পুলিশনামা: পুলিশের অপকর্মের রেফারেন্স বই

আবু সুফিয়ান_অনুসন্ধানী প্রতিবেদক
Published : 23 August 2011, 11:09 AM
Updated : 23 August 2011, 11:09 AM

ক'দিন আগে বিডিনিউজ২৪কম এর ব্লগে হংকং এর ইনডিপেনডেন্ট কমিশন এগেইনস্ট করাপশন বা আইসিএসি'র তৈরী করা একটি জাদুঘর এর কথা বলছিলাম। যে জাদুঘরে সে দেশের দুর্নীতিবিরোধী বড় বড় সাফল্যের দলিল দস্তাবেজ রয়েছে। আজ এমনই একটি বিষয় প্রস্তাব করছি।

প্রস্তাবনা পুলিশ বাহিনীর জন্য!
পুলিশ নিয়ে নানা অভিযোগ, নানা গল্প সবারই জানা। এ বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে তাদের নানা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ভালো-মন্দ শেখানো হয়। খারাপ কাজের ফল সম্পর্কেও শেখানো হয় বলে জেনেছি। বিষয়টা খু্বই ভালো। কিন্তু, এর সাথে একটা রেফারেন্স বই হলে মন্দ হতো কি? আর রেফারেন্স বইটা হলো, পুলিশের সবচেয়ে আলোচিত অপকর্মের বাছাই করা ঘটনার কথা। বইতে থাকবে কারা এসব কাজ করেছিলো, কি ফল হয়েছিলো ইত্যাদি! ফলে নতুন যারা এই পেশায় আসবে তাদের কেউ যদি কোন অপকর্ম করে, তার আগে হয়তো ভেবে দেখবেন এর পরিণতি কি হতে পারে! এমনটা কি করা যায় না? চলুন মোটা দাগে জেনে নেই যারা পুলিশে যোগ দেন সেসব নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণে কি পড়ানো হয়।

প্রশিক্ষণ:
"ঘাস কাটতে কাটতেই কবে যে ছয় মাস কেটে যায় টেরই পাওয়া যায় না। কেউবা বাগান করে। আগাছা নিংড়ায়। মাটি কাটে। আর 'ছয়-মাস' প্রশিক্ষণের শেষ বেলায় পুরনো নেড়ে দেখানো হয় মরচে পড়া অস্ত্রশস্ত্র। বইপত্র? কিছুই না! এভাবেই শেষ হয় কনস্টেবলদের প্রশিক্ষণ।" বললেন একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "কনস্টেবলদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানো উচিত। মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো উচিত। এসব হচ্ছে না বলেই মাঝে মাঝে কেউ কেউ অপকর্ম করে"। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন কর্মকর্তা বললেন, "ঘাস কেটে কি আইন শৃংখলা কাজে ভালো করা যায়"।

এটা হলো কনস্টেবল পদে যারা পুলিশে যোগ দেন তাদের প্রশিক্ষণের সার কথা। তবে, প্রভেশনাল সাব ইন্সপেক্টর বা 'পিএসআই'দের প্রশিক্ষণ অনেকটাই লম্বা। তিন বছর! এক বছর সারদা পুলিশ একাডেমিতে এবং পরের দুই বছর মাঠে। হাতে-কলমে। আর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে যোগ দেন যারা, তাদের প্রশিক্ষণ দেড় বছর। এর মধ্যে সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছর। পরের ছয়মাস হাতে কলমে প্রশিক্ষণ। এক কর্মকর্তা জানান, "এই প্রশিক্ষণে বিস্তারিত বিষয় পড়ানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে সমাজ বিজ্ঞান, মানবাধিকার, নৃতাত্ত্বিক গঠন ইত্যাদি। " অর্থাৎ একজন ভালো অফিসার হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যাবতীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলেও জানান কেউ কেউ। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, "জনগণ পুলিশের কাছে কি চায়? কেমন সেবা চায়? তার বিস্তারিত দিকগুলো পড়ানো হয়। শেখানো হয় হাতে কলমে। শেখানো হয় সমাজ কাঠামো। সমাজের নানা বর্ণের মানুষের পরিচয়। তাদের বেড়ে ওঠা। জাতপাত। ছোট বড়। সবকিছু। শেখানো হয় মানবাধিকারের নানা দিক।"

কনস্টেবলরা কিছু শেখে না বলেই কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ে নানা খারাপ কাজে। বেতন কাঠামো নিয়েও রয়েছে নানা কথা। এমন অজুহাত দেন অফিসাররা। কিন্তু, যারা অফিসার পদে যোগ দেন তাদেরকে তো শেখানো হয় বিস্তারিত বিষয়।

চলুন কয়েকটি ঘটনা একটু মনে করার চেষ্টা করি।

একুশে আগস্ট মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা: সাবেক তিন আইজি গ্রেফতার
২০০৪ সালের ২১শে আগষ্ট শেখ হাসিনার মহাসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায় নিষিদ্ধ উগ্র সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-বাংলাদেশ বা হুজি-বি। এ মামলাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোঃ আশরাফুল হুদা, খোদা বখস্ চৌধুরী ও শহুদুল হক এর বিরুদ্ধে। একই অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা মুন্সী আতিক এবং রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে। এ মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির দেয়া সম্পূরক চার্জশিটের ৩০ জন আসামির মধ্যে এই তিনজন সাবেক আইজিপি রয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন আইজিপিসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গত ৩রা জুলাই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরোয়ানা জারির একদিন ৪ঠা জুলাই আদালতে আত্মসমর্পন করেন সাবেক এই তিন আইজিপি। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে এ হামলা চালানো হয়েছিলো। র্ঊধ্বতন পুলিশ র্কমর্কতা হিসেবে সেদিন তাদের দায়িত্ব ছিলো তা প্রতিরোধ করা। অথচ তারা একবারও ঘটনাস্থল যাননি। বরং ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তারা তিনজনই বিভিন্ন মেয়াদে পুলিশের আইজিপি ছিলেন।

ওসি রফিকের ফাঁসি:
বহুল আলোচিত কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম মোমিন হত্যার দায়ে প্রধান আসামি সাবেক ওসি রফিকুল ইসলামকে গত ২০শে জুলাই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। রায়ে বলা হয়, পুলিশের দুই বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব সন্ত্রাসীকে বাঁচানোর জন্য আসামিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহারের চেষ্টা করে। এ সময় আদালত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের তিরস্কার করে।

বাড়ির সীমানা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২০০৫ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর জাসদ ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর নেতা, ঢাকা কর্মাস কলেজের ছাত্র মোমিনকে তাদের ১৫৫ উত্তর ইব্রাহিমপুরের বাসার সামনে খুন করে দুষ্কৃতকারীরা। এ ঘটনায় মোমিনের বাবা আবদুর রাজ্জাক ওসি রফিকসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ওই খুনের ঘটনায় প্রথম তদন্তে মতিঝিল থানার তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলামের সম্পৃক্ততা পুলিশ এড়িয়ে গেলেও পরে বিচার বিভাগীয় তদন্তে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

বিচারকের পর্যবেক্ষণ : দণ্ড ঘোষণার আগে বিচারক রেজাউল ইসলাম বলেন, এ মামলার আসামি ওসি রফিককে বাঁচানোর জন্য অনেক পুলিশ কর্মকর্তা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। এ কাজে পুলিশ সদস্যদের কোনো ধরণের লজ্জার বালাই ছিলো না।

হরতালে হামলা, মাজহার ও কোহিনূর মিয়া বরখাস্ত
২০০৯ সালের ৪ঠা অক্টোবর পুলিশের কর্মকর্তা মাজহারুল হক এবং কোহিনূর মিয়াকে সাসপেন্ড করা হয়। ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এই দুজনের বিরুদ্ধে। শাহীন সুলতানা শান্তা নামের ধানমন্ডির এক বাসিন্দা ২০০৬ সালের ২৪শে মার্চ ঢাকা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। শান্তার স্বামী সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।

অভিযোগে তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ১২ই মার্চ আওয়ামী লীগের হরতালের দিন তাকে ধরে নিয়ে রাপা প্লাজার সামনে পেটানো হয়। তিনি বলেন, সেদিন তিনি তার ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছিলেন।
এসপি কোহিনূর মিয়ার বিরুদ্ধে র্চাজশিট ও গ্রেফতারি পরোয়ানা

ময়মনসিংহের সাবেক এসপি কোহিনূর মিয়ার বিরুদ্ধে গত ১০ই আগস্ট হত্যা মামলার চার্জশিট গ্রহণ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ময়মনসিংহের ৪ নং আমলী আদালত। কোহিনূর মিয়া পলাতক। অভিযোগে বলা হয়, ময়মনসিংহের এসপি থাকাকালে, এসপি কোহিনূর মিয়া ২০০৪ সালে ৯ই মে ময়মনসিংহের নান্দাইল পৌর নির্বাচনে আচারগাঁ ভোট কেন্দ্রে তার পিস্তল দিয়ে গুলি করে আবু তাহের ও সুজন নামে দুইজন ভোটারকে হত্যা করে। সিআইডি এ হত্যা মামলাটি তদন্ত শেষে এসপি কোহিনূর মিয়ার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়।

চাঁদাবাজি
রাজশাহীতে এসিসহ ৮ পুলিশ গ্রেফতার
রাজশাহীতে চিকিত্সক দম্পতিকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের ঘটনায় রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার ও দুইজন এসআই'কে সাময়কিভাবে বরখাস্ত করার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
নোয়াখালিতে গণপিটুনীতে সহায়তাকারী

গণপিটুনীতে সহায়তার অভিযোগে পুলিশের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। গত ২৭শে জুলাই নোয়াখালি জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় গণপিটুনীর নামে মিলন নামে এক যুবককে খুন করা হয়।এ খুনে সহায়তা করার অভিযোগে সাব ইনসপেক্টর আকরাম উদ্দিন শেখ এবং কনস্টেবল আবদুর রহিম এবং কনস্টেবল হেমারঞ্জন চাকমার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়।অভিযোগে জানা যায়, ১৬ বছরের মিলনকে ডাকাতির নামে জনতার হাতে তুলে দেয় পুলিশ সদস্যরা। এ ঘটনার কিছু দিন আগেই ঢাকার সাভারে শবে বরাতের রাতে কেবলার চরে গণপিটুনীতে পুলিশের সহায়তার অভিযোগ পাওয়া যায়।

থানা হেফাজতে মৃত্যু
থানা হেফাজতে মৃত্যু তো অতীতে অনেক হয়েছে! গত বছর শরীয়তপুরের এক থানায় এক যুবককে পিটিয়ে খুন করা হয়। এমন ভুরি ভুরি ঘটনা থেকে কিছু ঘটনা এবং এর সাথে দায়ীদের কি শাস্তি হয়েছে তা এই পুস্তকে দেয়া যেতে পারে।

রেফারেন্স বই
একের পর এক ঘটনা ঘটলেও, সচেতন যেনো হচ্ছে না কেউ! চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ। এমন কোন অপকর্ম নেই যার অভিযোগ ওঠেনি পুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রমাণও হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে। কিন্তু, কিছুদিনেই সবাই ভুলে যায়! আর তাই, পুলিশের প্রশিক্ষণে এমন পুস্তক প্রণয়ণ করে তা পাঠদানের হলে মন্দ হতো না! এ পুস্তকে বড় বড় অপকর্মের বর্ণনা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে শাস্তির কথাও! প্রস্তাবিত পুস্তকে এসব ঘটনার সচিত্র বর্ণনা থাকতে পারে। রায়ের কপিও সংযুক্ত করা যেতে পারে। রায়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণ এবং এর সহজ ব্যাখ্যাও 'বাংলা'য় যুক্ত করা যেতে পারে। এটা হতে পারে পুলিশের
অপকর্মের রেফারেন্স বই।

পুলিশ নিয়ে নানা কৌতুক প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, সারদা পুলিশ একাডেমিতে অশ্ব চালানোর সময় ঘোড়াও নড়ে না। মুখে টাকা গুজে দিলেই তারা নড়ে! এমন সব অভিযোগ থেকে বের হয়ে জনগনের সেবক হিসেবে পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হোক!