ভাষা: নিয়ন্ত্রণ বনাম স্বাধীনতা

মোনেম অপু
Published : 27 Feb 2012, 05:06 AM
Updated : 27 Feb 2012, 05:06 AM

জীবনে স্বাধীনতার যেমন প্রয়োজন তেমনই নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন রয়েছে। আমরা স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে সমার্থক হিসেবে দেখি না। নিয়ন্ত্রণের কথা উঠলে আমরা আবার সতর্ক হয়েও উঠি। কারণ নিয়ন্ত্রণের নামে স্বাধীনতাকে গ্রাস করার প্রচেষ্টাও আমরা হর-হামেশাই দেখে থাকি। বিজ্ঞজনেরা হয়তো বলবেন সবকিছুতেই একটি ভারসাম্য প্রয়োজন। এই ভারসাম্যের সংজ্ঞা ও প্রয়োগ নিয়েও যে টানাপোড়ন দেখা দিতে পারে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তারপরও আমরা ভাবি, পথ খুঁজি, ভুল করি আবার নিজেদেরকে ক্রমাগত শুধরাতেও থাকি।

মানুষ গাড়ি তৈরি করে, আবার গাড়িও মানুষ তৈরি করে। একজনের চিন্তাগত ও মানসিক কাঠামো তার মুখে শব্দের যোগান দেয়। একজনের মুখ নিঃসৃত শব্দের ধারা আবার অন্য একজনের চিন্তাগত ও মানসিক কাঠামো তৈরিতে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি যে খুবই সত্য তা বিশ্লেষণ করে বলার প্রয়োজন নেই। 'চল যাই' বলা আর 'ল যাইগা' বলার মধ্যে পার্থক্য কেবল শব্দের নয়। একদেশের বুলি অন্য দেশে গালি হতে পারে, কিন্তু তাই বলে একদেশের গালি সেদেশেই বুলি হতে পারে না।

একই বাণী একই ইংরেজি ভাষায় যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটেনের প্রধান মন্ত্রী বলেন তখন কি আপনি টের পান না যে একটি জাতির বয়স শত বছর ও আরেকটির বয়স হাজার বছরের স্কেলে? আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা যা গ্রহণ করি, ব্রিটেনের ক্ষেত্রে সে অবস্থায় উপনীত হওয়াকে আমরা বলব নিজের অগ্রসর অবস্থান থেকে প্রত্যাবর্তন।

আফ্রিকায় অনেক দেশ রয়েছে যেখানে ভাষা পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি। তারা বাধ্য হয়ে কি করছে না করছে তা ইংরেজি, জার্মান, আরবি, ফরাসী বা বাংলার মতো সমৃদ্ধ ভাষার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় হতে পারে না। ভাষার মান বজায় রাখার প্রয়াসকে স্বাধীনতার নামে পরিহার করা যায় না। ভাষা বিষয়ে কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে আমরা কোন হস্তক্ষেপ করতে পারি না, কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে আমদেরকে শিক্ষাদান ও উৎসাহদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, আবার কিছু ক্ষেত্র নিশ্চয়ই আছে যেখানে নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতা রয়েছে।

নিয়ন্ত্রণ বলতে আমি বুঝচ্ছি রেগুলেশন। আধুনিক কালে দেশে নানা ক্ষেত্রে রেগুলেশন আছে, আছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা রেগুলেটরি বডি। একটা সময় ছিল যখন বাড়িঘর তৈরিতে কোন রেগুলেশন ছিল না। এর জন্য কোন সংস্থাও ছিল না। কিন্তু আজ কি আমরা নগর গড়তে পারবো রেগুলেশন ছাড়া? আমার গ্রামের মাঝিরা নৌকা চালায় কোন সনদ ছাড়াই; তাই বলে আমরা নগরের সড়কে অটোমোবাইল চালাতে দিতে পারি কি কোন চালককে? আমরা ট্যাক্সি চালক ও মালিকের জন্য রেগুলেশন তৈরি করি। আমরা তো বলতে পারি না, ট্যাক্সি চালকের স্বাধীনতায় তো হস্তক্ষেপ করা যায় না, কাজেই চালকের সাথে বনিবনা না হলে অন্য ট্যাক্সি খুঁজুন।

আমরা এ লেখার এ পর্যায়ে এসে একটি ধারণার খোঁজ পেলাম। ধারণাটি হলো, 'সেবা প্রদানকারী' বা 'সার্ভিস প্রভাইডার'। এই সেবা প্রদানকারী একজন ব্যক্তি হতে পারেন, আবার একটি সংস্থা বা অরগানাইজেশন হতে পারে। আমরা একজন ব্যক্তির বেলায় ঠিক করে দিতে পারি না তিনি কি আম খাবেন, নাকি আপেল খাবেন। কিন্তু যিনি আম-আপেল বিক্রি করবেন তাঁর জন্য অবশ্যই এরকম রেগুলেশন তৈরি করতে পারি যে, তিনি আম-আপেল যা-ই বিক্রি করেন না কেন, তাতে ভেজাল দিতে পারবেন না। এ ধরণের রেগুলেশন তৈরি করা হয়ে থাকে ভোক্তা বা সাবস্ক্রাইবারের নিরাপত্তা ও স্বার্থের কথা বিবেচনা করে।

আমরা ভাষার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা সীমিত সামাজিক কর্মকাণ্ডের অঙ্গনে আইন-পুলিশ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে পারি না। একজন ব্যক্তি যদি প্রমিত বাংলায় কথা না বলেন, বা একদল 'ইয়ার-বন্ধু' আড্ডা দেয়ার সময় যদি প্রমিত বাংলায় কথা না বলেন তবে সমাজ বা রাষ্ট্রের ঠিক এ স্থানটিতে করণীয় কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে শেখাবেন তা তো হয় না। একইভাবে রেডিও ও টিভিতেও পেশাজীবীদের জন্য যা ইচ্ছা তাই বলার, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে উচ্চারণ করার অধিকার থাকবে কেন?

টিভিতে কোন আলোচনা সভায় কোন বক্তা ভুলভাবে বাংলা বললে আমরা দুঃখিত হতে পারি মাত্র এবং এ বিষয়ে উন্নতির কথা বিবেচনায় আনলে আমরা শিক্ষা-ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিতে পারি। কিন্তু তাই বলে টেলিভিশন চ্যানেলটির পেশাদার কর্মচারী, যিনি অলোচনা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন, তাঁর বেলায় বিষয়টিকে এতটা সহজভাবে দেখা যায় না। এখানে সংস্থাটি ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের বিশেষ পেশাগত দায়িত্ব রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, রেডিও এবং টিভি চ্যানেলগুলো ভাষাভিত্তিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কি-না, যার পরিচালনাগত ছাড়পত্রের জন্য ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখা শর্ত হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, রেডিও এবং টিভি চ্যানেলগুলো সংবাদ পাঠক, সংবাদ প্রতিবেদক, অনুষ্ঠান পরিচালক ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিবর্গের জন্য শুদ্ধ বাংলায় কথা বলাকে তার পেশাগত যোগ্যতার আবশ্যক অংশ হিসেবে দেখা যায় কি-না। যেহেতু ভাষাই এই সেবার বাহন, যেহেতু ভাষার রূপ সঞ্চালনে জনতা ও বিশেষ করে শিশুদের উপর এর প্রভাব অত্যধিক, সেহেতু প্রশ্নদুটোর উত্তর হ্যাঁ-বাচক হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এরা রেগুলেশনের আওতায় আসতেই পারে, যদি এটি পরিলক্ষিত হয় যে, এই রেগুলেশনের অভাব ভাষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে এবং যা ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে।

এই অঙ্গনে রেগুলেশনের কথা শুনেই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের আশংকা নিতান্তই অমূলক। শুদ্ধরূপে বাংলা বলা শিখতে এভারেস্ট পাড়ি দিতে হয় না। এও বলা হচ্ছে না যে, এখনই এইসব বাস্তবায়ন করে ফেলা হোক। আমি প্রয়োজনে ভবিষ্যতে করা যেতে পারে ও বাস্তবায়নের জন্য একটি উপযোগী পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে – এই সম্ভাবনার কথা বলছি মাত্র।

ভাষায় নিশ্চয়ই একটি সম্প্রসারণশীলতার নীতি গ্রহণ করতেই হয়, বিকাশের নিয়মেই এই নীতি বিদ্যমান যা পরিহার করলে আবদ্ধতা তৈরি হয়। কিন্তু সম্প্রসারণশীলতা আর বিকৃতি তো এক নয়। লাইসেন্সিংয়ের মত ব্যবস্থার প্রস্তাব কঠোর মনে হতে পারে। এতদূর যাওয়ার প্রয়োজন না-ও থাকতে পারে। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র, সুনীতি কুমার, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা ইত্যাদি মনিষীর হাতে গড়ে ওঠা বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ তো আমরা ভাষা-ভিত্তিক সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর ক্রমাগত অযোগ্যতা বা স্বেচ্ছাচারিতা বা বাণিজ্যিক আকাঙ্ক্ষার হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।