২০১১ সাল মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য নৈরাশ্যজনক: অধিকার

আবু সুফিয়ান_অনুসন্ধানী প্রতিবেদক
Published : 7 Jan 2012, 09:01 AM
Updated : 7 Jan 2012, 09:01 AM

আওয়ামী লীগের তিন বছরের 'ক্রসফায়ার' এর নামে হত্যাকাণ্ড কমলেও আইন শৃংখলা বাহিনীর দ্বারা 'গুম' এর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ চিত্র তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবীর মুখে রাষ্ট্র এই কৌশল বেছে নিয়েছে।"

অধিকার জানায়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ক্রসফায়ার এর নামে হত্যাকান্ড ঘটেছে ১৫৪ টি। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিলো ১২৭। তবে ২০১১ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৮৪।

ক্রসফায়ার এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড কমলেও আশংকাজনকহারে বেড়েছে গুম এর ঘটনা। ২০০৯ সালে গুম এর ২ টি ঘটনার কথা জানা গেলেও ২০১০ সালে হয়েছে ১৮টি এবং ২০১১ সালে ৩০টি।
সারাদেশের অধিকার এর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে বলে ই-মেইল বার্তায় জানিয়েছেন এর সেক্রেটারী আদিলুর রহমান খান।
বিশেষ করে বছরের শেষের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আবার আলোচনায় আসে 'গুপ্তহত্যা' নিয়ে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কাউকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। কাউকে শ্বাসরোধ করে। এরপর তাদের লাশ ফেলার জন্য ধলেশ্বরী নদী, গাজীপুর আর সাভারের নির্জন স্থান বেছে নেয় জড়িতরা। তবে র‌্যাব এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

বছরের শেষ দিকে কিছুদিন পরপরই নদীতে, ডোবা বা নির্জন মাঠে উদ্ধার হতে থাকে গুলিবিদ্ধ লাশ। কারো কারো পরিচয় পাওয়া গেলেও অনেককে দাফন করা হয় পরিচয় ছাড়াই। যাদের পরিচয় মিলেছে তাদের বেশিরভাগই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নানা স্তরের নেতা-কর্মী। রয়েছেন ছোট-বড় কয়েকজন ব্যবসায়ীও।

গত ১৪ই ডিসেম্বর রাতে মোহাম্মদপুর থানা এবং র্যাব-২ এর ফিজিক্যাল ক্যাম্পের মাঝামাঝি জায়গা থেকে অপহরণ করা হয় ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলামকে। পরদিন গাজীপুরের সালনা থেকে নাজমুলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

গত ২৮শে নভেম্বর রাজধানীর হাতিরপুলে মোতালিব প্লাজার সামনে থেকে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের শিক্ষার্থী শামীম হাসান ছিলেন সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রদলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন এবং ব্যবসায়ী মাসুদকেও। ঘটনার কয়দিন পর ধলেশ্বরী নদী থেকে উদ্ধার করা হয় ইসমাইলের লাশ।
গত ৭ ডিসেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকা থেকে গুম হন ইউনুস মুন্সি, তার ভাই মঞ্জু মুন্সি এবং তাদের মামাতো ভাই শেখেন মাতবর ও তাদের এক ব্যবসায়িক অংশীদার। তাদের সবার বাসা নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায়। এর মধ্যে মঞ্জু মুন্সীর লাশ উদ্ধার করা হয় ধলেশ্বরী নদী থেকে। গত ১২ই ডিসেম্বর তার স্ত্রী ক্ষতবিক্ষত লাশ শনাক্ত করেন।

জুয়েল সরদার ও তার চাচাতো ভাই রাজি সরদার ও তাদের বন্ধু মিজানকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যদের পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় গত ৩১শে জুলাই। ক'দিন বাদে জুয়েল ও মিজানের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের পুবাইল এলাকায়। আর রাজিবের লাশ পাওয়া যায় সিরাজদীখানের নিমতলীতে। তাদের শরীরে গুলির ক্ষত ছিল। উজিরপুরের ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীরকে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেবার পর তার আর সন্ধান মেলেনি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টন লাইনের বাসার নিচ থেকে অপহৃত হন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি শামীম আকতার। সে থেকেই তিনি নিখোঁজ।

গত নভেম্বরে সাভার থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা হাজী নূর মোহাম্মদ ওরফে নূর হাজী। পরের মাসেই (৩রা ডিসেম্বর) গুম করা হয় নূর হাজীর বড় মেয়ের জামাই আবদুল মান্নান ও তার সঙ্গী ইকবাল হোসেনকে।

গত ২ ডিসেম্বর সাভার এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় দুইটি গুলিবিদ্ধ লাশ। তাদের একজনকে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক হিসেবে সনাক্ত করেন তার স্বজনেরা।

গত ২ জুলাই তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকা থেকে মিজানুর রহমান ও আলী আকবর নামে দুই যুবকের লাশ উদ্ধার হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যার অভিযোগ ওঠার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, পত্রিকা পড়ে তিনি গুপ্তহত্যার খবর জেনেছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, গুম-অপহরণ-হত্যা অপরাধীদের কৌশল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক ব্যবহার করে তারা এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার হিসেবে চলতি বছর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ গুপ্তহত্যা ও গুমের ৩৬২টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে প্রতিনিয়ত। এই সময় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর অনেককেই আদালতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাজির না করে থানা হাজতে আটকে রেখে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে, প্রতিবেদনে বলা হয়।

২০১১ সালকে মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য নৈরাশ্যজনক বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। গণপিটুনীতে মৃত্যুর ঘটনা কমলেও তা নাটকীয় মোড় নিয়েছে; পুলিশ কর্তৃক একদল মানুষকে লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১৬ বছরের কিশোর শামসুদ্দিন মিলনকে, প্রতিবেদনে বলা হয়। এছাড়া সীমান্তে ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে "দূর্বল" বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় আওয়ামী লীগের তিন বছরে রাজনৈতিক সহিংসতা চরম আকার ধারণ করেছে। ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় যথাক্রমে ২৫১, ২২০, ১৩৫ জন নিহত হন । এঁদের মধ্যে ২০০৯ এ আওয়ামীলীগের ছাত্র ও যুব সংগঠনের মধ্যে অন্তর্কলহে নিহত ৩৮ জন এবং বিএনপির ২ জন, ২০১০ এ আওয়ামীলীগের ৩৮ জন এবং বিএনপির ৭ জন ও ২০১১ এ আওয়ামীলীগের ২২ জন ও বিএনপির ৩ জন নিহত হন।

মূলত: টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, ছাত্রাবাসের সিট দখল, হল দখল আধিপত্য বিস্তার এই ধরনের দুর্বৃত্তসুলভ কাজই এই সহিংসতার মূল কারণ," প্রতিবেদনে বলা হয়।