বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করতে হয় কেন?

এডভোকেট জয়নাল আবেদীন চৌধুরী রিগ্যান
Published : 9 Nov 2015, 06:01 PM
Updated : 9 Nov 2015, 06:01 PM

প্রশ্নটির উত্তর অতি ব্যাপক। সংক্ষেপে, সামাজিক মর্যাদা এবং আইনগত অধিকার রক্ষার জন্যই বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা অতি জরুরি। রেজিস্ট্রেশন ব্যাতীত আপনি আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে সাক্ষ্যগত মূল্য বহন করে। রেজিস্ট্রেশন ব্যাতিত বিবাহ প্রমাণ করা কঠিন ফলে মেয়েদের প্রতারিত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় সবচেয়ে বেশি। দেনমোহর, ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার নির্ণয়, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি দাবির ক্ষেত্রে বিবাহ রেজিস্ট্রিশন বা বিবাহের কাবিননামা আইনগত দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কাবিননামার গুরুত্ব ব্যাপক। কাবিননামায় বয়স উল্লেখ করতে হয় বিধায় বাল্য বিবাহ রোধও সম্ভব। এটি বিবাহিত ছেলে-মেয়ে উভয়ের ভবিষ্যত আইনগত অধিকার সংরক্ষণ করে। বিবাহ সম্পর্কে উভয় পক্ষ থেকেই যে কোন সময় জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, তখন কাবিননামা প্রমাণ পত্র হিসেবে কাজ করে।

অন্যদিকে, আইনের দৃষ্টিতে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তাই সকল বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা আইনত আবশ্যক।

বিবাহ রেজিস্ট্রেশন কী এবং কেন :
বিবাহ রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে সরকারিভাবে বিবাহকে তালিকাভুক্তি করা। সরকারের নির্ধারিত ফরমে বিবাহের তথ্যবলী দিয়ে এই তালিকাভূক্তি করতে হয়। তালিকাভূক্তি ফরমটিকে কাবিননামাও বলে। ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন অনুযায়ী প্রতিটি বিবাহ সরকার নির্ধারিত কাজী বা নিকাহ্ রেজিস্ট্রার দ্বারা রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনটি ২০০৫ সালে সংশোধনী আনা হয় এবং বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ওই সংশোধনীতে বলা হয়েছে, নিকাহ্ রেজিস্ট্রার বা কাজী বিবাহ সম্পন্ন হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করবেন অথবা তিনি ছাড়া অন্য কেউ বিবাহ সম্পন্ন করলে ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকাহ্ রেজিস্ট্রার বা কাজীর নিকট বিবাহের তথ্য প্রদান করতে হবে এবং কাজী উক্ত তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ রেজিস্ট্রি করবেন। যদি কেউ বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের এসব বিধান লঙ্ঘন করেন তাহলে তার ২ (দুই) বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৩০০০ (তিন হাজার) টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে। আইন অনুযায়ী কেউ যদি রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন তবে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

উল্লেখ্য যে, রেজিস্ট্রেশন না হলে বিবাহ বাতিল হয় না তবে আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকে।

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও ১৮৭২ সালের খ্রিস্টান ম্যারেজ এ্যাক্ট অনুযায়ী খ্রিস্টানদের বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে হিন্দু পারিবারিক আইন অনুযায়ী হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের কোনো বিধি বিধান নেই। তবে ২০১২ সালে প্রণীত "হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন" অনুযায়ী বিবাহ নিবন্ধনের বিধান থাকলেও তা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও এরূপ বিধান নেই। এসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যত প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হলফনামা করে রাখা যেতে পারে।

কখন এবং কিভাবে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করতে হয় :
২০০৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) সংশোধিত আইন অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্ন হবার সাথে সাথে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। তবে নিকাহ রেজিস্ট্রার ছাড়া বিবাহ সম্পন্ন হলে ৩০দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রারের নিকট বিবাহ রেজিস্ট্রি করতে হয়। রেজিস্ট্রি করতে রেজিস্ট্রেশন সরকারি ফি দিতে হয়। দেনমোহরের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে রেজিস্ট্রেশন ফি নির্ধারিত হয়। ধার্য্যকৃত দেনমোহরের প্রতি হাজার বা তার অংশবিশেষের জন্য ১০ টাকা হারে রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়। তবে রেজিস্ট্রেশন ফি এর মোট পরিমাণ ১০০ টাকার কম হবে না এবং ৪০০০ টাকার উপর হবে না। এই ফি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এবং পরিবর্তন হয়ে থাকে। রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধের দায়িত্ব বরপক্ষের।

আইন অনুযায়ী বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বা শর্ত যেমন, বর কনের বয়স, উভয়ের সম্মতি, দেনমোহর, তালাক প্রদানের ক্ষমতা ইত্যাদি পূরণ সাপেক্ষে কাজী বা নিকাহ রেজিস্ট্রার বিবাহ রেজিস্ট্রি করবেন। খ্রিস্টান বিবাহের ক্ষেত্রে যিনি বিবাহ সম্পাদন করবেন তিনিই বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করবেন। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হবার পর কাজী উভয়পক্ষকে রেজিস্ট্রেশন ফরম বা কাবিননামার সত্যায়িত কপি প্রদান করবেন।

বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের সুফল-কুফল :
বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করলে আইনগত কিছু সুফল পাওয়া যায় কিন্তু রেজিস্ট্রেশন না করলে কুফলও রয়েছে অনেক, যেমন রেজিস্ট্রেশনের ফলে,

১) উভয় পক্ষ বিবাহ অস্বীকার করার আইনত সুযোগ থাকেনা এবং এর দ্বারা সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা আরোপিত হয়।
২) রেজিস্ট্রেশনের ফলে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নির্ণয় সহজ হয়।
৩) স্ত্রী তার প্রাপ্ত দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায় বা দাবি করতে পারে।
৪) সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ণয় করতে সহজ হয়।
৫) স্বামী দ্বিতীয় বিবাহের জন্য উদ্যোগী হলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
৬) রেজিস্ট্রেশনের ফলে বাল্য বিবাহ রোধ সম্ভব হয়।
৭) রেজিস্ট্রেশনের ফলে স্ত্রী ডিভোর্স দেয়ার ক্ষমতা প্রাপ্ত হতে পারে।

অন্যদিকে, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না হলে স্বামী বা স্ত্রীর আইনগত বৈধতা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য, অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ করা যায় না। রেজিস্ট্রেশন না হওয়ার ফলে স্বামী অথবা স্ত্রী উভয়ই আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত বা প্রতারিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আবার, রেজিস্ট্রেশন না করা আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। মোট কথা, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন একদিকে যেমন বাধ্যতামূলক অন্যদিকে এটি একটি সামাজিক এবং পারিবারিক প্রামাণ্য দলিল।

advocateregan@gmail.com
01711 970 318
www.advocateregan.com