অনুসন্ধান: বন্দুকযুদ্ধ নয়, অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যা

আবু সুফিয়ান_অনুসন্ধানী প্রতিবেদক
Published : 5 April 2012, 02:14 PM
Updated : 5 April 2012, 02:14 PM

নরসিংদীতে র‌্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তিকে খুঁজে পেয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সুফিয়ান। ওই ব্যক্তি বলেছেন, অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন র‌্যাব সদস্যকে আগেও ওই এলাকায় দেখেছিলেন তিনি, যেখানে 'বন্দুকযুদ্ধে'র ঘটনা আগেও ঘটেছে।

র‌্যাব বরাবরের মতো বন্দুকযুদ্ধের কথা বলে এলেও নরসিংদীতে গত সোমবার দুপুরে নিহতদের অন্তত এক জনকে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যা করা হয় বলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি দাবি করেছেন।

যে স্থানটিতে ছয় জন নিহত হন, তার পাশেই একটি ফসলের মাঠ থেকে ঘটনাটি দেখেন বলে ওই ব্যক্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার মুখে থাকা র‌্যাবের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ আরো রয়েছে, যদিও সন্ত্রাস দমনে গঠিত বিশেষ এই বাহিনী বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ওই ব্যক্তি বলেছেন, অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন র‌্যাব সদস্যকে আগেও ওই এলাকায় দেখেছিলেন তিনি, যেখানে 'বন্দুকযুদ্ধে'র ঘটনা আগেও ঘটেছে।

ঘটনার দুদিন পর বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলের পাশেই ধানক্ষেতে কাজ করতে দেখা যায় কয়েকজন কৃষককে, যাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিকে পাওয়া যায়, যিনি ঘটনাটি চোখে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি ঘটনার বর্ণনা দিলেও র‌্যাব মেরে ফেলতে পারে এই ভয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি স্থানীয় ওই ব্যক্তি।

তিনি বলেন, "আমি ক্ষেতে সেচ দিচ্ছিলাম। একটি গাড়ি এসে থামে, তার ভেতরে র‌্যাবের সদস্যরাও ছিল। ওই গাড়িতে কমপক্ষে ১০ জনকে দেখেছি আমি।

"হঠাৎ গুলির শব্দ হতে থাকে, ভয়ে আমি ধান ক্ষেতে পাহারার জন্য স্থাপন করা অস্থায়ী মেশিন ঘরে ঢুকে যাই। সেখান থেকে রাস্তার ওপরই একজনকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করতে দেখি।"

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানায়, খবর শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা গুলিবিদ্ধ ছয় জনের লাশ দেখতে পেয়েছেন। রাস্তার দুই পাশের খাদে পাওয়া যায় দুই জনের লাশ। পিচঢালা রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন একজন। মাইক্রোবাসে ছিল দুই জনের লাশ এবং ট্রাকে ছিল এক জনের রক্তাক্ত দেহ।

সড়কে ওপর পড়ে থাকা ব্যক্তিকে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার ঘটনা দেখার কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি।

যেখানে লাশটি পড়েছিল পিচঢালা সড়কের সে স্থানটিতে প্রায় তিন ইঞ্চি গভীর গর্ত দেখা গেছে। গর্তের চারদিকে দেখা গেছে বারুদের দাগ, দুদিন পরও ছিল রক্তের দাগও।

র‌্যাব অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার পর তা বন্দুকযুদ্ধ বলে চালিয়ে দিয়েছে- এমন ঘটনার প্রমাণ আগেও পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী।

২০১১ সালের ৫ অক্টোবর ঝিনাইদহের পায়রাডাঙা গ্রামের মিছাখালি মাঠে (শুকনা পাটকাটা ক্ষেত) মুকুল মণ্ডলকে (৩২) এভাবে হত্যা করা হয় বলে দাবি করেছেন একজন মানবাধিকারকর্মী।

তিনি বলেছেন, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মুকুল বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন বলে র‌্যাব দাবি করলেও তার পিঠে তিনটা গুলির চিহ্ন ছিল। তিনটি গুলিই দেহ ভেদ করে মাটিতে গর্ত তৈরি করেছিল।

নরসিংদীতে নিহত ছয় জনের স্বজনরা ইতোমধ্যে দাবি করেছেন, সোমবার 'বন্দুকযুদ্ধ' হয়নি, তা ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

নরসিংদীর ৫ নম্বর ব্রিজ এলাকার কৃষিশ্রমিকরা জানায়, সারাদিন ধানক্ষেতে শ্রমিকদের কাজকর্ম চললেও দুপুরের খাবারের সময় একদম নির্জন হয়ে যায় পুরো এলাকা।

বুধবার বেলা আড়াইটার সময় (প্রায় একই সময় ঘটেছিল সোমবারের কথিত বন্দুকযুদ্ধ) সরেজমিন দেখা যায়, দুই পাশের ধানক্ষেতে মাত্র কয়েকজন সেচ দিচ্ছেন। গাড়ি চলাচলও খুব কম।

ওই এলাকায় এর আগেও র‌্যাবের 'বন্দুকযুদ্ধের' ঘটনা ঘটেছিল বলে স্থানীয়রা জানান। কয়েক বছর আগে শহরের দত্তপাড়ার নূর মোহাম্মদ নূরা (৩৫), কাউরিয়া পাড়ার আবু সিদ্দিক (৪২) 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা যান নির্জন এই সড়কের পূর্বদিকে তৈরি করা হেলিপ্যাডের পাশে।

সোমবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি বলেন, ঘটনার আগের কয়েকদিনের মধ্যে তিন থেকে চার জন র‌্যাব সদস্যকে ওই এলাকায় দেখেছেন তিনি, যারা সোমবারের অভিযানে ছিলেন।

"এরা আগেও এই এলাকায় এসেছেন। ঘুরেফিরে চলে গেছেন," বলেন তিনি।

র‌্যাবের বক্তব্য অনুযায়ী, গত সোমবার মারুফ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর ৪০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের খবর পেয়ে তারা অভিযানে নামেন, যাতে 'বন্দুকযুদ্ধে' ছয় জন নিহত হয়।

নিহত ছয় জনকে র‌্যাব 'কুখ্যাত' ডাকাত বললেও তাদের মধ্যে মাত্র দুজনের বিরুদ্ধে দুটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। নিহত বাকি চার জনের পাশাপাশি আহত ও আটক মিলিয়ে আট জনের বিরুদ্ধে কোনো মামলার হদিস মেলেনি।

র‌্যাবের বক্তব্য

গুলি ঠেকিয়ে হত্যার এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নরসিংদীর অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাব-১১ এর উপসহকারী পরিচালক মেজর খন্দকার গোলাম সারওয়ার সরাসরি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন।

যার লাশ সড়কে পড়ে ছিল, তার গুলি কোথায় লেগেছিল এবং তা দেহ ভেদ করে বেরিয়েছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "তা আমি খেয়াল করিনি।"

"দেখে বলতে হবে। পিঠে না পেটে গুলি লেগেছে, তা বলা মুশকিল। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি তো এক্সপার্ট না। সেদিন প্রচণ্ড দৌড়াদৌড়ির পরিস্থিতি ছিল। কেউ নিজে না দেখলে পরিস্থিতি অনুমান করা কঠিন," বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা সারওয়ার।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এই কর্মকর্তার সাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, র‌্যাব-১১ (সদর দপ্তর নারায়ণগঞ্জের আদমজীনগর) এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু হেনা মো. মোস্তফা খবর পান, নরসিংদী শহরে এক ব্যবসায়ীর ৪০ হাজার টাকা ডাকাতি করে শহর ও আশপাশে ঘোরাফেরা করছে এক দল ডাকাত।

ওই টাকা উদ্ধার ও ডাকাতদের গ্রেপ্তারের উদ্দেশে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়কের নেতৃত্বে র‌্যাবের একটি দল কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে নরসিংদী শহর ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালায় বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

এতে বলা হয়, "ডাকাত দল আরো একটি ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কের ৫ নম্বর ব্রিজের কাছে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় র‌্যাবের একটি দল সেখানে পৌঁছালে ডাকাতরা র‌্যাবের মাইক্রোবাসের সামনে একটি ট্রাক থামিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয় এবং পেছনের একটি মাইক্রোবাস থেকে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে।"

'সরকারি জানমাল রক্ষা ও আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব সদস্যরা পাল্টা গুলি চালালে' ছয় ছিনতাইকারী নিহত এবং অন্যরা আহত হয় বলে র‌্যাব জানায়। 'বন্দুকযুদ্ধে' র‌্যাবের এসআই শহীদ ও সিপাহী সাইফুল ইসলাম আহত হন।

ঘটনাস্থল থেকে তিনটি পিস্তল, একটি এলজি, একটি কার্তুজ, দুটি চাকু, ১০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি এবং ছিনতাই হওয়া নগদ ৪০ হাজার টাকা উদ্ধারের দাবিও করে র‌্যাব।