দেশ কি ভাল চলছে না?

মোনেম অপু
Published : 7 June 2012, 04:42 PM
Updated : 7 June 2012, 04:42 PM
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অনেককে শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা যায়। শোনা যায়, মানুষ আশাহত হয়ে গিয়েছে। জনমনে এরূপ একটি মানসিক আবহ তৈরির পেছনে কোন কোন উপাদান কাজ করেছে বা করছে তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে যেসব কারণে সরকার সমালোচিত হয়েছে তা বিচার করে আমরা সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি: (১) কতকগুলো এমন কাজ যার জন্য এ সরকারকে কেন, কোন সরকারকেই সম্পূর্ণভাবে দায়ী করা যায় না। (২) কতকগুলো এমন কাজ যা সামর্থ্যের মধ্যেই ছিল কিন্তু সরকারের নিকট থেকে আশানুরূপ পদক্ষেপ পাওয়া যায়নি। (৩) এমন কিছু নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় কথা যা অসতর্কভাবে বলা হচ্ছে।

(১) সরকারের জন্য দুরূহ কাজ

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ঘাটতি, রাস্তাঘাটের অবনতি ইত্যাদির মত বিষয়গুলোতে সরকারের সমালোচনার তীব্রতা কিছুটা অন্যায্য বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। সমালোচনা হবে। জনগণ সমালোচনা করবে। এটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পত্রিকা, ব্লগ বা টেলিভিশনে যা হয়েছে তাতে অনেক সময় মনে হয়েছে এটি সমালোচনা যেন নয়, যেন প্রচারণা।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এ সরকার যেমন ঠেকাতে পারেনি, এর আগের কোন সরকারও পারেনি। কিন্তু এটি কি আশা করা যায় যে, এবার অন্য কোন সরকারের পক্ষে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আমাদের জন্য আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি করে দেয়া সম্ভব ছিল? এরূপ আশার কোন ভিত্তি নেই। আমরা সরকারের উপর চাপ তৈরি করতে পারি, আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারকে একচেটিয়া দায়ী করতে পারি না।

বিদ্যুতের ঘাটতি নিয়েও একই কথা বলা যায়। এ নিয়ে এই সরকারের ব্যর্থতা অন্য সরকারগুলোর মতোই। এখানে দুর্নীতির অভিযোগ আগেও ছিল, এখনও আছে। এই সেক্টরে উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা, সমস্যা সমাধানের পথের কঠিনতা দুটোই বিরাট।

রাস্তাঘাটের ব্যাপারটি নিয়ে মন্ত্রীকে তো রীতিমতো দপ্তর ছাড়তে হলো। কিন্তু এ নিয়ে যে পরিমাণ হৈচৈ, হাসি-ঠাট্টা হয়েছে তা খুবই বেশী হয়ে গিয়েছে। এরকম উৎকট সমস্যা অতীতেও ঘটেছে, ভবিষ্যতেও হয়তো ঘটবে। তবে সরকারের প্রতিক্রিয়াও তো আন্তরিক ছিল। দ্রুত রাস্তা মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, এমনকি শেষতক মন্ত্রীকেও সরতে হয়েছে।

(২) সরকারের নিয়ন্ত্রণভুক্ত কাজ

এগুলোর মধ্যে পড়ে ছাত্র সংগঠনের আভ্যন্তরীণ কোন্দল, এর সদস্যদের অপকর্মগুলো, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদির তদন্তের মত কাজগুলো, শিক্ষকদের সমাবেশে শক্তি প্রয়োগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু কাজ ইত্যাদি। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকারের আওতায় আছে ও ছিল। হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদির তদন্তগুলো পরিচালনায় সরকার জনগণের সাথে যথাযথভাবে যোগাযোগ রক্ষায় সমর্থ হয়নি। তাছাড়া এখানে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাবও দেখা গেছে।

১৯৯৬ সালের পরের নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরাজয়ের পিছনে একটি প্রধান কারণ ছিল সন্ত্রাসবৃদ্ধি। কিন্তু সেবার এর মাত্রা কম ছিল ও এ নিয়ে এতো হৈচৈও হয়নি বলেই আমার ধারণা। কিন্তু দল এ থেকে কোন শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তা না হলে সরকারী দল এবার এ বিষয়ে শুরু থেকেই সতর্ক হতে পারতো।

(৩) অনাকাঙ্ক্ষিত কথাবার্তা

কথায় তো চিড়া ভিজে না। কথায় হাতি-ঘোড়াও মরে না। কিন্তু কথায় নিজের মান যেতে পারে। সরকার নিজের জন্য একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছে কেবল কথা বলে। এ কথাগুলোর কোন উপযোগিতা নেই। এগুলো না বললেও কোন ক্ষতি হতো না। বরং বলে বলেই সর্বনাশ করা হয়েছে। এগুলোর এখনকার উদাহরণ: জাতীয় সংসদের স্পীকারের কথাটি যা নিয়ে আদালত আপত্তি করছে, আব্দুল্লাহ আবু সাইদের বিরুদ্ধে সংসদে বলা কথা, ইলিয়াসের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলা মন্নুজানের কথা ইত্যাদি।

কেন এমন কথাবার্তা?

এর একটি বড় কারণ অসতর্কতা এবং কথার গুরুত্ব ও প্রভাব বিচার করতে অপারগতা। তাছাড়া সরকারের কোন কোন ব্যক্তির বা মুখপাত্রের যথাযথ মাইন্ডসেট-এর অভাব আছে বলেই আমার মনে হয়েছে। তারা এখনও হয় জানতে পারেননি বা জানলেও মনে রাখতে পারেন না যে, রাজনীতি করে দল, রাজনীতি করা সরকারের কাজ নয়। সরকারের কাজ দেশকে পরিচালনা করা ও দেশের জন্য বাস্তব কাজ করে যাওয়া। কাজে অসুবিধা ঘটলে, সমস্যা দেখা দিলে জনগণকে সে বিষয়ে অবহিত করে রাখা। এবং এটিই তার দলের পরবর্তী নির্বাচনে জেতার প্রধান রাজনৈতিক কৌশল।

কিন্তু বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকরা সমালোচনা করবে। জনগণ অসন্তুষ্ট হবে। সাংবাদিকরা লেখালেখি করবে। এটা স্বাভাবিক। তবে দল যার যার, কিন্তু সরকার সবার। এ দল সে দলের প্রতিপক্ষ হতে পারে। কিন্তু সরকার যেহেতু সকলের সেহেতু সরকার তো কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবতে পারে না। যদি মনে রাখা যেতো যে, জনগণের কোন অংশই, পেশাজীবী কোন সম্প্রদায়ই সরকারের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সে সকলের, সকলের প্রতিই তার সমান কর্তব্য, তবে অনেক কথাই মুখ থেকে বের হতো না, কথার সুর অন্যরকম হতো।

পিতা ও সন্তান, শিক্ষক ও ছাত্র – এদের মধ্যে পিতা বা শিক্ষক এবং সন্তান বা ছাত্রের দায়িত্বভার এক হতে পারে না। সন্তান বা ছাত্রের সাথে পিতা বা শিক্ষক এক তালে লড়তে পারে না। সরকার-জনগণের সম্পর্কটাও অনুরূপ। জনগণ, পেশাজীবী সম্প্রদায়, বিরোধী দল যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে ঠিক একইভাবে তাদেরকে প্রতিপক্ষ ভেবে সরকার তাদের সাথে আচরণ করতে বা কথা বলতে পারে না।

এখনও সময় আছে

সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে, দিকভ্রান্ত ও অস্থির হয়ে পড়ছে। কিন্তু এমন হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব যদি বিরোধীদের প্রচারণার ফল হয়ে থাকে বলে সরকার মনে করে, তবে তাকে এ কথা বলা যায় যে, বিরোধীরা সফল হচ্ছে সরকারের প্রধানত কথার দোষে।

সরকারের নীতি নির্ধারকদের হাতে এখনও সময় আছে নিজেদের অবস্থা ও এ অবস্থায় উপনীত হওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করার এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য পথ নির্ধারণ করার। নিজেদেরকে বদলাতে না পারলে, পথ বদলাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে আরও যা যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হবে তার খেসারত তারা না দিয়ে থাকতে পারবেন না।

মানুষের জীবনযাত্রায় সমস্যা, মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা নতুন কিছু নয়। সার্বিক বিচারে দেশ পরিচালনার দিক থেকে এ সরকারকে পূর্বের সরকারের তুলনায় একেবারেই ব্যর্থ বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও মনে রাখতে হবে যে, যে কোন সরকারের জন্যই এ কাজ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তাছাড়া এ সরকারও তো আমাদেরই সরকার, যা নির্বাচিত হয়েছে আমাদেরই মেনে নেয়া সংবিধান অনুসারে। সরকারকে পরিত্যাগ করাও কারও কাজ হতে পারে না।