নিকট ভবিষ্যতে আবারো কি টেস্ট ক্রিকেটের শীর্ষে ফিরছে ভারত?

মোঃ মুজিব উল্লাহ
Published : 13 June 2012, 04:23 PM
Updated : 13 June 2012, 04:23 PM

ভারতীয় টেস্ট দলে কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড়ের জায়গায় কে খেলবেন তা নিয়ে ক্রিকেট মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। আগামীতে ভারতীয় ক্রিকেটের তারকা হওয়ার মত বেশ কয়েকজন তরুণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ভারতে আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাদেরকে রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভ গাংগুলি ও লিটল মাস্টার শচীন টেণ্ডুলকারের সাথে তুলনা করার সময় এখনো আসে নি। একসময়ের ভারতীয় শক্তিশালী মিডল অর্ডারের এ চার স্তম্ভের মধ্যে সৌরভ, দ্রাবিড় অবসর নিয়েছেন; লক্ষ্মণ তাদেরকে অনুসরণ করার পথে ও শচীন হয়তো আরো ১-২ বছর খেলবেন।

সৌরভের অবসরের পর ৬ নম্বরের জায়গা নিয়ে যুবরাজ সিং ও সুরেশ রায়নার মধ্যে লড়াই হয়েছিল। অধারাবাহিকতা ও পেস বোলারদের বিপক্ষে দূর্বলতার কারণে ড্যাশিং ব্যাটসম্যান যুবরাজ সিং আরেক বাম হাতি তরুণ ব্যাটসম্যান সুরেশ রায়নার কাছে জায়গা হারান। এখন ক্যান্সার চিকিৎসায় আক্রান্ত যুবরাজ পুনর্বাসনে ব্যস্ত বলে নির্বাচকদের বিবেচনার বাইরে। অন্যদিকে রায়না তার টেস্ট ক্যারিয়ার দূর্দান্তভাবে সূচনা করলেও তা ধরে রাখতে পারেন নি ও একসময় ফর্মহীনতার কারণে দলে জায়গা হারান। রায়নার বদলে সুযোগ পাওয়া তরুণ ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি এরই মাঝে তার ক্রিকেটীয় প্রতিভা ও ক্লাসের কিছু ঝলক দেখিয়েছেন। তবে ওয়ানডে দলের এ সহঅধিনায়কে এখনি টিম ইণ্ডিয়ার ব্র্যাণ্ড বলাটা ঠিক হবে না। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট ও ওয়ানডেতে দারুণ খেলে তার আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। তবে তাকে লোয়ার মিডল অর্ডারে ৬ নং পজিশনে ব্যাট করানো উচিত।

আমি মনে করি, পূজারা `দ্যা ওয়ালের` আদর্শ অনুসারী ও যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারবেন। ক্যারিবীয়ান ট্যুরে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইণ্ডিজ এ দলের বিপক্ষে ভারতীয় এ দলের অধিনায়ক হিসেবে বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচগুলোতে তিনি ভাল খেলছেন। কয়েক বছর আগে প্রখ্যাত ভাষ্যকার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক হর্শা ভোগলের লিখা ও আমার পঠিত একটি আর্টিকেলে পূজারাকে ভারতের অন্যতম সেরা তরুণ প্রতিভা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। রাহুলের স্থলে পূজারার সাদা জার্সিতে দলে স্থান মজবুত করার জন্য এটিই উপযুক্ত সময়। তিনি অবশ্যই ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাবান তরুণ ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মার আগে সুযোগ পাবেন। টেকনিক ও ধৈর্য্যের দিক দিয়ে পূজারা একজন ভালো ব্যাটসম্যান। এছাড়া দলের প্রয়োজনে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংও করতে পারেন। তাকেই রাহুলের ছেড়ে আসা ওয়ান ডাউনে পাঠানো উচিত।

২০১২ সালের আগস্ট থেকে ২০১৩ সালের মার্চের মধ্যে ভারত সর্বমোট ১০ টি টেস্ট ম্যাচ খেলবে। এই বছর আগস্টে হোম সিরিজে নিউজল্যাণ্ডের বিপক্ষে খেলে ক্ল্যাসিক ব্যাটসম্যান লক্ষ্মণ খুব সম্ভবত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে চলেছেন। লক্ষ্মণের অবসরের পরপরই বিখ্যাত সাবেক অসি অধিনায়ক ও ক্রিকেট বিশ্লেষক ইয়ান চ্যাপেলের মতে ভারতের আগামীর টেণ্ডুলকার রোহিত শর্মাকে ৫ নম্বরে স্থান দিতে পারেন নির্বাচকেরা। আর তাই নিকট ভবিষ্যতে রাহানে, রায়না, বদ্রিনাথ, মনোজ, মুকুন্দ, মুরালি বিজয়, মনীশ পাণ্ডে, ধাওয়ান ও সাহা প্রমুখদের মূল একাদশে দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য অপ্রত্যাশিত ডাক ও পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। তাদের প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতিশীল তবে ফ্ল্যাট ব্যাটিং উইকেটে খেলে রন্জি ট্রফিতে করা রানের পর রান তাদেরকে প্রমাণের কোন গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হতে পারে না।

ভারতীয় সেনাপতি ধোনি ২০১৩ সালে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন এমন আভাস দিয়েছেন। তাই তাকে নিয়মিত বিশ্রাম নিয়ে তরুণ উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমান সাহাকে কয়েকটি টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। বেশ কিছুদিন থেকেই বিধ্বংসী ওপেনিং ব্যাটসম্যান শেহওয়াগ শচীনের অবসরের পরে ৪ নম্বরে ব্যাট করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। শচীনের শূণ্যতায় তাই অভিজ্ঞ বীরুকে ৪ নম্বরে পাঠানো যেতে পারে। তখন ওপেনিংয়ে একজনের জায়গা খালি হবে। আমার মতে, সেটি মুকুন্দকে দিয়ে পূরণ করা উচিত। অনেক সমালোচকই আমার এ ভাবনার সাথে দ্বিমত করতে পারেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ভারতের ঘরোয়া লীগকে তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিজয়, ধাওয়ান ও পাণ্ডের চেয়ে মুকুন্দকেই আমার কাছে টেকনিক, টেম্পারামেন্ট, স্টাইল ইত্যাদি মিলিয়ে অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো মনে হয়েছে। অন্যদিকে এবারের আইপিএলের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসা রাহানেও শেষ কয়েকটি রন্জি মৌসুমে ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলেছেন। তবে মুকুন্দের পরেই তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত। দূরদর্শী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কয়েক বছরের মধ্যেই মুকুন্দ-রাহানেই হতে পারেন ভারতের পরবর্তী সফল উদ্ভোধনী জুটি।

বোলিংয়ের দিক দিয়ে ভারতীয় দল এখনো অনেক দূর্বল। হরভজন সিংয়ের পরে দলে ম্যাচজেতানো কোন স্পিনার এখনো দেখা যায় নি। ভাজ্জি যদি ফর্ম ও ছন্দ ফিরে পান তাকে আরেকটি সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে আশ্বিন ও ওঝা কোনমতে স্পিন আক্রমণে ভূমিকা পালন করছেন। উপমহাদেশের প্রথাগত ঘূর্ণিট্র্যাকে তাদেরকে আরো অনেক ভালো বল করতে হবে। তবেই তারা ম্যাচ উইনার হতে পারবেন। এছাড়া তরুণ স্পিনার রাহুল শর্মা ও রবীন্দ্র জাদেজাও ভারতীয় নির্বাচকদের পরিকল্পনায় আছেন।

ভারতের দূর্বল পেস এ্যাটাকে একমাত্র অভিজ্ঞ জহির খানই বিশ্বমানের বোলার। পিচ থেকে বাড়তি সুবিধা না পেলে প্রাভিন, ইরফান, বিনয় কুমার, মুনাফরা তাদের মিডিয়াম পেসে অতটা কার্যকর নন। এছাড়াও তাদেরকে সাফল্য পেতে হলে বোলিংয়ে সুনিয়ণ্ত্রিত লাইন, লেংথ ছাড়াও চতুরতার সাথে ভেরিয়েশন আনতে হবে। ইরফান পাঠানকে তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিনগুলোতে দলের পেস আক্রমণের প্রধাণ কাণ্ডারি হওয়া উচিত। ঐদিকে প্রতিশ্রুতিশীল ইশান্ত, শ্রীশান্ত ও আরপি সিং প্রায়ই ইনজুরি ও ফর্মের সাথে লড়ছেন। ইনজুরিতে পড়ার পূর্বে ইশান্ত তার টেস্ট ক্যারিয়ারে সুন্দর সূচনা করেছিলেন। তবে শ্রীশান্ত টেস্ট ম্যাচে অধিকতর আগ্রাসী ও কার্যকরী বোলার। তরুণ বোলারদের মধ্যে উমেশ যাদব, ভেরন অরুণ ও উনাদকেতকে নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী। তারা প্রত্যেকেই নিয়মিতভাবে ১৪০-১৪৫ কিমি বেগে বল করতে দ্বিধা বোধ করেন না। গতির সাথে ভেরিয়েশন আনতে পারলে তাদের সামনে উজ্জ্বল আগামী অপেক্ষা করছে। তাদেরকে যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যা করা হয় তাহলে ভারতীয় বোলিংয়ে তো বটেই এমনকি বিশ্ব ক্রিকেটে তারা আগামী ১০ বছর শীর্ষস্থানীয় বোলার হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।

ভারত বর্তমানে আইসিসি টেস্ট পজিশনে চতুর্থ স্থানে আছে। তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটা দু:সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সিনিয়র ক্রিকেটাররা ধারাবাহিকভাবে অবসর নেওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকায় এ অবস্থা আরো ১-২ বছর চলতে পারে। যদি শচীন ও জহির খান আগামী বছরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না যান এবং অধিনায়ক ধোনি তার আগেই অবসরে চলে যান সেক্ষেত্রে বর্তমানের আলোকে ঐ সফরের প্রথম টেস্টে আমার মতে সম্ভাব্য প্রথম একাদশ ব্যাটিং অর্ডার অনুযায়ী নিম্নরুপ হবে:

০১. গৌতম গাম্ভীর (অধিনায়ক) ০২. অভিনব মুকুন্দ ০৩. চেতশ্বরা পূজারা ০৪. বীরেন্দ্র সেহওয়াগ ০৫. রোহিত শর্মা ০৬. বিরাট কোহলি ০৭. ঋদ্ধিমান সাহা ০৮. রবিচন্দ্র আশ্বিন ০৯. ইরফান পাঠান ১০. উমেশ যাদব ১১. ভেরন অরুণ

কিন্তু ২০১৩ আসতে অনেক দেরি। এরমাঝে ২০১২-২০১৩ মৌসুমে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তবে প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটারদের উর্বরভূমি ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের ফরম্যাটকে ঢেলে সাজিয়ে আরো আকর্ষণীয় করতে হবে। বোর্ডকে বাস্তবতার নিরিখে বিচার করতে হবে ও তরুণ প্রতিভাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। যদি তারা তা করতে সক্ষম হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ক্রিকেট বিশ্বে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। অবশেষে চূড়ান্ত প্রশ্ন এসেই যায়: তারা কি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটে শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারবে?

মো: মুজিব উল্লাহ: mdmujib_ullah@yahoo.com

ফেসবুকেও ফিডব্যাক দিতে পারবেন এই ঠিকানায়