সত্যি কি শত্রুমুক্ত হয়েছিলাম?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 2 Jan 2012, 01:07 PM
Updated : 3 Dec 2019, 08:13 AM

ডিসেম্বর মাস এলেই আমরা অনেকেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। কারণ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। তবে ১৬ ডিসেম্বরের আগেই দেশের অনেক অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়েছিল। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের মুক্তিবাহিনী বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছিল মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে। মানুষ মুক্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। নয় মাসের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছিল। দূর হয়েছিল সব দ্বিধা-দোদুল্যমানতা। একাত্তর ছিল বাঙালির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের সময়। একাত্তরের নয় মাস বাঙালির জীবনে যে আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য রচিত হয়েছিল, তা এক কথায় তুলনারহিত। অমন সময় জাতির জীবনে আর কখনও আসবে।

ডিসেম্বর এলে আমিও স্বাভাবিকভাবেই তারুণ্যদীপ্ত হয়ে উঠি। মনে হয় আমি বুঝি সেই কলেজপড়ুয়া তরুণই আছি। হ্যাঁ, একাত্তরে আমি যখন দিনাজপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র, তখনই শুরু হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ' এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। তারপর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা শুরু করে নৃশংস গণহত্যা। নিরস্ত্র বাঙালি রুখে দাঁড়ায়, 'যার যা আছে' তা-ই নিয়ে শুরু করে প্রতিরোধ যুদ্ধ। অসহায় বাঙালি জাতির পাশে এসে দাঁড়ায় প্রতিবেশী ভারত। ভারত চরম বিপদের দিনে আমাদের আশ্রয় দেয়, খাদ্য দেয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রও দেয়। এক অসম যুদ্ধে আমাদের জয় ছিনিয়ে আনতে যা যা করা দরকার তার সবই করে ভারত, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

বাংলাদেশের যে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, তারমধ্যে আমিও ছিলাম। কি দুঃসহ সেই উদ্বাস্তু জীবন! উদরপূর্তি এবং মাথা গোঁজার একটু ব্যবস্থার জন্য কি প্রাণান্ত সংগ্রাম। প্রাণের মায়ায় ভিটেমাটি ছেড়ে গিয়েও রোগব্যাধি আর অনাহারে কতজনকেই তো প্রাণ দিতে হয়েছে। আমি নিজের চোখেই কত মানুষের অসহায় মৃত্যু দেখেছি। শরণার্থী শিবিরে কত মানুষ, কত শিশু মৃত্যুবরণ করেছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যানও আসলে আমাদের নেই। কেমন ছিল শরণার্থী শিবিরের সেই জীবন, তারও কি তেমন কোনো প্রামাণ্য দলিল আছে আমাদের? অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে এই শরণার্থীদের ভূমিকা ছিল প্রভাববিস্তারী। মানুষের জীবনে দুঃখদিন দীর্ঘ হয় না। রাতের শেষে ফোটে দিনের আলো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাংলার 'বিচ্ছু পোলাপান'দের কাছে পাকিস্তানি 'ভোমা ভোমা মছুয়া সোলজার'রা নয় মাসেই পরাভূত হয়। আমার নিজের জেলা পঞ্চগড় এবং আমার আবাসস্থল বোদা থানা হানাদার মুক্ত হয়েছিলো ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে। আমি ভারত থেকে বোদা ফিরি ৩ ডিসেম্বর। আমি অবশ্য শরণার্থী শিবিরে ছিলাম না। পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটের পতিরামপুরের কাছাকাছি এক আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলাম। সেখানে ভারতীয় এক সেনাকর্মকর্তার সঙ্গে আমার কেমন করে যেন বেশ ভাব হয়েছিলো। নানা বিষয়ে আমার জানার আগ্রহ, রাজনীতি নিয়ে কৌতূহল দেখে তিনি হয়তো আমার প্রতি মনোযোগী হয়েছিলেন। তিনি আমাকে নানা ধরনের খবর দিতেন। নভেম্বরের শেষ দিকে তিনি আমাকে বলেন, দিন কয়েকের মধ্যে আমি দেশে ফিরতে পারবো। ৩০ নভেম্বর হিলি সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হলো। ওই সামরিক কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, তোমার পঞ্চগড় মুক্ত। আমিতো আনন্দে দিশাহারা।

পরিবারের কাউকে কিছু না বলে আমি ২ ডিসেম্বর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সারাদিন সড়ক পথে নানা মাধ্যমে শিলিগুড়ি পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেলো। যখন মানিকগঞ্জ সীমান্ত অতিক্রম করলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। পথঘাট খুব চিনি না। তবে বাড়ি ফেরার তীব্র টানে হাঁটতে শুরু করলাম। শীতের সময়। সঙ্গে শীতবস্ত্র ছিলো না। তবে হাঁটার কারণে তেমন গরম লাগছিলো না। কয় ঘণ্টা হেঁটেছি, বলতে পারবো না। এক সময় ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসছিলো। আর চলতে পারছিলাম না। দীর্ঘ পথে আমি একা পথিক। অবসন্ন শরীর যখন নেতিয়ে পড়ছিলো, তখনই দেখতে পেলাম কয়েকজন হাটফেরত মানুষ। তাদের মধ্যে একজন আমাকে চিনতে পারলেন। জানলাম, ওই জায়গার নাম মন্ডলহাট। আমার বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূর। বোদা হাটবার ছিলো সেদিন, বুধ অথবা শনিবার। যাদের দেখা পেলাম তারা বোদা হাট করে মন্ডলের হাটে ফিরছিলেন নিজের বাড়িতে। হ্যারিকানের আলো মুখে ধরে আমাকে যিনি চিনতে পারলেন, তিনি তার বাড়িতে যেতে বললেন। অনতিদূরে তার বাড়ি জেনে আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলাম। কারণ আমি আর চলতে পারছিলাম না।

কোনো রকমে পা টেনে টেনে তার বাড়ি পৌঁছে যে আতিথেয়তা পেলাম তা সারাজীবন মনে থাকবে। পানি গরম করে দিলেন হাত-পা ধোয়ার জন্য। তারপর গরম দুধ-চিড়া দিয়ে নাস্তা। অতো রাতে মুরগি জবাই দেওয়া হলো। শীতের রাতে গরম গরম খাওয়া। এরমধ্যেই ফাঁকেফাঁকে নয় মাসের টুকটাক গল্প। এখন আমি ওই ভদ্রলোকের নাম মনে করতে পারছি না। তবে তার সেদিনের কথাগুলো এখনও কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, বাবু, আপনারা তো হিন্দুস্থানে গিয়ে আরামে ছিলেন। এখানে আমাদের কতো বিপদ। একদিকে পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ভয়।

কথাগুলো তখনই আমার কানে বেজেছিল। আমরা যারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম তারা 'আরামে' ছিলাম বলে অবরুদ্ধ দেশের ভেতরে যারা ছিলেন তাদের ধারণা হয়েছিলো। এটা যে ঠিক নয়, সেটা কি আর কোনোদিন তারা বুঝতে পেরেছেন? তাদের কি আর সেটা বোঝানো হয়েছিল?

আমি বোদা বাজারে আসি ৩ ডিসেম্বর সকাল ১০ টার দিকে। আমিই ভারত থেকে বোদায় ফেরা প্রথম 'শরণার্থী'। আমাদের বাড়ি ছিলো তখন সাতখামার আখক্রয় কেন্দ্রের পাশে। এখন বোদার পৌর মেয়র ওয়াহিদুজ্জামান সুজার বাড়ির সামনের দিকে ছিলো আমাদের বাড়ি।

বাড়ি ফিরে আমার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। বাড়ি কোথায়? এ তো মনে হচ্ছে চাষের জমি! ঘরদুয়ারের চিহ্ন নেই। টিনের ঘর ছিলো আমাদের। অনেকগুলো ঘর ছিল। সব কিছু লুট করে খালি ভিটা ফেলে রেখেছিলো।

আমি তাহলে থাকবো কোথায়? গিয়ে উঠলাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজউদ্দিন সরকারের বাসায়। তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ করতেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা কী ছিল, সেটাও আমার জানা হয়নি তখনই। তার নাতি আবু ইলিয়াস প্রধান আমার বন্ধু। ইলিয়াস এখন আলাদা বাড়ি করেছে পাশেই। ও একজন ডাক্তার। সরকারি চাকরিতে অবসর নিয়ে বোদায় একটি ক্লিনিক দিয়েছে। ইলিয়াসের সঙ্গে সম্ভবত এক মাসের বেশি সময় ছিলাম। ওর বিছানায় শুয়ে শুয়েই ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমপর্ণের খবর রেডিওতে শুনেছিলাম।

হানাদারমুক্ত বোদায় এসে আমি কী দেখেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কার কী ভূমিকা ছিলো, আমাদের বাড়ির জিনিসপত্র কে বা কারা লুট করেছিলো, আমার পড়ার টেবিল কার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিলাম, সেসব এখন আর না বলাই ভালো । কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে, আবার দেশে ফিরতে পেরেছি সেই আনন্দের চেয়ে অন্য কষ্টের বিষয়গুলো আমার কাছে তখন তুচ্ছ ছিলো, এখনও আছে। মানুষের পক্ষ বদল, রূপ বদল আমি কাছ থেকে দেখেছি। কিছু মানুষের বিদ্বিষ্ট মনোভাবের পাশাপাশি অনেকের উদারতাও দেখেছি।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য উচ্ছ্বাস-উল্লাসের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ভাঙার নীরব মনোবেদনাও কারো কারো মধ্যে তখন লক্ষ করেছি। যা ধীরে ধীরে না জমে বরং বেড়েছে। এই যে বাংলাদেশের আজ পশ্চাৎযাত্রা, তার সব উপাদান কিন্তু যুদ্ধ জয়েরও মুহূর্তেও বহাল ছিল। তখন বাধ্য হয়ে যারা যা মেনে নিয়েছিল, পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান-পতন তাদের সে মান্যতা ভুলিয়ে দিয়ে স্বরূপে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক পরাজয় মানেই যে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির চিরবিদায় ছিল না, সেটা আমরা সেদিন বুঝতে পারিনি।

নানা ছোটখাট ঘটনায় তখনই আমার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলো, আমরা বাইরের শত্রুদের পরাজিত করলাম, কিন্তু আমাদের দেশীয় শত্রুরা কী পরাজিত হয়েছে? তারা তখন মন বদল না করে ভোল বদল করেছিল। আর অপেক্ষায় ছিল সুদিনের বা দিন বদলের। তারা তাদের অনুকূলে দিন বদলাতে পেরেছে। আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। আপস করেছি। আমরা আমাদের বিজয় ধরে রাখতে পারিনি। তাই আজ আমরা পরাজিত মানসিকতা নিয়ে বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠার চেষ্টা করি। আর যাদের আমরা পরাজিত ভেবেছিলাম, তারা আজ আমাদের ভুলের সুযোগ নিয়ে আমাদের ভেতরে ঢুকে আমাদের ভুল সবক দেয়, আস্ফালন করে!

একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত দেশে ফেরার যে উল্লাস আমার মধ্যে ছিল, তার সবটুকু আজ অবশিষ্ট নেই। আজ শুধু প্রশ্ন, আমরা কি আসলে কোনোদিন শত্রু মুক্ত হতে পারবো? নাকি শত্রুর সঙ্গে বসবাসই আমাদের অনিবার্য নিয়তি?