কথাহীনতার বর্ণালী চাদর

মোনেম অপু
Published : 15 April 2012, 04:16 AM
Updated : 15 April 2012, 04:16 AM

হতাশার কালে জ্বরের কবলে পড়ার ফল ভাল হয় না। মনটা যখন নানা দুর্ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকে, ঠিক তখনই যদি সমান্তরালভাবে শরীরটাও আক্রান্ত হয় ভাইরাসে তখন মনোবিকলনের বুঝি ষোলকলা পূর্ণ হয়। আশার সোনালী আলোরা যখন একে একে নিভতে থাকে, দুরাশার হলুদ ফুলঝুরিতে যখন আকাশ আসন্ন অন্ধকারের সংকেত হয়ে উঠতে থাকে, ঠিক তখনই যদি বিস্বাদের বশে অনাহারে থাকতে হয়, তবে বস্তুর জগত আর ভাবের জগতের ইন্টারফেসটি বুঝি গোলমেলে হয়ে যায়।

কয়েক কাল অনেক কাল। সেদিনও নদী ছিল জলে ভরা, মাছে ভরা। সেদিন যারা সাঁতার কেটেছে মনের আনন্দে, মাছ ধরার উৎসব করেছিল উজানের পরিষ্কার জলে, আজ তারা কোন পাড়ে বসে আছে মুদ্রিত নেত্রে নীরবে কে জানে। নদীতে পানিরা থাকতে চায় না আর, মাছেরা মুখ ভার করে খোঁজে ভাটার টান। যখন ভরা নদীর জল উবে হাওয়া হয়, তখন কি নদীর পাড়ে বসে খরার গতি দেখে কপোলে হাত অসহায় মাঝিদের দল? কোন পাড়ে বসে থাকে তারা? যে গাঙ্গে জল নেই তার এপাড় কী আর ওপারইবা কী – ভাবে অনিকেত দৃষ্টির মাঝিরা।

নদীরা বুঝি একা থাকে না। জোড়ায় জোড়ায় জন্মায়, ছুটে যুগলভাবে সমান্তরালে। একটি যদি জলের অভাবে মরে, অন্যটি তবে জলের ভারে আতঙ্কিত করে তোলে তটবাসীকে। একে একে ইলিশেরা উঠে আসে দূরের সাগর থেকে। তাদের পেট বোঝাই স্বপ্নের রেণু। যারা ক'দিন আগেও উচ্ছ্বাসে ছিল আপনহারা, আজ তারাই দেখে ভিন নদীতে রেণু প্রসবের মহোৎসব। যারা গেল মৌসুমে জলের দেখা পায়নি আজ তারাই পিঠে সোনালি রোদের ঝিকিমিকি ছড়িয়ে মোহনীয় সাঁতারে মেতে উঠে ডলফিনদের মত।

মন ক্রমেই ভারি হয়ে উঠে, বাইরের বাতাসটাও ভারি। যে কীটদের আমি লালন করি আজ রাবণকে বধিবার তরে, সে কীটের বশেই কাল নিহত হয় রাম আমারই হাতে, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। যে পিরামিড আমি গড়ি মানুষের কংকালের সুরকিতে, তা-ই একদিন সাড়ম্বরে ভেঙ্গে পরে আমার কঙ্কালের পরে। তুমি কি দেখেছো কোন দিব্যকান্ত অন্ধকারকে দীর্ণ করেছে কৃষ্ণগহ্বর দিয়ে? ভয়ংকর হুতাশনে কণিকারা সব পতঙ্গেরর মত আছড়ে পড়ে যে গহ্বরে, তা থেকে কোন তথ্য আলোর কণা হয়ে এসে পড়ে না তৃষিত মানুষের চোখে।

আমি অসুর হয়ে মুখে বাঁশি নিয়ে বৃথাই রুপালী জোছনার প্রতীক্ষায় কাল কাটাই। আমি নির্ভীকের মত তাই উচ্চারণ করতে চাই যে, "আমি উচ্চারণ করতে ভয় পাই।" আমি নির্লজ্জের মত তাই উচ্চারণ করতে চাই যে, "আমি উচ্চারণ করতে লজ্জা পাই।" আমি সাহস চাই না, আমি লজ্জা পাই না। আমি সাহস পাই না, আমি লজ্জা চাই না। কথাহীনতার বর্ণালী চাদর! তুমি নেমে এসো ধরণীর পর।