তোমাদের বিজয়ের গল্প কোনদিন শেষ হবে না, আমাদের দাবী কখনই পূরণ হবে না…

আদর
Published : 17 August 2011, 06:17 AM
Updated : 17 August 2011, 06:17 AM

ভূত, প্রেত। প্রেতাত্মা। ভৌতিক যত কাহিনী। কাল্পনিক সব গল্প। টিভি পর্দায় যখন কোন হরর ছবি অথবা নাটক শুরু হয়, কিছু কিছু মুহূর্ত তখন জন্ম নেয়- ভয়ে আঁতকে উঠি, মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে শব্দ বেরিয়ে যায়। কাল্পনিক গল্পগুলো এখন আর আমাদের ভীত করেনা। বাস্তবজীবনের ঘটমান গল্পগুলো ভৌতিক গল্পের চেয়ে ভৌতিক, অবিশ্বাস্য, ভয়ংকর, বীভৎস, তীব্র আর্তনাদে জর্জরিত। ভূত আছে না নাই, বাস্তবে ছিল কি ছিল না- এ তর্কে যাবার ইচ্ছে নেই। তবে লেখার স্বার্থে ধরে নিচ্ছি যে, ভূত আছে, আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। যেহেতু বলছি- ভুত আছে, সেহেতু বলতে পারি, ভূতেরও মান-সম্মান আছে, আছে আত্মসম্মানবোধ। বর্তমান সময়ের ছোট ছোট বাচ্চারা যা সাহসী তাতে ভূতবাবাজীরা লজ্জায় পৃথিবী ত্যাগ করে অন্য কোন গ্রহে বসবাস শুরু করতো। নয়ত জনহিতকর কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতো। সাম্প্রতিক সময়ে যত ঘটনার জন্ম হয়েছে- সেগুলো কি সহজে সহনীয়? বিশ্বাসযোগ্য? বাস্তবিক অর্থে জড়িতদের …?

মিশুক মুনীর গতকাল মাটির ঘরের বাসিন্দা হয়েছেন। নানীর কোলে হয়ত মাথা রেখে এখন ঘুমোচ্ছেন। নয়ত জেগে উঠে নানীকে গল্প শোনাচ্ছেন- দেখো, তোমার সেই ছোট্ট মিশুকে সবাই কত ভালবাসে। নানী নিশ্চয় আক্ষেপ করে বলছেন- তোর তো এতো তাড়াতাড়ি আসার কথা ছিল না?

কফিন জড়িয়ে বড় ভাইয়ের কান্না উপস্থিত সকলের চোখে জল এনেছিল। আর আমরা পত্রিকায় খবরটি পড়েই চোখের কোণে জমে উঠা জল মুছছি। জিজ্ঞেস করলে বড় ভাইটি নিশ্চয় বলবেন- জন্মের পর ওকে কোলে নিয়ে কত ঘুরেছি, কত খেলেছি, কত দুষ্টুমি করেছি। অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে যাবেন ফেলে আসা দিনের কথা। আজ এতটা বছর পর সেই ছোট ভাইটিকে কোলে করে শুইয়ে দিলাম মাটির করবে।

অন্যদিকে তারেক মাসুদ? পরম মমতা, শ্রদ্ধায় বাবাকে শুইয়ে দিয়েছিলেন মাটির করবে। কবরের মাটি শুকাতে না শুকাতে আজ তিনি বাবার পাশে ঘুমিয়ে পড়বেন। অধরাই থেকে গেল সব স্বপ্ন। ছোট্ট শিশুটির কথা কি কেউ বলছি? কেউ ভাবছি? যে শিশুটি বাবা বলে ডাকলেও বাবাকে পাবে না, বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবে না।

প্রেত দিয়ে শুরু করেছিলাম। প্রেত নাটকের কথা কি মনে আছে? জাফর ইকবাল স্যারের লেখা? আহম্মেদ রুবেল, হুমায়ুন ফরীদি অভিনয় করেছিলেন? নাটকটির পরিচালক ছিলেন আহীর আলম। সেই আহীর আলমকে আমরা হারিয়েছিলাম এমনই এক সড়ক দূর্ঘটনায়। সেদিনও এদেশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটেছিল। উনিও শুয়ে আছেন মা-বাবার কোলে, সম্ভবত একই কবরে। সার্জেন্ট আহাদের কথা কি মনে পড়ে? সবাই তাঁকে ভুলে গেছি। নাটক করতেন। সাহসী ছিলেন। সন্ত্রাসীদের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়লে, তাঁকেও পেতাম উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। বিশ্বাস হয় না? রোকেয়া প্রাচী কি এখন উজ্জ্বল নক্ষত্র নন?

সময়ের খরস্রোতে আমরা হয়ত তোমাদের ভুলে যাবো। থাকবে না আজকের মতো উন্মাদনা। থাকবে না এই প্রতিবাদের ভাষা। তোমাদের কর্মই তোমাদের বেঁচে রাখবে অনন্তকাল। কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে তোমাদের স্মৃতি ধরে রাখতে, আগামী প্রজন্মকে তোমাদের গল্প শোনাতে।

মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ স্বপ্ন নিয়ে এক সাথে পথ চলেছেন, চলতেন। জীবনের দীর্ঘ সময় একসাথে কাজ করেছেন। জন্ম দিয়েছেন নতুন এক অধ্যায়ের। যে অধ্যায় শুধু আমাদের আলোকিতই করেনি, আলোকিত করবে অনাগত প্রজন্মকে। আলো ছড়াবে সহস্র প্রজন্ম ধরে। মৃত্যুও হলো একসাথে। থেমে গেল পথচলা অপূর্ণতা নিয়ে।

পুরো দেশ আজ শোকে কাতর। সবাই আজ ক্ষুদ্ধ। সবাই পরিবর্তন চায়। কথায় নয় বাস্তবায়ন চাই। নিরাপত্তা চাই। আইনের শাসন চাই। জিম্মিদশা থেকে মুক্তি চাই।
শহীদ নূর হোসেনের বুকে পিঠে লেখা ছিল " স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক"।

সেই শ্লোগানের মতো কন্ঠ মিলিয়ে তীব্র চিৎকারে, রক্তলাল চোখে, একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে, হাতে হাত রেখে বলতে ইচ্ছে করছে- " লুটেরা সব নিপাত যাক, জিম্মিদশা থেকে জনগণ মুক্তি পাক"।