টি-টুয়েণ্টির যুগে বেঁচে থাকুক ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেট

মোঃ মুজিব উল্লাহ
Published : 5 July 2012, 10:59 AM
Updated : 5 July 2012, 10:59 AM

আগামী দিনে টেস্ট ক্রিকেটের অস্তিত্ব, ওয়ানডে ক্রিকেটের স্থায়ীত্ব ও টি-টুয়েণ্টি ক্রিকেটের জয়গান নিয়ে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় মুখর। অর্থনৈতিক কারণে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রায়শ:ই আইসিসির সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা এ বিতর্ককে আরো উসকে দিয়েছে। ওয়ানডেতে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পরে সব ধরনের ক্রিকেটে ব্যর্থ ভারতীয়দের ডিআরএস বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাবে আধুনিক প্রযুক্তিকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। বর্তমানে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে এত ভাবনা ও ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে শংকিত হওয়ার জন্য ভারতের ঘরোয়া লীগ আইপিএলই দায়ী বললে খুব বেশী ভুলও বলা হবে না!

সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান, ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার ও উপস্থাপক সন্জয় মান্জেরেকার ওয়ানডে ক্রিকেটের পতনই দেখতে পাচ্ছেন। ক্রিকইনফোতে লিখা সাম্প্রতিক কলামে তিনি সীমিত ওভারের ম্যাচে দর্শক সংখ্যা কমে যাওয়া, টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের বাণিজ্যিক চাহিদা, খেলোয়াড়দের ওয়ানডে ক্রিকেটের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বোলার ও ব্যাটসমানদের স্বকীয়তা হারানো, ম্যাচের মাঝপথে ব্যাটিং টিম ও বোলিং টিমের অতিমাত্রায় রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিসহ কয়েকটি পয়েণ্টের দিকে ইঙ্গিত করে ওয়ানডে ক্রিকেটের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। সমস্যাগুলো কি আসলে এগুলোর মাঝেই সীমাবদ্ধ? যদি তাই হয় তাহলে নীতিমালায় পরিবর্তন আনলে, ফ্ল্যাট পিচ না বানিয়ে স্পোর্টিং উইকেট বানালে, ওয়ানডে ম্যাচের সংখ্যা কমালে অনেকাংশেই সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। টি-টুয়েণ্টিতে চার ওভার বোলিং করে বোলারদের পক্ষে শতভাগ উজাড় করে দেওয়ার ব্যাপারে সন্জয়ের অভিমত সঠিক হলেও তাতে টেস্ট ক্রিকেটে ভাল বোলারদের সংখ্যা হ্রাস পাবে। ওয়ানডে নিয়ে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক, জনপ্রিয় ক্রিকেট কলামিস্ট ও ভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেলের মতামত বরং অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তিনি ম্যাচের সংখ্যা হ্রাস করে ব্যস্ত ক্রিকেটসূচীতে তিন ধরনের ফরম্যাটকেই স্থান দেওয়ার পক্ষে জোর দিয়েছেন। সারা বছর ধরে খেললে এমনিতেও শতভাগ ফিট থাকা, ইনজুরি থেকে দূরে থাকা, ভালো পারফর্ম করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। ফলশ্রুতিতে ক্রিকেটাররা বর্তমানে তিনটি ফরম্যাট থেকে ১-২ টিকে বেছে নিচ্ছেন ও ফ্রি ল্যান্সার হয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইংলিশ তারকা ব্যাটসম্যান কেভিন পিটারসনের ওয়ানডে ও টি-টুয়েণ্টি থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ও নিউজল্যাণ্ডের সাবেক অধিনায়ক, অলরাউণ্ড ক্রিকেটার ড্যানিয়েল ভেট্টোরির টি-টুয়েণ্টিতে ফিরে আসার ঘোষণা তারই স্বাক্ষ্য বহন করে। ইয়ানের প্রস্তাবিত বিভিন্ন স্তরের ওডিআই ক্রিকেট ফর্মুলা মানা যেতে পারে। সেরা ৬টি টিম নিয়ে শীর্ষ স্তরে ওয়ানডে ম্যাচগুলো আয়োজন ফরম্যাটটি আরো আকর্ষণীয়, জমজমাট হবে ও দর্শকদের মাঠে টানবে। আরো কয়েকটি স্তরে একইভাবে বিভিন্ন দেশকে খেলানো যেতে পারে। প্রতি মৌসুমে শীর্ষ দুটি দলের উপরের স্তরে উন্নয়ন ও সর্বনিম্নে থাকা ২টি দলের অবনমন পদ্ধতি অনুসরন করা গেলে ওয়ানডে ক্রিকেট তার প্রাণ ফিরে পাবে। আইসিসি কর্তৃক আয়োজিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও বিশ্বকাপে চারটি গ্রুপে ১৬ দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। বাছাই পদ্ধতিতে তখন ইউরো ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফুটবলের মত যুতসই ও আকর্ষণীয় পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এছাড়াও নাকচকৃত শচীনের ২৫ ওভার ভিত্তিক ২ ইনিংসের ওয়ানডে তত্ত্ব পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

অনেকের বাতিলের খাতায় থাকা টেস্টই ক্রিকেটের মূল মেরুদণ্ড। তবে শেষ কয়েক বছরে ভাল মানের টেস্ট প্লেয়ার উঠে আসে নি। অন্যদিকে একদশকের অস্ট্রেলিয়ানদের একদশকের আধিপত্য ভেঙ্গে দ: আফ্রিকা, ভারত পালাক্রমে শীর্ষস্থানে উঠলেও তা ধরে রাখতে পারে নি। এখন আর কোন প্রতাপশালী টেস্ট টিম নেই। প্রথম সারির ৪-৫ টি দলের শক্তিমত্তায় খুব বেশি ফারাক নেই। বর্তমানে শীর্ষে থাকা ইংল্যাণ্ড দলে একজন বিশ্বমানের অলরাউণ্ডারের না থাকলেও তারা একটি চমৎকার টেস্ট দল। সম্প্রতি টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বমানের তেমন খেলোয়াড় উঠে না আসায় জনপ্রিয় ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হর্শা ভোগলে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। হর্শার লেখা কলামে ২০০৬ সালের পরে জোনাথন ট্রট, স্টুয়ার্ট ব্রড, গ্রায়েম সোয়ান, ব্রেসনান, সাঈদ আজমলকে বিশ্বমানের তালিকায় রেখে ফ্লিন, রোচ, সিডল,প্যাটিনসনদের সম্ভাব্য আগামীদের তালিকায় রাখা হয়েছে। তবে ফিলাণ্ডার ও মরনে মরকেলের টেস্ট অভিষেক আরো আগে হওয়ায় তাদেরকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। হর্শার তালিকায় নতুনদের মধ্যে মরগান, ডুমিনি, কোহলি, উমর আকমল, ম্যাথুজ, ড্যারেন ব্রাভোদের কথা বলা হলেও ওয়ার্নার, কেনি উইলিয়ামসসহ কয়েকজনের নাম আসে নি। অন্যদিকে, টেস্ট ম্যাচগুলোকে আকর্ষণীয় ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভবান করতে ইয়ান চ্যাপেলের দেওয়া আমেরিকা, আফ্রিকা, জাপান ও এশিয়ার অন্যান্য দেশসমূহে টেস্ট ক্রিকেট আয়োজনের প্রস্তাবটি সময়োপযোগী্। ডে-নাইট টেস্টটির বিষয়টিও ভাবা যায় তবে টেস্টের দৈর্ঘ্য ৩-৪ দিনে কমিয়ে আনলে এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাবে। ৮ দলের মধ্যে খেলানোর চিন্তাভাবনাটা ম্যাচগুলোকে অধিক প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ করার জন্য হয়তো চ্যাপেল বলতে পারেন তবে এটি ক্রিকেটকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাবনার স্ববিরোধী হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও দুটি গ্রুপে খেলা হতে পারে। খেলোয়াড়েরা কেন টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি উদাসীন তা নিয়ে এর আগে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সহকারী সম্পাদক সিদ্ধার্থ মঙ্গা লিখেছেন। আইপিএল ও ঘরোয়া টি-টুয়েণ্টি লীগগুলোতে মিলিয়ন ডলারের হাতছানি সত্ত্বেও টি-টুয়েণ্টি কখনো সত্যিকারের ক্রিকেট টেস্টের বিকল্প হতে পারে না। প্রয়োজনে ঘরোয়া টি-টুয়েণ্টি কমিয়ে টেস্ট আয়োজন করা যেতে পারে।

ক্রিকেট বিশ্বে গ্ল্যামার, অর্থ, বিনোদন ইত্যাদি মিলিয়ে টি-টুয়েণ্টির জয়জয়কার। সংক্ষিপ্ত পরিসরের এ ভার্সনের বাণিজ্যিক চাহিদা চোখে পড়ার মত। তবে মনে রাখতে হবে এ সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চেয়েও ঘরোয়া টূর্ণামেণ্টগুলোতে বেশি। আইপিএল, বিগব্যাশ ইত্যাদির ব্যাপক সাফল্যে সব দেশেই টি-টুয়েণ্টির জয়গান চলছে। উল্টো দিকে আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে দর্শকদের স্বল্প উপস্থিতি ভাবনার বিষয়। ১-২ মাস ধরে চলা ঘরোয়া লীগগুলোতে ম্যাচের সংখ্যা আনলে আন্তর্জাতিক টি-টুয়েণ্টির জন্য সময় বের করা সম্ভব হবে। টি-টুয়েণ্টিকে কেউ কেউ আবার শুধুমাত্র ঘরোয়া লীগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলছেন। সেটা ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ঠিক হবে না। আইপিএলসহ জনপ্রিয় টি-টুয়েণ্টি লীগগুলোকে আইসিসির সিডিউলে অন্তর্ভূক্ত করার চিন্তাভাবনা না করে বেশি সংখ্যক আন্তর্জাতিক টি-টুয়েণ্টি ম্যাচ আয়োজন করলেই ভাল হবে।

পৃথক পৃথকভাবে ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাটেরই আবেদন ও স্বতন্ত্রতা কম নয়। টেস্ট ক্রিকেট ধৈর্য্য, স্কীল ইত্যাদি মিলিয়ে যেমন শুদ্ধতার উপাদান টি-টুয়েণ্টিও তেমনি উত্তেজনা, ধুন্ধুমার ক্রীড়াশৈলী, গ্ল্যামার ইত্যাদির সমন্বয়ে পাঁচমিশালি বিনোদনের প্রতীক। আর ওয়ানডে পুরাতন ও নতুনের মাঝে থেকে মানিয়ে নেওয়া সময়ের উপকরণ। বলতেই হচ্ছে, ধ্রুপদী ক্রিকেটীয় শিল্পের জন্য টেস্ট ক্রিকেটের কোন বিকল্প নেই। তাই কোন একটি ফরম্যাটকে বাদ দেওয়ার সময় এখনো আসে নি। সব ধরনের ক্রিকেটে ডিআরএস চালু করার এখনই সময়। নিয়মনীতি সংস্কারের মাধ্যমে, ব্যস্ত ক্রিকেটসূচীকে ঢেলে সাজিয়ে, ক্রিকেটে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে তিনটি ফরম্যাটকেই পরবর্তী ধাপে নেওয়া সম্ভব। এজন্য ক্রিকেট মোড়লদের হীন মানসিকতা, শাসন করার দৃঢ় মনোভাব, অর্থের দাপট দেখানো ও নিজেদের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে স্থির থাকার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই জয়ী হবে ক্রিকেটের তিন ধরনের সংস্করণ, জয়ী হবে ক্রিকেট।

০৫ জুলাই,২০১২ ইং।
মো: মুজিব উল্লাহ: mdmujib_ullah@yahoo.com
ফেসবুকেও ফিডব্যাক দিতে পারবেন।