অনুসন্ধান: মিরপুরে র‌্যাবের গুলিতে পোশাক কারখানার সাবকন্ট্রাক্টর আব্দুল মোমিন মোল্লা নিহত

আবু সুফিয়ান_অনুসন্ধানী প্রতিবেদক
Published : 24 May 2012, 08:01 PM
Updated : 24 May 2012, 08:01 PM

পেছন ফিরে দেখা:
গত পহেলা এপ্রিল, ২০১২ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর থানার গাজীরকান্দি গ্রামের মৃত আবু সৈয়দ ও রজেবা খাতুনের ছেলে মোহাম্মদ আবদুল মোমিনকে (২৪) ঢাকার কেরানীগঞ্জের পূর্ব চড়াইল এলাকায় বাসার সামনে থেকে দুপুর আনুমানিক ১.০০ টায় সাদা পোশাকে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) -৪ এর সদস্যরা আটক করে। এরপর ২রা এপ্রিল, ২০১২ রাত আনুমানিক ১২.৩০ টায় মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের ১২ নম্বর রোডের টিনসেড কলোনীর ৩৮৩ নম্বর বাসার সামনে গাছের সঙ্গে বেঁধে র‌্যাব-৪ এর সদস্যরা মোমিনকে গুলি করে হত্যা করে বলে পরিবারের অভিযোগ।

নিহত মোমিনের স্ত্রী জোৎস্না আক্তার পলি জানান, তাঁর স্বামী ছিলেন একজন প্রতিবন্ধী, ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন। পহেলা এপ্রিল, ২০১২ দুপুর আনুমানিক ১.০০ টায় কেরানীগঞ্জের পূর্বচরাইল এলাকায় অবস্থিত মোবাইল ফোন ফ্লেক্সিলোডের দোকানের মালিক আমিন তাঁকে জানান যে, তাঁর বাসার গলির কাছে লাগানো 'নবধারা মাল্টি পারপাস কোম্পানী লিমিটেড' এর সাইনবোর্ডের সামনে থেকে সাদা পোশাকে ৬/৭ জন র‌্যাব সদস্য তাঁর স্বামীকে আটক করে নিয়ে গেছে। তখন তিনি তাঁর স্বামীর মোবাইল ফোনে ফোন করেন। তাঁর স্বামী মোবাইল ফোন রিসিভ করার পর তিনি শুনতে পান যে, তাঁর স্বামীর সঙ্গে কিছু লোকজনের কথা হচ্ছে এবং তাঁর সঙ্গে কথা না বলার জন্য তাঁর স্বামীকে ধমক দেয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই তাঁর স্বামীর মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

২রা এপ্রিল, ২০১২ সকাল আনুমানিক ৯.০০ টার দিকে র‌্যাব-৪ এর সোর্স এবং কাফরুলের সেনপাড়ার ১ নম্বর বিল্ডিং এলাকায় 'নেতা রুবেল' নামে পরিচিত কাফরুল থানা বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সাধারণ সম্পাদক রুবেল তাঁর মোবাইল ফোনে ফোন দিয়ে তাঁকে স্বামীর লাশ দেখার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে যেতে বলে। রুবেল আরও বলে যে, মোমিন রুবেলের কথা মেনে চলেনি এবং অনেক বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। তাই মোমিনের মৃত্যু হয়েছে। কারণ মৃত্যুর আগে রুবেল মোমিনকে অনেকদিন বুঝিয়েছিলো যেন রুবেলের সঙ্গে কোন প্রতিদ্বন্ধিতা না করে। তিনি টিনসেড কলোনীর এক লোকের কাছে জানতে পারেন, মোমিনকে র‌্যাব সদস্যরা গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি আরও জানান, তাঁর স্বামী নিহত হওয়ার কিছুদিন পর অপরিচিত এক লোক তাঁর মোবাইল ফোনে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে যে, তাঁর স্বামীর মৃত্যুতে তিনি কারো বিরুদ্ধে কোন মামলা করেছেন কিনা। তিনি সে সময়ে ওইলোকের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে ওই লোক তাঁকে বলে যে, সে তাঁর স্বামীর বন্ধু। এরপর তাঁকে ওই লোক আরো বলে যে, প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে মামলা করে কেউ পেরে ওঠেনা এবং তাঁকে মামলা না করার জন্য উপদেশ দেয়।

মোমিনের মামাতো ভাই আব্দুল হালিম ভূঁইয়া জানান, মোমিনের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে যান এবং বিকাল আনুমানিক ৫.০০ টায় মর্গ থেকে মোমিনের লাশ গ্রহণ করেন। তিনি দেখেন, মোমিনের লাশের কপালের বাম পাশে একটি গুলি, বুকের ডান পাশে এবং দুই হাঁটুর উপরেও গুলির চিহ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, পাঁচ বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে মোমিনের বাম পা অচল হয়ে যায়। মোমিন পঙ্গু হলেও আয়-রোজগারের জন্য পরিশ্রম করতো এবং সৎভাবে বাঁচার জন্য গার্মেন্টস্ এ জিপার লাগানোর কণ্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করতো। ২রা এপ্রিল ২০১২ রাত আনুমানিক ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর থানার গাজীরকান্দি গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে মোমিনের লাশ দাফন করা হয়।

কেরানীগঞ্জের পূর্বচরাইল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানান, পহেলা এপ্রিল ২০১২ দুপুর আনুমানিক ১.০০ টায় তিনি দেখেন যে, তাঁর দোকানের সামনে মোমিনকে বহন করা রিকশাটি এসে পৌঁছামাত্রই সাদা পোশাকে ৬/৭ জন লোক নিজেদের র‌্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে মোমিনকে ঘিরে ধরে এবং হাতকড়া পরিয়ে দুইজন র‌্যাব সদস্য রিকশায় বসা মোমিনের দুইপাশে বসে রিকশাটিকে ঘুরিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সে সময়ে অন্যান্য র‌্যাব সদস্যরাও আশেপাশে থাকা রিকশায় চড়ে মোমিনকে বহন করা রিকশাটি অনুসরণ করতে থাকে।

অবশ্য নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, কাফরুল থানার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রুবেল মিয়া (৩২)। তার দাবি, ২রা এপ্রিল ২০১২ তিনি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে র‌্যাব-৪ এর সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' মোমিনের নিহত হওয়ার খবর পান। এর আগে এলাকার বিভিন্ন জনের কাছে তিনি জানতে পারেন যে, ২রা এপ্রিল ২০১২ রাত ১২.৩০ টার পরে মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনে কৃষি ব্যাংকের পেছনে টিনসেড কলোনী এলাকায় র‌্যাব-৪ এর সদস্যদের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' মিরপুর এলাকার 'দুর্বৃত্ত' মোমিন নিহত হয়। রুবেলের দাবি, মোমিন কাফরুল এলাকার গার্মেন্টস্ মালিকদের কাছে চাঁদা দাবি, টেলিফোনে হুমকি দেয়াসহ নানা ধরণের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেনপাড়া ১ নম্বর বিল্ডিং এলাকার গার্মেন্টস্ মালিকরা মোমিনকে প্রতিমাসে সাড়ে তিনলাখ টাকা চাঁদা দিতো। এছাড়াও মোমিন প্রতি মাসে কচুক্ষেত এলাকার গার্মেন্টস মালিকদের কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা নিতো বলেও বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ এর স্থানীয় এই নেতা দাবি করেন। এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে মোমিন অশান্তির কারণ এবং ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিল বলে মোহাম্মদ রুবেল মিয়ার অভিযোগ।

কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল লতিফও দাবি করেন এটি ছিলো মোমিনের সঙ্গে র‌্যাব-৪ এর 'বন্দুকযুদ্ধ'। তার দাবি, মোমিনের বিরুদ্ধে কাফরুল, শেরে বাংলা নগর থানা ও পল্লবী থানায় চাঁদাবাজি, হত্যা ও মারামারির মামলা রয়েছে।

কাফরুল থানার সাবইনসপেক্টর তোফাজ্জল হোসেন দাবি করেন, তিনি খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে রাস্তার ওপরে মোমিনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি বলেন, সে সময়ে মোমিনের কাছে একটি রিভলবার, দুই রাউন্ড গুলি, চারটি ফেন্সিডিলের বোতল ছিল, যার মধ্যে একটি বোতলে অর্ধেক পরিমান ফেন্সিডিল পাওয়া যায়। তাছাড়া পাঁচটি গোল্ডলিফ সিগারেটসহ একটি গোল্ডলিফ সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া যায়।

র‌্যাব এর প্রেসনোটে (স্মারক নম্বর-৪২২০/মিডিয়া/প্রেস নোট/৪৫) বলা হয়, "রাজধানীর কাফরুল থানাধীন মিরপুর, সেকশন-১৩ এলাকায় র‌্যাবের সাথে সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধে মিরপুর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও কাফরুল এলাকার ত্রাস বলে পরিচিত চিহ্নিত ও দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী তাজ এর প্রধান সহযোগী মোঃ মমিন ল্যাংড়া মমিন (৩০) নিহত। অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার। "

সূত্র:অধিকার