গণচীন কি সিপিবিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছে? 

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 25 Jan 2012, 03:37 PM
Updated : 19 July 2020, 02:46 PM

অর্থনৈতিক দিক থেকে জিডিপির হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সামরিক শক্তির নিরিখে  তৃতীয় শক্তিধর রাষ্ট্র গণচীন।কোভিড-১৯ মহামারীর বর্তমান সময়ে হঠাৎ করে চীনের সেনাবাহিনী, যাকে তারা গণমুক্তি ফৌজ বলে, সে ফৌজ ভারতের লাদাখ সীমান্ত আক্রমণ করে ২০ জন সৈন্য হত্যা এবং ৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নেয়। যে বিষয়টা সবাইকে অবাক করে সেটা হল, পারমাণবিক বোমার অধিকারী উদীয়মান সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে আক্রমণ করতে চীনের দ্বিধা না করা। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর এক-কেন্দ্রিক যে বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তাকে চ্যালেঞ্জ করে গণচীনের ব্যাপক উত্থান এবং রাশিয়ার পুনরুত্থান ঘটেছে। এ দুটো বিষয় আমেরিকাসহ পুরো পাশ্চাত্যের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোভিয়েত-উত্তর যুগে দুনিয়াতে তাদের যে প্রভাব, এ দুটির রাষ্ট্রের উত্থানের ফলে তারা সেটি ধরে রাখতে পারবে কিনা- এটি এখন বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রিয় আলোচ্য বিষয়। 

এমতাবস্থায়, বিশ্ব রাজনীতিতে চীন কী ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে, এটা সারা বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তবে এর চেয়েও বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা নিয়ে। কেননা আঞ্চলিক রাজনীতিতে সফলতার উপরই নির্ভর করছে বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ভূমিকার বিষয়টি।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে ভারতকে ঘিরে। পুরো এশিয়াতে চীনকে প্রতিহত করবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত ছাড়া আর কোন বিকল্প খোলা নেই। চাণক্য নীতি প্রভাবিত ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পাকিস্তান ছাড়া সব রাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলতে আগ্রহী। ফলে, রাশিয়ার সাথে দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকলেও আমেরিকার সাথেও তার রয়েছে দহরম মহরম। 

গণচীন এবং রাশিয়া কেউই চায় না, ভারতকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়াতে আমেরিকার উপস্থিতি বৃদ্ধি পাক। ফলে ভারতের সাথে চীনের বিরোধ শুধু সীমানা নিয়ে নয়, এ অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব খর্ব করবার বিষয় নিয়েও। তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতির এ সমীকরণে বাংলাদেশকে ঘিরে চীনের বিদেশ নীতির আশু এবং সূদুরপ্রসারী লক্ষ্য বোঝা জরুরি হয়ে উঠেছে। 

এ অঞ্চলে গণচীনের বিদেশ নীতি যেহেতু ভারতকে ঘিরে, তাই বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির স্বরূপ সম্পর্কে পরিষ্কার বোঝাপড়া দরকার। এ বিষয়টা বুঝতে পারলে বাংলাদেশকে ঘিরে চীনের বিদেশ নীতি বোঝা সহজ হবে।        

ভারতের বাংলাদেশ নীতির স্বরূপ 

শুধু চীনের সাথে দ্বন্দ্বের ব্যাপারেই নয়, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের বিদেশ নীতির সার কথা হলো- আন্তর্জাতিক সমস্ত ক্ষেত্রেই ভারত বাংলাদেশকে তার প্রভাব বলয়ের অন্তর্গত দেখতে চায়। এ প্রবণতা যে সাম্প্রতিক বিষয়, ব্যাপারটা এমন নয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেই মোগল আমল বা তার আগে থেকেই দিল্লী সব সময় চেয়েছে ঢাকাকে পদানত করে রাখতে। কিন্তু এর বিপরীতে বাংলা সব সময়ই দিল্লীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। দিল্লীর প্রভাব বাংলার মানুষ কখনোই মেনে নিতে চায়নি। 

ইতিহাসের এ ধারাবিকতা বঙ্গবন্ধু খুব ভালো বুঝতেন। ব্রিটিশ আমলে সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে কোলকাতায় থেকে পাকিস্তান আন্দোলন করার সময়ে মহাত্মা গান্ধী, নেহেরুসহ ভারতের জাতীয় নেতৃত্বকে খুব কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুকে ভারতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে ঋদ্ধ করেছিল। তাই দেশ স্বাধীন হবার পরপরই বঙ্গবন্ধু ভারত বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করবে কিনা, এ বিষয়টাতেই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন স্থায়ীভাবে সৈন্য রেখে দিয়েছিল, ভারতও তেমন কিছু করতে যাচ্ছে কিনা, এ ভাবনা বঙ্গবন্ধুকে অস্থির করে তোলে। আরো এক ধাপ এগিয়ে সিকিমের মত বাংলাদেশকেও ভারত তার অন্তর্ভুক্ত করে নেয় কিনা, এ ভাবনাও বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে বসেছিল। 

এ সমস্ত ভাবনায় অস্থির বঙ্গবন্ধু তাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই দেশ থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহার করে নেবার প্রসঙ্গ তোলেন এবং এ বিষয়ে তার সম্মতি আদায় করে ছাড়েন। এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য। এর ব্যত্যয় হলে আজকে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হত।

দেশ স্বাধীন হবার পর আজকের তুলনায় সামরিক, অর্থনৈতিক সব ভাবেই অত্যন্ত দুর্বল বাংলাদেশ ভারতের প্রবল চাপের মুখে পড়ে। এ চাপ মোকাবেলা করবার জন্য বঙ্গবন্ধু এক অসাধারণ কৌশলের আশ্রয় নেন। ভারতকে হতবাক করে দিয়ে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান এবং বিপুল সংবর্ধনা দেন। এতে তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারেন। ভারতকে তিনি বুঝিয়ে দেন যে বিশ্বের কারো কথায় চলার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। অপরদিকে, যেই ভুট্টো বাঙালির স্বাধিকারের একজন বড় বিরোধী ছিলেন, সেই ভুট্টোকে বাঙালির নিজস্ব স্বাধীন দেশের একজন বিজয়ী নেতা হিসেবে ঢাকায় স্বাগত জানান। 

এখানে উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিকভাবে চরম বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে ভুট্টোর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের কখনই ছেদ পড়েনি। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে 'জুলফি' বলে ডাকতেন আর ভুট্টো ডাকতেন 'মুজিব' বলে। পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পাবার পর দেশ ত্যাগের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যাতে একজন প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় গার্ড অব অনার পান ভুট্টো তা নিশ্চিত করেন। 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী সেই বিরল রাজনীতিবিদদের একজন, যার সাথে তার পুরো বিপরীত মতের অনেক রাজনীতিকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গাটিকে তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষায় অন্তরায় হতে দেননি।

বঙ্গবন্ধুর ক্রমাগত ভারতকে অগ্রাহ্য করবার অবস্থান ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে অসহিষ্ণু করে তোলে। ইন্দিরা গান্ধী সরকার বাংলাদেশের আনুগত্য পরীক্ষা করবার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে নিষেধ করে। ভারতের পক্ষ থেকে এ নিষেধ করবার কোন কারণ ছিল না। কেননা, ওআইসির সাথে বা এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির সাথে (পাকিস্তান বাদে) ভারতের কোন বৈরি সম্পর্ক ছিল না; বরং, অনেকগুলি দেশের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। ভারতের এ ধরনের আবদার বঙ্গবন্ধুকে হতবাক করে। তিনি ভারতের নিষেধ অগ্রাহ্য করেন এবং ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানেও তিনি ভুট্টো সাথে দেখা করেন এবং হাত ধরে হাঁটেন। 

ইন্দিরা গান্ধীর ধারণা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে তারা একটা পাপেট বা পুতুল রাষ্ট্র হিসাবে পাবে, যেরকম ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পেয়েছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিকে। গণচীন এবং সৌদি আরবের স্বীকৃতি বিহীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৭১ এ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থানের ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থা তখন অত্যন্ত দুর্বল। তাই ভারতের চাপ মোকাবেলার কৌশল হিসেবে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কেননা, একমাত্র এ রাষ্ট্রটিই তখন ভারতের উপর প্রভাব বিস্তার করবার ক্ষমতা রাখত। 

ভারতকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগের বিষয়টি ভারতের পছন্দ ছিল না। ভারতকে পুরো অন্ধকারে রেখে তিনি আরো একটি বড় সিদ্ধান্ত নেন। এটি হল উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য তখন যে সোভিয়েত লাইন ছিল, সে লাইন অনুসরণ করে একদলীয় শাসন, বাকশাল কায়েম করা। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এক দলীয় শাসনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের তত্ত্ব হাজির করে। 

এ তত্ত্ব অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াই  নিজস্ব ধাঁচে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা সম্ভব বলে মনে করা হত। এর আলোকে তখন ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ আরো অনেক দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাথে রাখবার জন্য বঙ্গবন্ধু "মস্কোপন্থী" হিসেবে পরিচিত সিপিবি এবং ন্যাপকে (মো) বাকশালে বিলীন করেন। ভারতকে পাশ কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর এ ধরনের স্বাধীন অবস্থান ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। 

শুরু থেকেই বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের বিদেশ নীতিতে এক ধরনের স্ববিরোধিতা লক্ষ্যণীয় যার ধারাবাহিকতা এখনো বিদ্যমান। একদিকে তারা বঙ্গবন্ধুকে তাদের মিত্র সরকার বলত, আবার এমন সব নীতি অনুসরণ করত যেটা সাধারণত বৈরি রাষ্ট্রের সাথে করা হয়, যাতে সে সরকার অভ্যন্তরীণভাবে বিপদে পড়ে বা বিরোধী পক্ষের কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হয়।

বঙ্গবন্ধুকে যখন সদ্য স্বাধীন দেশে অর্থনীতি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তখন তার চলার পথকে আরো কঠিন করে দিয়ে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করে। এর প্রতিবাদে "ফারাক্কা বাঁধ, বাংলার মরণ ফাঁদ" শ্লোগান দিয়ে লংমার্চের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ান মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী।

রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর বিপরীত আদর্শের রাজনীতিতে বিশ্বাস করলেও তিনি সব সময় চেয়েছেন তার রাজনৈতিক শিষ্য মুজিব যাতে কখনো ব্যর্থ না হন। তাই ১৯৭০ এর নির্বাচনে "ভোটের আগে ভাত চাই" শ্লোগান দিয়ে তিনি কৌশলে তার দলকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন, যাতে বঙ্গবন্ধুর বিপুল বিজয় পেতে সমস্যা না হয়। ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল সেখানেও তিনি এমন ভূমিকা পালন করেন যা আখেরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দুটো ভিন্ন দলে থেকে গুরু শিষ্যের মাঝে এ ধরনের সম্পর্কের ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই।    

ভারতীয় লেখকেদের লেখা থেকে জানা যায় ভারতীয় সিক্রেট সার্ভিস 'র' এর বিভিন্ন উর্ধতন কর্মকর্তা ছদ্মবেশে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন তাকে হত্যার যড়যন্ত্রের কথা। কিন্তু  বঙ্গবন্ধু সেটা বিশ্বাস করেননি। প্রত্যেকবারই তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। এ বিশ্বাস না করবার কারণ দুটো। প্রথমত, তিনি মনে করেছেন এটা আসলে তাকে চাপে রাখবার একটা ভারতীয় কৌশল, যাতে তিনি ভারতের উপর মানসিক নির্ভরতা বাড়ান। দ্বিতীয়ত, তিনি কোনও অবস্থায় ভাবতে পারেননি, যে যেই রাজনীতেই বিশ্বাস করুক না কেন, কোনও বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে। আর এ জন্যই তিনি আধুনিক বিশ্বে এমন এক রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন যিনি সরকারি বাসভবনে না থেকে মাত্র কয়েকজন পুলিশের পাহারায় নিজের বাসায় থাকতেন। গণমানুষের উপর নির্ভরতা এবং তাদের কাছাকাছি থাকবার এমন মানসিকতা আধুনিক রাষ্ট্র ইতিহাসে বিরল।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। ভারতের কাছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যড়যন্ত্রের বিষয়টি জানা থাকলে, সেটি তারা একই সাথে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কেন অবহিত করেনি—এ বিষয়টি প্রশ্নবোধকই রয়ে গেছে। তবে, ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর যে বিষয়টি সবাইকে অবাক করে সেটি হলো, খন্দকার মোশতাক সরকারকে নিয়ে ভারতের কোন আপত্তি না থাকবার ইঙ্গিত দেওয়া। মোশতাক ভয় পাচ্ছিলেন ভারতের সাথে বাংলাদেশের মৈত্রী চুক্তি থাকবার ফলে ভারত হয়তো মোশতাক সরকারের বিরোধী কঠিন অবস্থান নিবে। তবে এর চেয়েও বিস্মিত শুধু নিবেদিত আওয়ামী লীগ সমর্থকরা নয়, দলমত নির্বিশেষে সবাই হয়েছে, সম্প্রতি যখন জানা গেছে বঙ্গবন্ধুর দুই হত্যাকারী বহাল তবিয়তে নানা সরকারি কার্ডের অধিকারী হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করেছে। 

একটি রাষ্ট্র তার বৈরি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যারা কাজ করে তাদেরকেই সাধারণত আশ্রয় দেয়। এখন যদি শোনা যায় ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে উৎখাত করবার ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত ছিল, তারা গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়নে আশ্রয় পেয়েছিল, বিষয়টা তখন যেমন শোনাবে—ভারতে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি দীর্ঘদিন ধরে ছিল—বিষয়টা অনেকের কাছে তেমনই শুনিয়েছে। 

ইন্দিরা গান্ধী ক্যু, পাল্টা ক্যু এর মাঝে ক্ষমতায় আসা জেনারেল জিয়াকেও দিল্লীতে উষ্ণ সম্ভাষণ জানান। আবার জিয়ার সময়েই তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে ভারতের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এ সময় আবার একই সাথে 'বঙ্গবীর' কাদের সিদ্দিকীকে জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলবার জন্য ভারতের মাটি ব্যবহার করবার সুযোগ দেওয়া হয়।

তবে, ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮৮ সালের প্রলংয়করী বন্যার সময় ভারতের ত্রাণ সাহায্য নিয়ে আসা একটি হেলিকপ্টার ফেরত পাঠিয়ে দেন এরশাদ। ফলে, গভর্নরদের অনেক সময় যেরকমভাবে তলব করে  রাজধানীতে ডেকে পাঠানো হয়, অনেকটা সেরকম ভাবে এরশাদকে দিল্লীতে ডেকে পাঠান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। 

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সময়কালে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়াতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে ইসলামিক রেটোরিক ব্যবহারকারী সরকারের সাথে সেক্যুলার দাবিদার ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক অনেকের মনে এ প্রশ্ন জাগায়- বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির স্বরূপটা আসলে কী? দেখা যাচ্ছে, যাদেরকে ভারতের মিত্র মনে করা হয় তারা যখন ক্ষমতায় থাকছেন, তখন ভারত এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে যেটা সাধারণত বৈরি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়। 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে তখন দেখা গেল সীমান্তে বিএসএফ তৎকালীন বিডিআরকে আক্রমণ করে বসে। আবার দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগকে কংগ্রেস এবং বিজেপি তাদের মিত্র হিসাবে বললেও বাংলাদেশ সম্পর্কে এমনসব নীতি নিচ্ছে যাতে দলটি আঞ্চলিক এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রবল চাপের মুখে পড়ে। 

একটি রাষ্ট্র যখন আরেকটি রাষ্ট্রকে তার মিত্র বা প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত ভাবে তখন সেই রাষ্ট্রটি উপরোক্ত রাষ্ট্রের নাগরিকদের সীমান্তে গুলি করে হত্যা বা তার চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ করে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সীমানা সংলগ্ন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির লোকদের প্রতি গুলি চালাত না, যেটি ভারত ক্রমাগত করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন নজির নেই যেখানে একটি দেশ তার মিত্র অথবা প্রভাব বলয়িত রাষ্ট্রের সীমানাতে দেয়াল বা বেড়া দিয়েছে।

মুখে মুখে তার মিত্রদল ক্ষমতায় আছে বললেও তিস্তা নদীর পানি বণ্টনসহ বিভিন্ন বিবাদমান বিষয় সমাধানের উদ্যোগ ভারত নেয়নি গত ১২ বছরেও। তাহলে দেখা যায়, ভারত একদিকে চাচ্ছে বাংলাদেশ তার প্রভাব বলয়ে থাকবে, সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী মিত্র হিসেবে গণ্য হবে। আবার একই সাথে সেই প্রভাব বলয়ভুক্ত দেশকে বৈরি রাষ্ট্রের মত ক্রমাগত সৃষ্ট নানা সমস্যায় ব্যতিব্যস্তও রাখবে; অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতি হচ্ছে স্ব-বিরোধিতাপূর্ণ "সোনার পাথর বাটির" মত। 

তবে সমস্ত বিষয়ে স্ব-বিরোধী নীতি থাকলেও একটি বিষয়ে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার সেটি হল- বাংলাদেশে যাতে কোন অবস্থাতেই কোন বামপন্থি দল ক্ষমতায় না আসতে পারে। এটি  ভারত ১৯৭১ সালেই স্পষ্ট করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সিপিবি, ন্যাপ (মো), ছাত্র ইউনিয়িনের "মস্কোপন্থি" বা মেনন, রনো, জাফরদের "পিকিংপন্থি"- এর কোনটাই যাতে শক্তিশালী হয়ে না উঠে সে বিষয়টাতে ভারত খুব সতর্ক ছিল। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বুন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত মনে করত বাংলাদেশে বামপন্থার উত্থান হলে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন জোরদার হবে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট জুজুর ভয় অন্য অনেক দেশের সরকারের মত ইন্দিরা গান্ধীকেও পেয়ে বসেছিল। বর্তমান বিজেপি সরকারের সাথে গান্ধীর কংগ্রেসের যতই মতবিরোধ থাকুক, এই একটি বিষয়ে একই নীতিতে দুই দলই এখনো বিশ্বাসী। দুই দলই চায় না ভারতে বা আঞ্চলিক রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের যাতে কোনভাবেই উত্থান ঘটে। বস্তুত, এই জায়গাটিতেই চীনের দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশ নীতি ভারতের সম্পূর্ণ বিপরীত।

গণচীনের বাংলাদেশ নীতির বিবর্তন 

ভারতের বিপরীতে ১৯৭১ সালে মাও সে তুঙের গণচীন আমেরিকার সাথে সুর মিলিয়ে সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচে ছিলেন গণচীন বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন বাকশাল ক্ষমতাচ্যুত হবার পর মাওয়ের গণচীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থানের মূল কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান, আর এর বিপরীতে পাকিস্তানকে গণচীনের মিত্র মনে করা। 

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পাকিস্তান মাও এর গণচীনের সাথে গাঁটছাড়া বাধে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গণচীন তখন অনেকটা বিছিন্ন। নিকিতা ক্রুসচেভের পুঁজিবাদী দুনিয়া তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তত্ত্বের সূত্র ধরে মাও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিরোধে জড়ান। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে স্তালিন নিজেই আমেরিকার সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি অনুসরণ করে আসছিলেন। অনেকে মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সীমানা নিয়ে বিরোধ এবং স্তালিন-উত্তর যুগে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে এটা নিয়েই মাও ক্রুসচেভের সাথে বিবাদে জড়ান। 

এ বিরোধের জের ধরে মাও সে তুং সোভিয়েত পার্টি লাইনকে ভুয়া কমিউনিজম আখ্যায়িত করে সাচ্চা কমিউনিস্টদের বেরিয়ে এসে নতুন করে দল গড়ে তোলবার আহ্বান জানান। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত—যে সমস্ত সব জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টি তখন ক্ষমতায় ছিল না- তার প্রায় সবগুলিতেই ভাঙ্গন ধরে। কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঠেকাবার চিন্তায় সেসময় পুঁজিবাদী বিশ্ব অস্থির ছিল। মাও এর আহ্বানে সারা দুনিয়াতে বাম আন্দোলনের ভাঙ্গন পাশ্চাত্য দুনিয়ার শাসকবৃন্দের জন্য সেদিন এক বড় স্বস্তি বয়ে এনেছিল। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লড়াইয়ের আহ্বানের মাধ্যমে যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিরোধে জড়িয়ে সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলন তছনছ করে দিলেন, সেই মাও আবার এক দশক পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে হেনরি কিসিঞ্জার এবং রিচার্ড নিক্সনকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানান। নিক্সনের ৭ দিনের গণচীন সফরে তাকে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কঠিন সোভিয়েত বিরোধী অবস্থান নিয়ে মাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুঁজিবাদী বিশ্বের যে উপকার করেন নিক্সন তার সফরে সেজন্য মাও-কে প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হননি।

মাওয়ের মৃত্যুর পর দেং শিয়াও পিং লেনিনের "নয়া অর্থনৈতিক নীতির" আলোকে মাও অনুসৃত সম্পূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে অর্থনীতি পরিচালনার ধারা থেকে দেশকে বের করে নিয়ে এসে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন, এবং বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করেন। একে তিনি "চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্র" আখ্যায়িত করেন। এসময় জিয়া সরকারের সাথে গণচীনের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীতে সব সরকারই এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। জিয়া, এরশাদ সরকারের আমলে সোভিয়েত বিরোধী মার্কিন-সৌদি ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির সাথে গণচীনের সোভিয়েত বিরোধী নীতির কোনও বিরোধ ছিল না। 

দেং-এর নীতি অনুসরণ করে চীন বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যস্ত থেকেছে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে। কেননা দেং মনে করতেন, বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হলে আগে নিজেদের শক্ত পায়ের উপর দাঁড়াতে হবে। বর্তমান সময়ে এসে চীন মনে করতে শুরু করেছে, তারা আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে চীন বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

চীনের প্রভাব যত বাড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপ বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে ততই কোণঠাসা হচ্ছে। শীতল যুদ্ধের সময় চীন সোভিয়েত ইউনয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতের উত্তরাধিকার রাশিয়ার সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাশ্চাত্যকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ফলে এশিয়াতে চীনকে ঠেকাবার জন্য তারা যেকোনও মূল্যে ভারতকে পাশে পেতে চাচ্ছে। আর এর বিপরীতে চীন বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে তার পাশে চাচ্ছে। 

দক্ষিণ এশিয়াতে চীন পশ্চিমে পাকিস্তান এবং পূর্বে মিয়ানমারকে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি ষাটের দশকের গোড়া থেকেই নিরবিছিন্নভাবে চীন-কেন্দ্রিক। বর্তমান সময়ে তারা মার্কিন নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমশ রাশিয়ামুখী হবার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের বিদেশ নীতি আগাগোড়াই ভারত বিরোধী। গণচীন চাচ্ছে বাংলাদেশ তার ভারসাম্য নীতি থেকে বেরিয়ে এসে ভারত-মার্কিন বিরোধী এবং চীন-রাশিয়া কেন্দ্রিক পররাষ্ট্র নীতির দিকে আগ্রসর হোক।  বাংলাদেশের এ ধরনের বিদেশ নীতি দক্ষিণ এশিয়ায় তার স্বার্থের অনুকূল।  

গণচীন আজকে বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন ডলারের মত। চীন থেকে এ ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে চীন-মুখী হলে অবকাঠামো খাতে চীনের বিনিয়োগ আরো অনেক বেশি বাড়ানো হবে। কিন্তু একই সাথে চীন এ বিষয়টাও উপলব্ধি করেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই পুরো মার্কিন-ভারত বিরোধী অবস্থানে গিয়ে শুধু  চীন-রাশিয়া কেন্দ্রিক হবে না। 

এক্ষেত্রে চীন যে বিষয়টা উপলব্ধি করছে সেটা হলো, বাংলাদেশে শক্তিশালী "চীনপন্থি" ধারার অনুপস্থিতি। রাজনীতিতে এ ধারার শক্তিশালী উপস্থিতি সরকারের নীতি নির্ধারণে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি জোরালো ভারতবিরোধী ভুমিকাও নিতে পারে। ষাট এবং সত্তর দশকের মাঝামাঝি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এ ধারা জোরদার ছিল। ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপ বিএনপিতে বিলীন হয়ে গেলে এ ধারা প্রান্তিক অবস্থানে চলে যায়।   

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় আসবার পর ভারতবিরোধী শক্ত অবস্থান নেওয়াতে চীন মনে করছে, বাংলাদেশে বামপন্থার শক্তিশালী অবস্থান এ অঞ্চলে চীনের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। ভারতের সব ঘরানার বামপন্থি দলগুলো যেহেতু চীনের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাই কেন্দ্রিয় সরকারকে চাপে রাখবার জন্য ভারতেও চীন বাম দলগুলোর অধিক ভূমিকা দেখতে আগ্রহী। বস্তুত এ সমস্ত সমীকরণ মাথায় রেখে গণচীন সম্প্রতি সিপিবির সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে।  

সিপিবির "চীনপন্থা"

যতদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে ছিল সিপিবি ততদিন "মস্কোপন্থি" দল হিসেবে পরিচিত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর দলটি এক ধরনের "অভিভাবক বিহীন" অবস্থায় পড়ে। নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড হতাশা থেকে দলে ভাঙ্গন, অনেকের নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়া-এ অবস্থার মধ্যে দিয়ে দলকে যেতে হয়। এমতাবস্থায় শেষ পর্যন্ত দল টিকে থাকবে কিনা, এ  প্রশ্নও দেখা দেয়। তবে "অভিভাবকহীনতার" যে সঙ্কট সিপিবিতে ছিল তা কাটতে শুরু করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণচীনের সাথে পারষ্পারিক যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে।

গণচীন যখন মুক্তবাজার নীতি নেয় তখন পশ্চিমা মিডিয়া খুব উল্লসিত ছিল এ ভেবে যে, চীনে পুঁজিবাদের জয় হয়ে গেছে। কিন্তু সে পশ্চিমই আজ আবার ভয় পাচ্ছে চীন যখন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সেসময় যে বিষয়টা পাশ্চাত্য বিবেচনায় নিতে চায়নি সেটা হলো, চীনে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় থাকবার বিষয়টি। আজ পর্যন্ত কোন দলিলে এ পার্টি  বলেনি যে, চীনে এবং বিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তার যে লক্ষ্য, সেখান থেকে সে সরে এসেছে। বরং দলটি বারবার এটি বলে আসছে, সমাজতন্ত্রে পৌঁছাবার একটা কৌশল হিসেবে পুঁজিবাদী পথে তাদের এ হাঁটা সাময়িক, এবং এটা লেনিনের নীতি অনুসরণ করেই। ফলে, আজকে চীন আবার বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টিগুলির সাথে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে সাবেক মস্কো এবং পিকিং, দুই "পন্থি" দলের সাথেই যোগাযোগ তৈরি করছে। 

সিপিবিতে "চীনপন্থার" ধারা বৃদ্ধির সাথে সাথে একটা গুণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, বিশেষত তরুণ নেতাকর্মীদের মাঝে। তারা সিপিবি আওয়ামী লীগের বি টীম এবং ভারতের প্রতি নমনীয়, এ ধারণা থেকে দলকে বের করে আনতে চাচ্ছে। হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে "পিকিংপন্থীদের" একটি ধারা সিপিবিতে বেশ আগেই যোগ দিয়েছেন। ওয়াকার্স পার্টি থেকে সম্প্রতি বের হয়ে আসা বিমল বিশ্বাসের দলকে সিপিবিতে যোগ দেওয়ানো যায় কিনা এ নিয়ে কথাবার্তা চলছে। রনো সিপিবিতে আসবার পর তরুণ কর্মীদের মাঝে মাও নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।    

সিপিবি সাম্প্রদায়িকতার জায়গা থেকে নয়, নেপালের মত সেক্যুলার অবস্থান থেকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রশ্নে ভারত বিরোধী অবস্থান নিতে চায়। এছাড়া সিপিবি সবসময়ই কট্টর মার্কিন বিরোধী। গণচীনের আগ্রহ এ জায়গাটিতেই। গণচীন চাচ্ছে নেপালের মত  ভারত-মার্কিন বিরোধী একটি শক্তিশালী সেক্যুলার বামধারার উত্থান বাংলাদেশে ঘটুক।

কিন্তু এখন পর্যন্ত বাস্তবতা হচ্ছে ভারত এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী মূল ধারাটা মুসলিম জাতীয়াতাবাদী এবং "ইসলামপন্থী"। তবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা বাস্তবতায় এ ধারার নিষ্ক্রিয়তার ফলে বিরোধী রাজনীতিতে একটা শুন্যতা তৈরি হয়েছে। এ শুন্যতা সিপিবি কতটুকু পূরণ করতে পারবে তার উপরেই নির্ভর করছে আগামীদিনে বাংলাদেশে "চীনপন্থি" বাম ধারা দাঁড়াবার বিষয়টি।