ভোলা সদর হাসপাতালে রাতের চিকিৎসক বাবুর্চি নুরু মিয়া

অচিন্ত্য মজুমদার
Published : 19 March 2012, 05:33 AM
Updated : 19 March 2012, 05:33 AM

ভোলার সদর হাসপাতালে সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে প্রতিনিয়ত বহু রোগী প্রাণ হারাচ্ছে। এ অভিযোগ বহুদিন ধরে। শুধু তাই নয় গুরুত্বর আহত রোগীরা হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে থাকলেও সামান্য হাতে ব্যথা রোগীরা থাকছেন বেডে। ফলে উপযুক্ত চিকিৎসা ও ওষুধের অভাবে রোগীরা বিভিন্ন ক্লিনিকের দারস্থ হচ্ছেন। সঠিক ভাবে পরিচালনার অভাবে ভোলা সদর হাসপাতাল আজ নিজেই রোগীতে পরিণত হয়েছে। সরকারী হাসপাতালে সেবা বলতে এখন রোগীরা প্যারাসিটামল, কৃমি, স্যালাইন, গ্যাস্ট্রিক ও ব্যাথার বড়িকেই বোঝে। এক্স-রে ও ইসিজি মেশিন থাকলেও কখনো কখনো ফ্লিম না থাকাসহ নানা অজুহাতে বন্ধ থাকে। এই পরিস্থিতিতে ভোলায় আসা অন্য জেলার মানুষ দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে যখন হাসপাতালে আসে তখন স্বজনহীন এসব অসহায় মানুষের জন্য হাসপাতাল থেকে কোন ঔষধ, ইনজেকশান, স্যালাইন দেয়া হয় না। যদি কোন স্বহৃদয়বান ব্যক্তি দয়া করে ওইসব ঔষধ কেনার ব্যবস্থা করেন তাহলে তাদের চিকিৎসা শুরু হয়। আর আহত এসব রোগীদের চিকিৎসা শুরু করেন হাসপাতালের বাবুর্চী, ঝাড়–দার, পিয়ন, নাইটগার্ডসহ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা, কোন ডাক্তার কিনবা নার্স নয়। দুঃখের বিষয় গুরুত্বর আহত এসব রোগীদের করুন অবস্থা দেখে শত শত মানুষের হৃদয় কাঁদলেও হাসপাতালের তাৎক্ষনিক চিকিৎসার কাজে নিয়জিত থাকা কারুই মন গলাতে পারেনা। এ ব্যাপারে হাসপাতালের আরএমও ডাঃ শরিফ আহাম্মেদ জানান, এসব অসহায় রোগীদের ক্ষেত্রে সমাজ কল্যাণ বিভাগে আবেদন করলে সাহায্য পাওয়া যায়। তবে তাৎক্ষনিক নয় এক দিন পরে।

গত ১৪মার্চ সরেজমিনে রাত ১১টায় ভোলা সদর হাসপাতালে এমনই একটি ঘটনা দেখা যায়। বাপ্তা ইউনিয়নের বুড়ি মসজিদ এলাকায় আলফা মাহেন্দ্র ও নছিমনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন গুরুত্বর আহত হয়। খবর পেয়ে আমরা দুই সাংবাদিক সেখানে ছুটে যাই। হাসপাতালে ঢোকার সময় আমরা দেখতে পাই গামছা গলায় মাঝ বয়সী একজন লোক হাতে দুটো ইনজেকশান নিয়ে ভেতরে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করছে। লোকটির নাম মোঃ সেলিম, তিনি রিক্সা চালক, তার কাছে জানতে পারি ওই ৫ আহতদের মধ্যে কান্তুজা ও সখিতাইন নামে দুই উপজাতি রয়েছে তাদের বাড়ি রাঙামাটি জেলায়। তারা প্রায় ঘন্টা খানেক হাসপাতালে মেঝেতে পড়ে আছে। তাদের কোন চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছেনা। পরে ওই খানে থাকা দুই ছাত্র তাদের টাকা দিয়ে স্যালাইন কিনে এনেছে। এর পরও সেই স্যালাইন দেয়ার জন্য হাসপাতালের কোন লোক আসছেনা।

এ সময় রিক্সা চালক সেলিম বলেন, আমি হারা দিন রিক্সা টাইনা ২৪০ টাকা রোজগার করছি। হেইখান থিকা ১১০টাকা দিয়া দুইটা ইংজেকশন কিনা আনছি। দুইডা ভিনদেশী লোক আমগো দেশে আইয়া কষ্ট পাইবো হের লাইগাই ভাবলাম হেগো যদি কোন উপকার করতে পারি। আমি রাইতেই বাড়ি থিকা কাথা বালিশ হেগো আইনা দিমু।

লোকটির সাথে আমরা আহতদের কাছে ছুটে যাই। আমরা দেখলাম অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। আহতরা মেঝেতে পরে আছে তাদের কোন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছেনা। কিছুক্ষন পরে হাসপাতালের বাবুর্চী নূরু মিয়া এসে আহতদের স্যালাইন লাগিয়ে চিকিৎসা শুরু করে। লোকটি যে বাবুর্চী নূরু মিয়া ছিল এ ব্যাপাটি পরদিন ছবি দেখে হাসপাতালের এক ব্রাদার নিশ্চিত করেন। আহতদের ব্যাপারে হাসপাতালের আরএমও ডাঃ শরিফ আহাম্মেদকে জানানো হলে তিনি হাসপাতালে রাত ১১টায় ছুটে আসে। কিন্তু এরই মধ্যে একই সময় অটোরিক্সা দুর্ঘটনায় অপর এক জন বৃদ্ধ গুরুত্বর আহত আবদুর রশিদের উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় বলে তার স্বজনরা অভিযোগ করেছে।

বাবুর্চী নূরু মিয়ার ব্যাপারে ভোলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডাঃ শরিফ আহাম্মেদ জানান, হাসপাতালে লোকবল কম থাকার কারনে বাবুর্চিকেই ওয়ার্ডবয়ের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। স্বজনহীন রোগীদের ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকে স্যালাইন কেনো দেয়া হয়না জানতে চাইলে তিনি বলেন, গুরুত্বর আহত রোগীদের ক্ষেত্রে হার্ডসোল স্যালাইন দিতে হয় যা সরকার থেকে হাসপাতালে সরবরাহ করা হয় না।

ভোলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডাক্তার ফরিদ আহমেদ এ পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে জানান, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতাল হলেও ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে বহুদিন ধরে চলছে ১০০ শয্যার হাসপাতালটি । এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বহুবার অবহিত করা হলেও অদ্যাবধি কোন ব্যাবস্থা গ্রহণ করেনি।