প্রযুক্তিঃ আশীর্বাদ না অভিশাপ?

আদর
Published : 28 July 2011, 07:57 AM
Updated : 28 July 2011, 07:57 AM

এখন আর সন্তানেরা মা-বাবার কাছে চিঠি লিখতে বসে না। এমনকি মা-বাবারাও চিঠি লেখে না। চিঠি পড়তে যেয়ে চোখে জল জমে না। যত্ন করে চিঠিটা তুলে রাখা হয় না। ডাকপিয়নের অপেক্ষায় পথচেয়ে বসে থাকতে হয় না। পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে হয় না। প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ ও দ্রুততর হয়েছে। শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরে অবস্থানরত স্বজনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করাও সহজ। ছোট কিন্তু কার্যকরী যন্ত্র মোবাইলের জন্য এদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। সেই সাথে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার মানুষের জীবনকে আরো গতিময় করেছে। এখন আর দূরে থাকলেও অভিভাবকদের গাঢ় চিন্তায় নিমজ্জিত থাকতে হয় না। সহজলভ্য মোবাইলের বদৌলতে চিন্তা-ভাবনা অনেক কমেছে। সহজেই অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। "ডিজিটাল বাংলাদেশ" -শ্লোগান দিয়ে বর্তমান সরকার পুরো জাতিকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই এদেশের শিক্ষার্থীসহ জনসাধারণের হাতে স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ শোভা পাবে। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে। সবাই পরিবর্তন চায়। উন্নয়নের অংশীদার হতে চায়। আর তাই প্রযুক্তি নির্ভর দেশ গড়তে, সকল পেশাজীবি মানুষকে এগিয়ে নিতে, প্রযুক্তি নির্ভর প্রজন্ম তৈরী করতে উন্নত বিশ্বের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এদেশের সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। প্রতিটি অভিভাবকই চায় তার সন্তান প্রযুক্তির স্পর্শে বেড়ে উঠুক, এগিয়ে যাক, এগিয়ে নিক পিছিয়ে থাকা দেশটাকে। শুধু অভিভাবকগণ নয় সচেতন প্রতিটি মানুষের একই স্বপ্ন, একই প্রত্যাশা। প্রযুক্তির সংস্পর্শে শিক্ষার্থীরাসহ দেশের প্রতিটি মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়বে-এতে কোন সন্দেহ নেই। পরিবর্তন আসবে-এটা (হয়ত) নিশ্চিত। পাশাপাশি কতটা পরিবর্তন আসবে, পরিবর্তনটা কেমন হতে পারে, সুফল-কুফল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। সর্বোপরি- প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নইলে ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর স্বপ্নটা অধরাই থেকে যাবে। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে এদেশে মানবজীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে, পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। সেই সাথে সফলতার পাশাপাশি প্রযুক্তির অপব্যবহার পুরো জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আহত করছে, প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দটি ছিল- "ইভটিজিং"। মিডিয়া, পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে, মানববন্ধন হয়েছে, বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে, সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। "ইভটিজিং" এর জন্য কয়েকটি প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে, অনেক ঘটনা আড়ালেই রয়ে গেছে। ইদানিং পত্রিকার পাতা খুললেই নজরে পড়ে মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও চিত্রের খবর। আত্মহত্যা। এসিড সন্ত্রাস, ইভটিজিং আর এখন মোবাইলে ভিডিও চিত্র ধারণ। এটাকে কি বলে আখ্যায়িত করা যায়- প্রযুক্তি সন্ত্রাস না মোবাইল সন্ত্রাস? প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা আক্রান্ত হচ্ছে। অপমান, অপবাদ, লজ্জা থেকে পরিত্রাণ পেতে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। শুধু এখানেই নয় দেশের প্রতিটি জেলায় গড়ে ওঠা সাইবার ক্যাফেগুলো আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে সাইবার ক্যাফেতে গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কলেজ পড়ুয়ারা অশ্লীল সাইটগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে। অসামাজিক কর্মকান্ড যে ঘটে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেমন পুরো বিশ্বকে সামনে আনা যায়, জ্ঞান অর্জন করা যায়, তেমনি ব্যবহারকারীদের বিপথগামী করে।

শিক্ষক ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে-
শিক্ষকঃ পথের মাঝে দুটো কলস পড়ে আছে। একটা টাকাকড়িতে ভর্তি, অন্যটা জ্ঞানে ভর্তি। তুমি কোনটা নেবে?
ছাত্রঃ টাকাকড়ি ভর্তিটা নেব
শিক্ষকঃ আমি কিন্তু জ্ঞানে ভর্তি কলসটাই নিতাম
ছাত্রঃ যার যেটার অভাব

জানা এই কৌতুকটা নিছক হাসির জন্য নয়, শিক্ষনীয়। স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে প্রযুক্তিপণ্য শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিলেই যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূর্ণ হবে, দেশের উন্নতি হবে, ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এমনটি আগাম ভেবে রাখা ভুল। প্রথমেই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কিভাবে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পরিবর্তন আনা সম্ভব সে বিষয়গুলো প্রকাশসহ সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ, অপ্রয়োজনীয় সাইটগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অপব্যবহার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তি তরুণ প্রজন্মকে যেভাবে আকৃষ্ট করেছে- অভিভাবক মহলে এ চিত্রটা কিন্তু ভিন্ন। উন্নত দেশের বয়স্ক ব্যক্তিরা শেষ বয়সে এসেও প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে সময় ব্যয় করছে, সেখানে আমাদের দেশে উল্টোচিত্র। সন্তানরা মা-বাবার কাছে থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে। জমানো প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে চায়। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি। প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি অভিভাবকের উচিত প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন করা। সন্তানকে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিনে দিলাম, এগিয়ে যাবার সিঁড়ি তৈরী করে দিলাম-এমন ভেবে দায়িত্ব শেষ বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। দায়িত্ব শেষ নয়, শুরু। সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পথ বাতলে দিতে হবে, আগ্রহ জন্মাতে হবে। নইলে- প্রযুক্তি আশির্বাদ নয় অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি সচেতন অভিভাবকদেরও প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসতে হবে। সন্তান কি করছে, কোন সাইট ভিজিট করছে, কম্পিউটারকে বিনোদনের মাধ্যম না জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছে, কত সময় ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দিনের পর দিন নতুন নতুন ওয়েবসাইট তৈরী হচ্ছে। মেধা খরচ করে তৈরী করা সাইটগুলোতে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, বিনোদন, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় স্থান পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রযুক্তি পণ্য স্বল্পমূল্যে বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষনীয় ওয়েবসাইটও তৈরী করতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরীর পাশাপাশি কম্পিউটার ল্যাবে রক্ষিত কম্পিউটারের তথ্য ভান্ডার বিখ্যাত বইয়ের ই-বুক দিয়ে ই-বুক লাইব্রেরী গড়ে তুলতে হবে। সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণকৃত বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রোগ্রামগুলোই দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে ইচ্ছেমত বা অপ্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম ইনস্টল করতে বা রিমুভ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কিন্তু পড়াশোনার সাথে সম্পৃক্ত প্রয়োজনীয় সাইটগুলোর ঠিকানা ব্যতীত অন্য কোন সাইটে প্রবেশ করতে যেন না পারে সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। প্রকৃত অর্থে এমন নিরাপত্তা বলয় তৈরী করা উচিত যাতে করে শিক্ষার্থীরা পথভ্রষ্ট, অমনোযোগী না হয়, এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকাংশেই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটমান প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে ‍‍‍‍‍‍" প্রযুক্তি: আশির্বাদ না অভিশাপ " এ বিতর্কে না যেয়ে প্রযুক্তি দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিবে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এর ছোঁয়ায় আলোকিত হবে-এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।