতিপালন নীতির প্রতিনিধি। কোরানে প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত একটি আয়াতে বলা হয়েছে, "খেয়াল কর, যখন তোমাদের রব (প্রতিপালক) ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করব। …" (কোরান ২:৩০)। এখানে 'আল্লাহ' বলার বদলে 'রব' বলা হলো, তাছাড়া খলিফা শব্দের সাথে পৃথিবীর কথাও বলা হলো। অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর সত্তার প্রতিবিম্ব নয়, বরং জগত প্রতিপালনে আল্লাহর নিয়মাবলীর প্রতিবিম্ব বা অবতার। একারণে তার মধ্যে এই নিয়মাবলী জানার, গাণিতিক নিয়মাবলী প্রণয়নের সামর্থ্য তাকে দেয়া হয়েছে। এই নিয়মাবলী অনুসরণ করে সে জগতে আল্লাহর প্রতিপালন নীতির প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম।

৫.৬। সর্বধরেশ্বরবাদে ঈশ্বর প্রথম (আওয়াল), তিনি শেষ (আখির), তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে, আবার তিনিই সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছেন। তিনি স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে; স্থান-কাল ও পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মগুলো তাঁরই সৃষ্টি। কালের এবং মানুষের বুদ্ধির সকল ক্যাটাগরির আওতার ঊর্ধ্বে 'অবস্থান'কারী ঈশ্বরের সত্তা ও প্রকৃতি বিষয়ে তাই আমরা কিছুই জানতে পারি না। ঈশ্বরের সত্তার প্রকৃতি আমাদের ধারণার অতীত ও অনির্বচনীয়।

৫.৭। যেহেতু ঈশ্বর, জগত ও ব্যক্তিমানুষেরা সব স্বতন্ত্র, তাই প্রতিটি ব্যক্তি মানুষ জগতে ঈশ্বরের একেকজন প্রতিনিধি। ঈশ্বরের প্রতি দায়বদ্ধতাও ব্যক্তিগত। যেহেতু সকলেই ঈশ্বরের উপর সমভাবে নির্ভরশীল তাই ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কারও প্রতি ভক্তিমূলক মনোভাব বজায় রাখা বা তার বন্দনা করা বা তার উপাসনা করার কোন যুক্তি থাকে না।

***

৬.১। মানুষের মধ্যে একটি প্রবণতা রয়েছে: যা কিছু নিয়মানুগ তা যেন খুবই স্বাভাবিক, তার জন্য যেন ঈশ্বর নিষ্প্রয়োজন। নিয়ম ভেঙ্গে কিছু করা হলেই যেন ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। এ কারণে ইহুদিদেরকে আমরা দেখি তাদের নবীদের কাছে অলৌকিক কিছু দেখানোর জন্য বারংবার আবেদন করতে। আমাদের কিছু বিজ্ঞানীর মধ্যেও এ প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। কোন প্রপঞ্চের ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে তারা সিদ্ধান্ত করেন যে, এতে ঈশ্বরের দরকার নেই। আবার কোন প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করতে অপারগ হয়ে উঠলে তারা তাতে ঈশ্বরের হাত খুঁজে পান। এরকম চিন্তায় ঈশ্বর হয়ে উঠেন ফাঁক পূরণের ঈশ্বর (গড অব দি গ্যাপস)। একটি উদাহরণ দেয়া যাক।

৬.২। এখন মানুষ ল্যাবরেটরিতে বস্তু সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সেখানে ইলেকট্রনের সাথে এন্টিইলেকট্রন (পজিট্রন) তৈরি হয়। আরও তৈরি করা গেল প্রোটন-এন্টিপ্রোটন, নিউট্রন-এন্টিনিউট্রন তথা ম্যাটার-এন্টিম্যাটার। ইলেকট্রন ও পজিট্রনের মিলনে বিপুল শক্তির বিকিরণ ঘটিয়ে দুটোরই ধ্বংস হওয়ার কথা। প্রশ্ন দেখা দিল: প্রকৃতিতে প্রাপ্তব্য এসব এন্টিম্যাটার কোথায় গেল? কোন কোন বিজ্ঞানী এখানে ঈশ্বরের হাত দেখলেন। ভাবলেন, ঈশ্বর এন্টিম্যাটার তৈরি না করে কেবল ম্যাটারই তৈরি করেছেন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। কিন্তু পরে এখন তারও ব্যাখ্যা মানুষ খুঁজে পেয়েছে এবং ঈশ্বরের হাত অদৃশ্য হয়েছে।

৬.৩। কোরানের বাক্যকে বলা হয় আয়াত। কোরানে প্রকৃতির প্রপঞ্চগুলোকেও আল্লাহর আয়াত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াত অর্থ সংকেত বা সিম্বল। দিন-রাতের পর্যাবৃত্তি, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টি, নারী-পুরুষের পার্থক্য, প্রজনন, জরায়ুতে শিশুর বিকাশ, মানুষের জ্ঞানবৃত্তিসমূহ ইত্যাদিকে আল্লাহর নিদর্শন বা আয়াত বলা হয়েছে কোরানে। পরিশেষে বলা যেতে পারে, মুসলিমরা জগতের অস্তিত্ব, অস্তিত্বের নিয়মানুবর্তিতা এবং নিয়মের বোধগম্যতার মধ্যেই ঈশ্বরের চিহ্ন বা নিদর্শন বা সংকেত বা আয়াত দেখতে পায়; ব্যাখ্যার অভাব বা অলৌকিকতার প্রয়োজন তারা অনুভব করে না; আবার ব্যাখ্যার সম্পূর্ণতাও তাদের কাছে ঈশ্বরকে অনাবশ্যক করে তোলে না।