দোষান্বেষণ ও প্রোপাগান্ডা

মোনেম অপু
Published : 19 April 2012, 11:58 AM
Updated : 19 April 2012, 11:58 AM

১। মানুষের দুটি প্রবণতা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এদের একটি হচ্ছে অন্যের মধ্যে দোষ অন্বেষণ করা এবং অপরটি হচ্ছে অন্যের কথিত দোষের বিবরণ পাওয়া গেলে তা নিয়ে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত হওয়া। অন্য ব্যক্তির মধ্যে দোষ অন্বেষণ করা ভাল কাজ নয়। অন্বেষণের ফল হিসেবে যে দোষের সন্ধান পাওয়া গেল বলে মনে হলো তা বেঠিক হলে মিথ্যায় উপনীত হওয়া হয়, মিথ্যা দোষারোপ করা হয়। এটি একটি বিরাট দায়। এ দায়ের ঝুঁকি নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর যদি এর ফল হিসেবে সত্যে উপনীত হওয়াও সম্ভব হয় তবুও অন্যের মধ্যে দোষ অন্বেষণ করা মন্দ কাজ হিসেবেই থেকে যায়। আমরা চট করে হয়তো বলে ফেলতে পারি, দোষীর দোষ বা সম্ভাব্য দোষীর দোষ খুঁজতে সমস্যা কোথায়?

২। বিষয়টিকে যথার্থভাবে বুঝতে হলে অন্বেষণ কাজের সূচনা অবস্থা বিবেচনা করা আবশ্যক। মনের ভেতর অন্যের দোষ অন্বেষণের বাসনাটি জাগ্রত হয় যখন, তখন কিন্তু অন্বেষণকারীর নিকট দোষটির বিদ্যমানতার জ্ঞান থাকে না। যদি থাকতো তবে সে অন্বেষণ করতে নামবে কেন? যেহেতু শুরুতে 'সাব্যস্ত' দোষীর দোষই অজ্ঞাত ছিল তখন 'দোষীর দোষ খুঁজতে বেড়িয়েছি' এ দাবীটি টেকে না। অন্যদিকে, সম্ভাব্য দোষীর দোষ খুঁজতে বের হতে হবে কেন? আমার মোটিভ ও পারপাস কী? এ প্রশ্ন তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এবার তাহলে প্রশ্ন করা যায়, কী একজনকে অন্যের মধ্যে দোষ অন্বেষণ করার দিকে ঠেলে দিতে পারে?

৩। মানুষের মধ্যে একটি ভেদের নীতি কাজ করে। এ আমার আপন, সে আমার পর। আপনের জন্য এক নীতি, পরের জন্য বিপরীত নীতি। আপনকে হেয় হতে দেখলে দুঃখ পেতে হয়, পরকে হেয় হতে দেখলে সুখ পাওয়া যায়। আপনকে বিপন্ন দশায় দেখলে মনে কষ্ট লাগে, পরকে বিপন্ন দশায় দেখলে আনন্দ পাওয়া যায়। পূর্বতঃগৃহীত এ নীতিগুলোকে সিদ্ধ মনে করা এবং মানসিক এ অবস্থাগুলোকে অনুমোদন করার ফল হিসেবে আমরা এরূপ অন্বেষণে বা প্রচারণায় লিপ্ত হতে পারি। যদি সবাইকে আপন ভাবা যায়, সবাইকে ভাল হিসেবে পাওয়ার কামনা মনে বিদ্যমান থাকে তবে নিশ্চিত মন্দের প্রতিও একটি সহানুভূতি থেকে যায় যা কথায় প্রকাশিত হবে। আর অনিশ্চিতের বেলায় তো মুখে সীমাতিরিক্ত কথা আসারই কথা নয়।

৪। যে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় সে প্রথমেই তাকে 'ডিসওউন' করে। তাকে ভাল হিসেবে পেতে চায় না। তাকে মন্দ হিসেবেই দেখতে চায়। এতে সুবিধা, এতে আনন্দ। এটি স্রেফ অন্যের জন্য অমঙ্গল কামনা করা, অন্যের অমঙ্গলে আনন্দিত হওয়া। অথবা তার বিশ্বাস হয়তো এমন যে, 'কাউকে ভাল হতে হলে আমার মতাবলম্বী হতেই হবে এবং বিরুদ্ধ মতাবলম্বীর অমঙ্গল কামনা করা জেহাদের অংশ।' এখানে মনে রাখতে হবে যে, ভিন্ন মত অবলম্বন ও অন্যের উপর অত্যাচার সমার্থক নয় কোন ভাবেই।

৫। অন্যের মধ্যে নিজ কর্তৃক দৃষ্ট দোষ গোপন করা একটি ভাল কাজ। আমরা নিজের বা বন্ধুদের দোষ গোপন করতে ভালবাসি। কিন্তু আবার অন্যের দোষ অন্বেষণ ও প্রচারণার ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে বিপরীত কাজ করে ফেলা সম্ভব। আমরা অন্যের বা বিপক্ষ শিবিরের ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে এটিকে স্বার্থ রক্ষার লড়াইয়ে বা রাজনৈতিক সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় এবং সুবিধাজনক কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে বসতে পারি। আর এটি হয়ে আছে দোষের বিবরণ পাওয়া গেলে তা নিয়ে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত হওয়ার কারণ বা উদ্দেশ্য। কিন্তু কথা হচ্ছে, নিজে বেশী ভাল হতে পারলে জেতার জন্য অন্যের দোষের প্রয়োজন হয় না।

৬। প্রোপাগান্ডা হচ্ছে মন্দ কথার বা কাজের প্রচারণা। মন্দ কথার প্রচারণা নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এক্ষেত্রে কেবলমাত্র অত্যাচারকে ব্যতিক্রম হিসেবে না দেখে উপায় নেই। কেউ কারও উপর অত্যাচার করলে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারের প্রতিবেদন দিতে পারে অত্যাচারিত। অন্যদের কর্তব্য অত্যাচারিতের আবেদনে সাড়া দেয়া। তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যে, অত্যাচারিতকে কেবল রক্ষা করা ও ন্যায় বিচার লাভে সহায়তা করাই তাদের কাজ। অত্যাচারিতের বিবরণ শুনেই তার সাথে একসুরে হৈ চৈ করার কোন উপযুক্ত কারণ নেই।

৭। এমনও হতে পারে যে, আমার কাছে অভিযোগের বিবরণ ও অভিযুক্তের আচরণ তার দোষী হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে সাব্যস্ত হলো। কিন্তু তারপরও বলা যায় ইঙ্গিত ইঙ্গিতের অতিরিক্ত কিছু নয়। একজন ইনোসেন্ট ব্যক্তিও কঠিন পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে এমন আচরণ করতে পারেন যা একজন প্রকৃত অপরাধী করে থাকেন। কাজেই অত্যন্ত সতর্ক ও প্রসারিত বিচার ছাড়া দোষ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা অস্বীকার করা খুবই কঠিন। যিনি আদালতে বিচারক তাঁর উপর বিচারের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তিনি একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য। আশা করা যায় তাঁর ভুল ঈশ্বর ক্ষমা করবেন যদি তিনি ন্যায়পরায়ণ হন ও সদিচ্ছা তাড়িত হন। কিন্তু যার সে দায়িত্ব নেই তিনি কেন আগ বাড়িয়ে এত কঠিন পথে এত সহজে হাঁটতে শুরু করবেন?

৮। এমনও হতে পারে যে, একজনের দোষের বিবরণ পেয়ে আমি প্রচারণায় নামলাম এবং পরে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রমাণিত হলো যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যিই দোষী। তাতেও আমার প্রতিপাদ্য বিষয় ভেঙ্গে পড়ে না। আগে আপনার বিরোধিতা দেখে পরে আমি আনন্দিত হয়ে আপনাকে এক হাত দেখে নিতে পারবো না। কারণ আমার কাজের বিচারটি হবে আমি যখন তা করেছিলেন তখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। কাজেই পরবর্তী আউটকাম আমার কোন কাজেই আসছে না।

৯। আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি তা মোটেই দোষীদেরকে রক্ষা করার কৌশল নয়। আমি আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু নৈতিক নিয়ম সন্ধানের চেষ্টা করছি। প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কি দুষ্টের দোষের বিবরণ দেয়া একেবারেই যাবে না? না, যাবে না – এ সাফ উত্তর দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে তো দোষীদের হাত থেকে অন্যকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। বিষয়টি জটিল। কী কর্তব্য তা সাধারণভাবে নির্ধারণ করে দেয়া অত্যন্ত কঠিন অথবা বলা যেতে পারে সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব বিচার ক্ষমতা ভালভাবে প্রয়োগ করে পদক্ষেপ নিবেন এটাই প্রত্যাশিত।

১০। আমি সাংবাদিক, পুলিশ, আদালত, মানবাধিকার সংস্থা ইত্যাদিকে আমার আলোচনার পরিমণ্ডলের বাইরেই রাখতে চাই। তারা আইন ও অনুমোদিত প্রসিডিওর অনুযায়ী কাজ করবেন এটাই প্রত্যাশিত। সাংবাদিকরা নিজে যা দেখেছেন, শুনেছেন তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ লিখবেন মাত্র। যেমন, কোন সাংবাদিক নিজে দেখেছেন, শুনেছেন এমন ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন নিজের বরাতে লিখবেন; অন্যের কাছে শুনলে কেবল লিখবেন অমুকের কাছ থেকে শুনেছেন যে, ইত্যাদি। শেষেরটিকে স্বপ্রত্যক্ষিত ও বাস্তব ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করবেন না।

১১। পরিশেষে বলতে চাই, আমরা আম-জনতা অপরাধের ঘটনা জানতে পারলে তদন্ত ও সুবিচারের দাবীর মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রেখেও কর্তৃপক্ষের উপর চাপ তৈরি করতে পারি। এজন্য নিজেই বিচার করে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি রায় দিয়ে দেয়ার আবশ্যকতা নেই। নতুন প্রজন্ম চিন্তার দিক থেকে স্বনির্ভরভাবে একটি সুন্দর ও ন্যায়পরায়ণ সিভিল সোসাইটি তৈরি করুক এই প্রত্যাশা করে শেষ করলাম।