ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (৮ম পর্ব)

মোঃ মুজিব উল্লাহ
Published : 7 June 2012, 03:24 PM
Updated : 7 June 2012, 03:24 PM

(পূর্ব প্রকাশের পর)
জাতীয় দলের ক্রিকেট কোচ হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় দল এবং মিডলসেক্স ও টাইটানস ক্রিকেট ক্লাবের সাবেক কোচ অভিজ্ঞ রিচার্ড পাইবাসকে নিয়োগদান, ভারতের বিখ্যাত সাহারা গ্রুপের সাথে রেকর্ড ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে চার বছরের জন্য ক্রিকেট দলের স্পন্সরশীপ চুক্তি, জিম্বাবুয়ে সফরের দলে আশরাফুল, জুনায়েদকে ফিরিয়ে আনা, সব শঙ্কাকে পিছনে ফেলে বিতর্কিত প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগ পুনরায় চালু করা ইত্যাদি মিলিয়ে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনে সুসময়ের হাওয়া বইছে। নতুন কোচের অধীনে টি টুয়েণ্টি বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুয়ে ও ইউরোপ ট্যুরে টাইগাররা জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও নেদারল্যাণ্ডের বিপক্ষে ৯ টি টি টুয়েণ্টি ম্যাচে কেমন করে তা দেখার অপেক্ষায় ক্রিকেট মহল।

ব্যস্ত ক্রিকেটসূচীর জন্য বিশ্রাম না পাওয়া তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান জিম্বাবুয়ে সফর থেকে অব্যাহতি চেয়ে বিশ্রামের জন্য আবেদন করেছেন। বোর্ড সভাপতি এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বল ঠেলে দিয়েছেন ক্রিকেট পরিচালনা কমিটির কোর্টে। তবে নতুন কোচ বিশ্রামের পক্ষে। বিশ্রামের সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগ থেকে দূরে না থেকে জাতীয় দল থেকে দূরে থাকার এ সিদ্ধান্তে দলের প্রতি সাকিবের কমিটমেন্টের ক্ষেত্রে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়।

সেপ্টেম্বরে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিতব্য টি টুয়েণ্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সম্ভাব্য স্কোয়াড নিয়ে আলোচনায় চলুন আজ দৃষ্টি দিই পেস এ্যাটাকের দিকে। খেলোয়াড়দের ঘন ঘন ইনজুরি, অধারাবাহিকতা, ফর্মহীনতা, কম গতিতে বোলিং, অতিরিক্ত রান দেওয়ার প্রবণতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত টাইগারদের পেস শক্তি। বোলিং এর গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগ দূর্বল হলেও স্বল্প দৈর্ঘ্যের টি টুয়েণ্টি ভার্সনে মাশরাফি, নাজমুলদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে তো আর বাঁধা নেই!

টাইগারদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা পেস বোলার হলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ইনজুরির সাথে ভীষন সখ্যতা এ পেসারের। যখনই ফিট হয়ে জাতীয় দলে ফিরেন নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দেন। পেস আক্রমণের নেতৃত্ব থাকা মাশরাফি ৩৬ টি টেস্ট ও ১২৪ টি ওয়ানডের পাশাপাশি ১৩ টি আন্তর্জাতিক টুয়েণ্টি খেলেন। এতে ৮.৭৮ ইকোনমিতে ২৯.৭ স্ট্রাইক রেটে ৪৩.৫০ গড়ে ১০ উইকেট লাভের পাশাপাশি ১২০.৫১ স্ট্রাইক রেটে ১৫.৬৬ গড়ে ১৪১ রান করেন যা কয়েকজন স্বীকৃত ব্যাটসম্যানের চেয়েও ভাল। তার ইনিংসের শেষ দিকে ক্যামিও ইনিংস খেলার দক্ষতা দলের জন্য যথেস্ট কার্যকরী। ইনজুরি থেকে ফিরে এশিয়া কাপে তার দুরন্ত বোলিং সমর্থকদের আশান্বিত করেছে। বড় দলগুলোর বিপক্ষে জ্বলে উঠার প্রবণতা, অভিজ্ঞতা ও সাম্প্রতিক আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি মিলিয়ে বিশ্বকাপে দল তার দিকে চেয়ে থাকবে।

দলে সুযোগ পেয়ে এশিয়া কাপে নিয়ণ্ত্রিত বোলিং করে ক্রীড়ামোদীদের নজর কেড়েছেন আরেক পেসার নাজমুল হোসেন। এশিয়া কাপের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ম্যাচে দারুণ বোলিং করে ৪.২৫ ইকোনমিতে ১৭ গড়ে ৪ উইকেট লাভ করে তিনি দলে সফিউল ইসলামের অভাব বুঝতেই দেন নি। ৩৮ টি ওয়ানডেতে ৪৪ টি ও ২ টেস্টে ৫ উইকেট পাওয়া এ বোলার দলে অনিয়মিত থাকায় মাত্র ২ টি আন্তর্জাতিক টি টুয়েণ্টি খেলে ১ টি উইকেট লাভ করেন। তবে লঙ্কান কণ্ডিশনে তার উইকেট টু উইকেট বোলিং কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে ক্রিকেট বোদ্ধাদের ধারণা। তার আগে আসন্ন দুটি সফরে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো পাচ্ছেনই।

১২ টেস্ট, ৩৭ টি ওয়ানডে ও ৫ টি টি-টুয়েণ্টি খেলে যথাক্রমে ১৭,৪৮ ও ৩ উইকেট পাওয়া পরীক্ষিত দ্রুতগতির বোলার রুবেল হোসেন ইনজুরিতে পড়ে মাঠের বাইরে। একইভাবে আরেক প্রতিশ্রতিশীল খেলোয়াড় সফিউল ইসলাম এশিয়া কাপের সময় ইনজুরিতে পড়ে দলের বাইরে আছেন।তিনি এ পর্যন্ত ৬ টি টেস্ট, ৪৫ টি ওয়ানডে (৫১ উইকেট) ও ৫ টি আন্তর্জাতিক টি-টুয়েণ্টি খেলেছেন। বিশ্বকাপের আগে সম্পূর্ণ ফিট হয়ে তাদের দলে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর এ সুযোগে অনেক দর্শক ও ক্রিকেট বিশ্লেষকদের চোখে ভিলেন বলে বিবেচিত শাহাদাত হোসেন নির্বাচকদের বিবেচনায় থাকতে পারেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরের এ ভার্সনে ৫ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৪ উইকেট লাভকারী এ বোলার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ৩৩ টেস্টে ৬৮ টি ও ৫০ টি ওয়ানডেতে ৪৬ উইকেট লাভ করলেও নিয়ণ্ত্রনহীন বোলিং, প্রচুর ওয়াইড, নো বল করার মাধ্যমে দলের বেশ কয়েকটি ম্যাচে হারার পেছনে দায়ী হিসেবে অনেকের কাছেই অভিযুক্ত।

সু নিয়ণ্ত্রিত লাইন-লেংথ ও সুইং বোলিংয়ের মাধ্যমে একসময় দলের অন্যতম পেস ভরসা ছিলেন সৈয়দ রাসেল। ইনজুরি ও ফর্মহীনতার কারণে দলে অনিয়মিত বোলার শ্রীলংকান কণ্ডিশনের সাথে মানানসই বলে নিয়মিত বোলারদের ইনজুরির সুবাধে অন্যদের টপকে স্কোয়াডে জায়গা করে নিতে পারেন। ৮ টি আন্তর্জাতিক টি-টুয়েণ্টি খেলে তিনি মাত্র ৪ উইকেট পেলেও ৬.৯৬ ইকোনমি সত্যিই ইর্ষণীয়। ওয়ানডেতেও ওভারপ্রতি ৪.৬৩ রান দিয়ে পেসারদের মধ্যে অন্যতম মিতব্যয়ী বলে স্বীকৃত। ৫২ ওয়ানডেতে ৬১ উইকেট লাভ ও ৬ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা তাকে এগিয়ে রাখবে।

জিম্বাবুয়ে সফরে দলে ডাক পাওয়া ২০ বছর বয়সী পেস বোলার আবুল হাসানের সামনে নিজেকে মেলে ধরার এক মোক্ষম সুযোগ। পেসার সংকটের এ সময়ে আসন্ন দুটি ট্যুরে যদি ভাল খেলতে পারেন তাহলে শ্রীলংকাগামী বিমানের টিকেট হয়তো পেয়ে যাবেন। অপরদিকে কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা না থাকা বোলিং অলরাউণ্ডার জিয়াউর রহমানের সামনেও সেই হাতছানি! লোয়ার অর্ডারে ঝড়ো গতিতে ব্যাট করতে পারার দক্ষতা তাকে তরুণ অন্যান্য খেলোয়াড়দের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রাখবে। পারবেন কি তিনি অলরাউণ্ডার অথবা পেস কোটায় দলে স্থান করে নিতে? এছাড়াও ৭ টি ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তরুন পেসার ডলার মাহমুদ, আল আমিন, আলাউদ্দিন বাবুসহ বেশ কয়েকজন উদীয়মান খেলোয়াড়ের কথাও নির্বাচকমণ্ডলী ভাবতে পারেন। তবে যেটাই হোক না কেন পেস বোলিং শক্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।

জিম্বাবুয়ে সফরে কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিজেদের ফিরে পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ঠিক একইভাবে সম্ভাব্য বাকি খেলোয়াড়দেরও ইউরোপ ট্যুরে সুযোগ দেওয়া উচিত।দুই ট্যুরের পারফরম্যান্স, অতীতের রেকর্ড ও অভিজ্ঞতা সব দিক হিসেবে নিয়ে বিশ্বকাপের জন্য চূড়ান্ত দল ঘোষণা করলে ভাল করতে পারে টাইগাররা।

সম্ভাব্য টি-টুয়েণ্টি স্কোয়াড নিয়ে ধারাবাহিক এ আলোচনা শেষে অভিজ্ঞতা, অতীত ও বর্তমান পারফরম্যান্স, শ্রীলংকান কণ্ডিশন, প্রতিভা ও সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে ইনজুরিতে আক্রান্ত খেলোয়াড়দের বাদ দিয়ে সম্ভাব্য ১৪ জনের স্কোয়াড আমার মতে নিম্নরুপ হওয়া উচিত:

মুশফিকুর রহিম (অধিনায়ক), মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (সহঅধিনায়ক), তামিম ইকবাল, মোহাম্মদ আশরাফুল, জুনায়েদ সিদ্দিকী, নাসির হোসেন, আনামুল হক, সাকিব আল হাসান, জিয়াউর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, ইলিয়াস সানি, মাশরাফি বিন মুর্তজা, নাজমুল হোসেন ও সৈয়দ রাসেল।

স্ট্যাণ্ডবাই: নাজিম উদ্দিন, আবুল হাসান, নাঈম ইসলাম, অলক কাপালি, এনামুল হক জুনিয়র, জহিরুল ইসলাম।

আসন্ন দুটি সফরে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা নতুন কোচের অধীনে সংগঠিত একটি ইউনিট হিসেবে খেলবে এ প্রত্যাশা সবার। বিশ্বকাপের আগে এ দুটি ট্যুর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর বিশ্বকাপের চূড়ান্ত স্কোয়াড ঘোষণার সময় নির্বাচকরা পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে নিরপেক্ষভাবে দল ঘোষণা করবেন এ অপেক্ষায় ক্রিকেটপ্রেমীরা। সংক্ষিপ্ত সংস্করণে টাইগাররা শক্তিশালী পাকিস্তান ও নিউজিল্যাণ্ডের বিপক্ষে ভাল খেলে সামনের দিকে অগ্রসর হবে – এমন আশায় আছে ক্রীড়ামোদীরা। এশিয়া কাপে টাইগারদের অসাধারণ সাফল্য প্রত্যাশার পালে লাগিয়েছে হাওয়া। সাফল্যের স্রোতধারায় সামনের দিকে চলবে কী মুশফিকদের ক্রিকেটতরী? তাহলে চলুন, আজই সম্ভাবনার নতুন স্বপ্ন বুনে শুরু করি বিশ্বকাপের কাউণ্ট ডাউন…

(চলবে)

মোঃ মুজিব উল্লাহ: mdmujib_ullah@yahoo.com

পূর্ববর্তী পর্বগুলোর লিংক:
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (১ম পর্ব)
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (২য় পর্ব)
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (৩য় পর্ব)
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (৪র্থ পর্ব)
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (৫ম পর্ব)
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (৬ষ্ঠ পর্ব)
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ! (৭ম পর্ব)