শিক্ষক সংকট নিয়েও তরীর এক দশক

মান্নান মুন্না
Published : 29 April 2018, 11:09 AM
Updated : 29 April 2018, 11:09 AM

নিয়মিত পাঠদান করানোর দশক পূর্তি। গাছের নিচে, খোলা মাঠে কিংবা বিভিন্ন ভবনের বারান্দায় স্কুলটির ক্লাসরুম। দশ বছরে পরিধি বেড়েছে স্কুলের। ২০০৮ সালে যে শিশুটি ১ম শ্রেণিতে পড়তো, সে আজ দশম শ্রেণিতে। প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক জীবন কেটে গেছে এ তরীতে তার। আবার যে ৫ম বা ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল তার পড়াশুনা শেষ বা শেষ পর্যায়ে। এ গল্প যে ঝরে পরেনি পড়াশুনা থেকে, তার।

দশ বছর আগে তৈরি হওয়া একটি সেচ্ছাসেবী স্কুল তরী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের সামনে গাছের নিচে অন্যদিনের মতো একত্রিত হয় শিক্ষার্থীরা। তরী শিক্ষকরা শুরু করে দিলেন ক্লাস। হাতে খাতা-কলম। শুরু হলো অংক করা। কেউ পড়ছে ইংরেজি। একজন বলছে, ভাইয়া এ অংকটা করে দিন।

আরেক ছাত্র বলছে, আমাদের এখানে আসেন ভাইয়া। আসছি তোমরা বসো, বললেন জাকিরুল ইসলাম (তরী শিক্ষক)।

দশটি ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় যারা আছে তাদের বেশ বেগ পোহাতে হয় সবাইকে পড়াতে, জানালেন- তরী স্কুলের সভাপতি শফিকুল ইসলাম সাকিব।

বিকেল পাঁচটা তখন। অন্য দিনগুলোতে বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত পড়ানো হয়। আজ এক দশক পূর্তি আয়োজন। এক ঘন্টা পড়ানো শেষে দশ ক্লাস মিলে রূপ নিলো এক ক্লাসে। তৈরি হলো দশ বছরের দশ ক্লাসের এক তরী।

তরীর মাঝিদের একজন সবার সামনে উচ্চকন্ঠে বলছে, "আজ আমাদের তরীর এক দশক হয়েছে। দশ বছর আগে আমাদের মতো তোমাদের কিছু ভাইয়া আপুরা গড়ে তুলেছিল তোমাদের এ তরী।''

ইতোমধ্যে হাজির হয়েছেন তরীর উপদেষ্টা ও সরকার এবং রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ। তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, "তোমরা বড় হয়ে কী হবে?''

উত্তরে অন্যসব শিক্ষার্থীদের মতো এসব সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের কেউ বলছে, "ডাক্তার হবো", কেউ "ইঞ্জিনিয়ার হবো", "পুলিশ হবো" ইত্যাদি। কেউ বলে উঠলো "ভালো মানুষ হবো"। আবার প্রশ্ন, কেমন মানুষ? তারা সমস্বরে, " ভালো মানুষ''।

ভালো মানুষ হতে চাওয়া এই শত শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণে কাজ করছে তরী। অর্থের অভাবে কিংবা শিক্ষক সংকটে তাদের ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন যাবে না বাতাসে উড়ে। এমনই প্রত্যাশা করা যায় এক দশক পূর্তিতে।

দশ বছরে ছাত্রছাত্রীর  সংখ্যা বেড়েছে। বড় হয়েছে তরীর শরীর। চাদরে পুরো শরীর যাচ্ছে না ঢাকা। বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন। নিয়মিত ১০০ থেকে ১২০ জন শিক্ষার্থী ক্লাসে আসে। ১ম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দশটি ক্লাস। তরী শিক্ষক আছেন ২০-৩০জন । ব্যক্তিগত কাজসহ অন্যান্য ব্যস্ততায় নিয়মিত আসতে পারেন না সবাই। নুন আনতে পানতা ফুরানো পরিবারে সন্তানদের জন্য তরীতে প্রয়োজন আরো সেচ্ছাসেবী শিক্ষক।

সাবেক ও বর্তমান তরী শিক্ষদের সহযোগিতায় বিভিন্নজনের করা দানের ফসল স্কুলটি। মহতী উদ্যেগের ভূয়সী প্রশংসা করার লোক আনেক থাকলেও বাস্তবে সহযোগিতা পেতে হিমশিম খাচ্ছেন তরী স্কুল সংগঠকরা।

২০০৮ সালে ২৮ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯, ৩০ ও ৩১তম আর্বতনে অধ্যায়নরত কিছু শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সংগঠিত হয় তরী। তরী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে থাকা সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়াচ্ছে । যাদের মধ্যে দরিদ্র রিকশাওয়ালা, শ্রমিক কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সন্তান। কারো বাবাও বেঁচে নেই। যাদের শিক্ষক রেখে পড়ানোর  সামর্থ্য নেই, আবার পরিবারের সদস্যদের বাসায় পড়ানোর নেই যোগ্যতা। এরা পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের (ইসলামনগর, গেরুয়া ও ডেইরি ফার্ম) স্কুলে। এছাড়াও কেউ পথশিশু, কেউ কাগজ-পানির বোতল কুড়ায়। কারো জীবন চলছে বাদাম, চা-সিগারেট বিক্রি করে।

প্রতি সপ্তাহের শনি, সোম ও বুধবার দিন তরী স্কুলের ক্লাস নেন তরী স্কুল শিক্ষকরা। প্রত্যেক শিক্ষকই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বরবিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র।

প্রতিবছর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২ থেকে ৩টি টিম তরী পরিদর্শনে আসেন। তারা শিশুদের সাথে নাচ-গান, খেলাধুলা আর আড্ডায় মাতিয়ে তোলেন। শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন এবং তাদের সঙ্গে ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন। তরী শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, পিকনিকের ব্যবস্থা করে থাকে। ঈদে শিশুদের মাঝে নতুন পোশাক বিতরণ করে থাকে।

তরীর সদস্য হতে  www.toriju.org ওয়েবসাইট ভিজিট করতে হবে এবং সদস্য ফরম পূরণ করতে হবে। তরীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে ফেসবুকে তরীর ফ্যান পেজের সাথে যুক্ত হওয়া যেতে পারে। ফেসবুকে পাওয়া যাবে তাদের ফ্যান পে্ইজটি