ফিরে দেখা: প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চট্টগ্রাম সফর

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী
Published : 29 Jan 2012, 09:07 AM
Updated : 2 Sept 2020, 08:38 AM

শীতের ‍সকালে উত্তরের পাহাড় ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজসাজ রব। অদূরে জালালাবাদ পাহাড়ের চূড়ায় সেদিনের সকাল সোনালী আভায় রাঙা। কুয়াশার চাদর ভেদ করে যে আলো সবুজ ছুঁয়ে গেল বেলা গড়াতেই তা ঔজ্জ্বল্য ছড়ালো অন্য মহিমায়। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর 'ভারতীয় গণতন্ত্র'র ধারার অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম প্রণব মুখোপাধ্যায় শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে সেই জরুরি প্রশ্নটি তুললেন। এ উপমহাদেশে যাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর কেন বারবার হিংসাত্মক আক্রমণ?

বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি কেন? কোন সামাজিক প্রেক্ষাপটে সৈন্যরা বারবার ব্যারাক থেকে বের হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল?- প্রাসঙ্গকি এই দুটি প্রশ্নও তুললেন গুরুত্বের সাথে।

জানুয়ারি ২০১৮, দুই দিনের সফরে চট্টগ্রামে এলেন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। যিনি এখন পর্যন্ত ভারতের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্র প্রধান। বাঙালি জাতিসত্তার ধারক এবং এই পরিচয় যার পুরো রাজনৈতিক জীবনের পথচলায় বারবার মুখ্য হয়ে আলোচনায় এসেছে। যদিও জাতি বা ভাষা পরিচয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভারতীয় পরিচয়কে ডিঙিয়ে যায়নি।

বাংলার মাটিতে পা রেখে বিশ্বজনীনতার চেতনাকেও ধারণ করতেন। নিজের ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধ মগ্নতা এবং এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতি সশ্রদ্ধ অভিনিবেশ তাকে সর্বোচ্চ সাফল্যে পৌঁছে দিয়েছিল।

বিপ্লব তীর্থ চট্টগ্রামে আসার আগ্রহ ছিল মূলত যুব বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ও বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতিধন্য স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন বলে। জীবন সায়াহ্নে পুণ্যভূমি ছুঁয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন। নোয়াপাড়ায় সূর্য সেনের জন্মভিটা ঘুরে দেখেছেন। রাউজান কলেজের পাশে মাস্টারদা সূর্য সেন স্মৃতি ভবনে গেলেন। সেখানে মাস্টারদার আবক্ষ ভাস্কর্যে ভাস্কর্যের সামনে নত মস্তকে প্রণতি জানালেন। 'মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান' উৎকীর্ণ স্মৃতি ফলকটির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন। যেন এসবের মাঝেই খুঁজে ফিরলেন বিপ্লবীদের স্মৃতিকে।

চট্টগ্রামে আসার মনোবাসনার কথাটি অকপটে জানিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ‍ভূমিকাকে স্মরণ করে তাই স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন সেই ইচ্ছে পূরণ হওয়ায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ভারতীয় দূতাবাস আয়োজিত সংবর্ধনায় দেয়া দুটি বক্তব্য যেন একটি বক্তব্যেরই দুই অংশ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক ধারার প্রতিবন্ধকতা ও অর্জন, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কের পথরেখা সর্বোপরি ভবিষ্যতে বৈশ্বিক সংকট ‍উত্তরণের উপায়- এসবই ছিল দুই বক্তৃতায়। জানিয়ে দিয়েছিলেন নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা লব্দ পরামর্শও।

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ভূমিকা স্মরণ করে বলেছিলেন- "যেমন অবিভক্ত ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনে চট্টগ্রামের মানুষের একটা বিপুল ভূমিকা ছিল, ঠিক তেমনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রামের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশে আসাটা পূর্ণ হতো না।"

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যখ্যা করেছিলেন এভাবে, "একটা দেশের স্বাধীনতা, তার স্বজাত্য বোধ গড়ে উঠতে সময় লাগে। বাংলাদেশও সময় নিয়েছে, তবে সময়টা অনেক কম। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের সম্পূর্ণ সংযুক্তি তো পাকিস্তানের সাথে হয়নি। প্রথম থেকেই একটা বাধা রয়ে গিয়েছিল, সেটা ভাষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে।"

ভাষার দাবি উত্থাপনকারী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাহসী ভূমিকার জন্য শ্রদ্ধা জানিয়ে ভাষাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সেই স্বজাত্যবোধের প্রকাশেই যে স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে তা জানাতে ভোলেননি।

পোড় খাওয়া এই রাজনীতিবিদ যিনি ভারতীয় রাজনীতির পরিমণ্ডলে 'চাণক্য' নামে খ্যাত, সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি-লিট গ্রহণ করে একটি মোক্ষম প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা, শ্রীলঙ্কার সলোমন বন্দরনায়েক ও রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসা এবং পাকিস্তানের জিয়াউল হক ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ টেনে প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, "এ উপমহাদেশে যাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল সে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর কেন বারবার হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছে তা জানতে হবে।"

শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের জাতির পিতাকেই হত্যার কথা উল্লেখ করে বিশ্বের নজিরবিহীন এই বিপুল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের নেপেথ্যের কারণ এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট খুঁজে বের করার তাগাদা দিয়েছিলেন গবেষকদের। এই সত্য জানতে চাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে প্রণব মন্তব্য করেছিলেন, "রাস্তা যদি চিনি তাহলে চলা শক্ত হবে না।" গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে হলে এসব প্রশ্নের উত্তর জানাটা কেন জরুরি তার কারণ ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, "বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে আর্থিক, সামাজিক প্রগতি বাস্তবায়ন করেছে। অথচ এ দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর বেশি হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছ, কারণ কী?"

কোন সামাজিক প্রেক্ষাপটে সৈন্যরা বারবার ব্যারাক থেকে বের হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারী নেতৃবৃন্দই কেন তাদের লক্ষ্য হয় এ বিষয়টির পূর্বাপর সন্ধানের জন্য শিক্ষক-গবেষকসহ সবাইকে গবেষণার আহ্বান জানিয়ে প্রকারান্তরে সকলকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক ধারার প্রতি প্রণব মুখার্জির অবিচল আস্থার বিষয়টি এতে প্রকাশিত হয় স্পষ্টভাবে।

ভিন্ন রাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও বাংলাদেশের মানুষের সাথে বাঙালি পরিচয়ে তিনি একাত্মতা বোধ করতেন। উপমহাদেশের দেশগুলোতে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য মানুষে মানুষে সম্পর্কের ওপর জোর দিতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এতেই রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুসম্পর্কের সূত্র নিহিত বলে বিশ্বাস করতেন। আবার বিশ্বজনীনতার বৃহৎ পরিসরে ভাবনার তাগাদা দিয়ে বলেন, "আমি বিশ্বের অন্যতম অংশ, যত ক্ষুদ্র অংশই হই। আমাকে বাদ দিয়ে বিশ্ব নয়। সেই ইউনিভার্সালিজম সেটাই আমাদের সমাজ রাষ্ট্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।"

মানুষে-মানুষে হিংসা-দ্বন্দ্ব, জাতিগত সংঘাত, সন্ত্রাসবাদের বিস্তারে আতঙ্কিত প্রণব মুখোপাধ্যায় পরিবেশ দূষণের চেয়েও মানুষের চিন্তা-ভাবনা-মননের দূষণের ভয়াবহতাকে 'অনেক বড়' করে দেখতেন। কোনো সংঘ-সংস্থা নয় সৃষ্টিশীল মানুষের ঐক্যই এই সংকট থেকে মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সকলের মাঝে।

একজন আপাদমস্তক বাঙালি যিনি স্বমহিমায় হয়ে উঠেছিলেন এক বিশ্ব নাগরিক রাজনীতির মাঠে তার নানা সমালোচনা থাকতে পারে, আছেও। সংকট উত্তরণে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দক্ষতা সর্জনবিদিত। চট্টগ্রামের বিপ্লবী ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালনকারী শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অভাব দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রকামী শক্তি বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো বেশি করে অনুভব করবে। সেই পদচিহ্ন তিনি এঁকে যেতে পেরেছেন। জয়তু প্রণব মুখোপাধ্যায়।