চর কুকরী-মুকরীর মন ভুলানো সমুদ্র সৈকত আর হরিনের পাল ভ্রমন বিলাসীদের আনন্দ জোগায়

অচিন্ত্য মজুমদার
Published : 19 Jan 2012, 05:59 AM
Updated : 19 Jan 2012, 05:59 AM

ভোলা শহর থেকে প্রায় ১৫০কিঃমিঃ পথ পেরিয়ে বঙ্গপোসাগরের কোল ঘেষে উপকূলে সবুজের সমারোহে ঘেরা দ্বীপ চর কুকরী মুকরী এখন ভ্রমন বিলাসীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমিতে ঘেরা নয়নাভিরাম এ দ্বীপের সৌন্দর্য অতিথিদের মনে তৃপ্তি আনে। এক সময়কার ওলন্দাজ-পর্তুগীজদের অভয়ারন্য বলে পরিচিত কুকরী-মুকরী এখন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের দখলে। কয়েকবছর ধরে অপার সম্ভাবনাময় এ দ্বীপটি দর্শনার্থীদের মনে প্রচুর আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। ভোলা জেলার মূল ভূ-খন্ড থেকে প্রায় দেড়শ কিঃ মিঃ দক্ষিণে অবস্থান এ দ্বীপটির। এটিকে দ্বীপকন্যাও বলা হয়ে থাকে। ম্যান-গ্রোভ বনাঞ্চল,বন্যপ্রানী আর সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে সৌন্দর্যের এক বর্ণিল উপস্থিতি যা প্রকৃতি প্রেমিক পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। জানা যায়, প্রায় ৪'শ থেকে ৫'শ বছর আগে পলির স্তর জমতে জমতে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে চর কুকরী-মুকরী নামের এ দ্বীপটি জেগে উঠে। কালের স্বাক্ষী পুরোনো এ চরে আজও সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেষে মেঘনা-তেতুলিয়ার মোহনায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা বিশাল বনাঞ্চল বেষ্টিত এ দ্বীপে বিচরণ করছে অসংখ্য হরিণ,কাঠময়ূর,গরু-মহিষ,বানর এবং নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। মাঝে মধ্যে চিতাবাঘেরও উপস্থিতি টের পাওয়া যায় এ দ্বীপকন্যার বুকে। এখানে নিরাপদ নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা, হোটেল-মোটেলসহ আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে তা কুয়াকাটা,কক্সবাজার,সেন্টমার্টিনের চেয়েও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিনত হতে পারে। বিস্তৃত সবুজ বনাঞ্চল, মায়াবি হরিণের দল আর মন ভুলানো সমুদ্র সৈকত কুকরীমুকরীকে ভ্রমণ বিলাসীদের তীর্থ ভূমিতে পরিণত করতে পারে। শীতের মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির উপস্থিতি এ পর্যটন কেন্দ্রকে করে তুলে আরো মনোরম। এর পাশাপাশি চর পাতিলা ও ঢালচরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পৃথক দু'টি দ্বীপ। এখানেও শীতের সময় বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ হরিণ,বালিহাঁস মানুষের মনজুড়ানো পরিবেশের সূচনা করে। সম্প্রতি আইইউসিএন (ওটঈঘ) চরকুকরী মুকরীকে বিশ্ব জীব বৈচিত্রের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে। বর্তমানে কুকরী-মুকরী ইউনিয়নটি বাবুগঞ্জ, নবীনগর, রসূলপুর, আমিনপুর,শাহবাজপুর, মুসলিম পাড়া, চর পাতিলা ও শরীফ পাড়া নিয়ে গঠিত। এখানকার প্রতিটি দর্শনীয় ন্থানগুলো দেখতে সেন্টমার্টিন এর চেয়েও সুন্দর। যদিও এখানে বাণিজ্যিক ভাবে নেই কোন পর্যটনদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। কিন্তু কুকরীর এ বনে হরিনের পাল আর ময়ূরের পেখম অতিথিদের আনন্দ জোগায়। তাই প্রকৃতির এ ব্যকুলময় টানেই দর্শনার্থীরা কষ্টসাধ্য হলেও ছুটে যায় কুকরী বনে। নতুন বছরকে বরন করতে কয়েকদিন আগেই সেখানে পালিত হলো সূর্যোৎসব। সেখানকার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রায় ২০কিঃমিঃ এলাকা যেন আরেক সুন্দরবন। বালি চিক চিক সমুদ্র সৈকতে বেড়ানোর মজা পেতে হলে যেতে হবে কুকরীমুকরীর বালু চরে। চরের পশ্চিম পার্শ্বে রয়েছে ১৬৯৬ একর বাগান। এ বাগানকে বলা হয় চরজমির। কিন্তু চরজমিরের পশ্চিম এবং কলিরচরের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে উন্মুক্ত সাগর সৈকতে আসতে হবে নৌ-যানে করে।

এছাড়াও চরফ্যাশন উপজেলার ৪৮টি মুজিব কেল্লার মধ্যে একটি কুকরী বাগানে। কেল্লাটি বর্তমানে বনবিভাগের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারের আমলে বণ্যার সময় লোকজনকে আশ্রয় নেয়ার জন্য সরকার এ কেল্লা তৈরী করেন। যুগের পরিবর্তনে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক পাকা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কারণে এ কেল্লাগুলোর গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পায়। তবে মূল ভূ-খন্ডের কেল্লার গুরুত্ব বা যতœ না থাকলেও কুকরীমুকরী দ্বীপের চারটি কেল্লার এখনো গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এখানে বেরিবাঁধ নেই। আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যাও অপ্রতুল। বণ্যা ও জলোচ্ছাস উপকূলীয় মানুষের নিত্য দিনের সাথী। তবুও বাগানের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত মুজিব কেল্লার গুরুত্ব রয়েই গেছে। এ কেল্লাটি হতে পারে কুকরী দ্বীপের পর্যটনের প্রাণপ্রন্দ্র। কারণ, এ বনে রয়েছে হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। জোযারের সময় বাগান প্লাবিত হলে দলবেধে হরিণগুলো আশ্রয় নেয় এ কেল্লায়। আবার সমগ্র বনে একটি মাত্র মিঠা পানির কূপ রয়েছে কেল্লার ভিতরে। হরিণ লবনাক্ত পানি পান করে না। বিধায় তৃষ্ণা পেলে হরিণের পাল ছুটে এসে কিল্লার কূপে। তাই প্রতিনিয়তই শত শত হরিণের পদচারণায় মূখরিত থাকে এ মুজিব কেল্লা। যার কারণে, ভ্রমণ পিপাশুরা হরিণ দেখার ইচ্ছায় প্রতিদিনই মুজিব কেল্লায় ভীড় জমায়। কেল্লাটি ৩০০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত। যার চারদিকে কেওড়া বাগান। বাগানের প্রবেশ দ্বার দিয়ে বয়ে গেছে সরু খাল। খাল অল্প কিছুদূর এগুতেই সাগর মোহনা। কেল্লা হতে সাগর সৈকতের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। কুকরীমুকরী বাজার থেকে কেল্লার দূরত্ব সারে চার কিলোমিটার। কিন্তু এর মাঝে যোগাযোগের কোন সড়ক নেই। কর্দমাক্ত মাঠ অতিক্রম করে কেল্লায় পৌঁছতে হয়। বিকল্প হলো নৌ-পথ।

বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, বনবিভাগ কুকরীমুকরীতে একটি বন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে ২০১৭ হেক্টর বনাঞ্চল রয়েছে। এখানকার প্রধান বৃক্ষ কেওরা, অর্থনৈতিক বিচারে যা ততটা সমৃদ্ধ নয়। দ্বীপের ভূ-প্রকৃতি সুন্দরী, গেওয়া, পশুর বৃক্ষের জন্য উপযোগী। তাই এখানে কেওড়ার পাশাপাশি এ সকল বৃক্ষ সৃজনের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০ একর জমিতে সুন্দরীর চারা সৃজন করা হয়েছে। উৎপাদন করা হয়েছে ৫০ হাজার চারা। ১৯৯৮ সাল থেকে এ দ্বীপে গবেষণার কাজ শুরু হয়। এর সাথে বনের আকর্ষণ বৃদ্ধি করবে হরিণ, বানর, বনবিড়াল, উদবিড়াল, শেয়াল, বনমোড়গ, কাঠময়ূর, মথুরা এবং কোয়েল। হয়তো ভবিষ্যতে বাঘ সিংহের মতো প্রজাতির প্রাণীরাও আশ্রিত হবে এ বনে। কুকরীমুকরীতে বর্তমানে ১৭টিরও বেশি বন আছে। এর মধ্যে ১৭৬৮ একর জমিতে সৃজিত আছে কুকরীমুকরীর বাগান।

স্থানীয় সাংসদ আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব জানান, সরকার এ দ্বীপটিকে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছেন। এছাড়াও সেখানে অসংখ্য রিসোর্টসহ ঝুলন্ত সেতু দ্বারা চরফ্যাশনের মূল ভূ-খন্ডের সাথে যাতায়েতের সংযোগ স্থল তৈরী করা হবে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের মোটেল তৈরী করা হবে। ফলে কুকরী হবে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের একমাত্র মনমুগ্ধকর কেন্দ্রস্থল। ইতিমধ্যেই কুকরীর বনের মধ্যভাগ দিয়ে রাস্তা তৈরীর কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সরকার কয়েকশত কেটি টাকা ব্যয় করবেন বলেও জানান তিনি।