মানুষ কেন সফল হয়? অথবা মানুষ কেন তার গন্তব্যে পৌঁছুতে পারে না? উহু। এটা ফুটপাতে 'আপনিও সফল হবেন', 'সাফল্য লাভের একশ উপায়', 'সহজে কোটিপতি হবার কৌশল' – এ টাইপের কিছু না। কারণ, পাওলো কোয়েলহো দেখিয়েছেন যে, 'সাফল্যের কোন শর্টকার্ট নাই।' শর্টকার্টে লাভবান হওয়া যায় চুরি করে, ডাকাতি করে, জুয়া খেলে। যাবেন সে পথে? যাবেন না।
উপন্যাসের নায়ক এক কিশোর। স্পেনের আন্দালুসিয়ায় তার বাস। একটু বড় হবার পর সে চাইল ভ্রমণে বের হবে। তার বাবা বলল, ঘুরে বেড়ানোর জন্য মেষপালক হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিছু ভেড়া কিনে সে হয়ে গেল মেষপালক। তার ভেড়ার পাল নিয়ে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল এখান থেকে সেখানে। ভেড়ার সাথে থাকতে থাকতে একসময় সে তাদের ভাষা বুঝতে পারে- তাদের চাহিদা, অভাব, অভিযোগ সে উপলদ্ধি করে। বিনিময়ে সে পায় ধৈর্য্যের শিক্ষা। তার সময় কাটে কিছুদিন আগেই পরিচয় হওয়া ব্যবসায়ীর কন্যাকে নতুন কি গল্প শোনাবে তার চিন্তার আর স্বপ্নিল চোখে সমুদ্রের অপর পাড়ের মূর দেশের দিকে চেয়ে। স্পেনের উপকূল থেকে জাহাজে মাত্র দু' ঘন্টার পথ। অথচ তার মতো আর কোন মেষপালকই ওখানে যাবার ইচ্ছা করেনি।
হঠাৎ করে একদিন সে স্বপ্ন দেখে গুপ্তধনের। এরপর থেকে তার ছুটে চলা সেই গুপ্তধনের রহস্যের সন্ধানে। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কিশোর যায় অচেনা মূর দেশে। স্পেনে আরব মুসলমানদের মূর নামেই ডাকা হয়। এক সময়কার স্পেন বিজয়ী মুসলমানরা এসেছিল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আরব দেশ হতে। সেখান থেকে সমুদ্রের উপর দিয়ে যে বাতাস আসে তাকে তারা বলে ল্যাভানটার। সে আরেক গল্প।
সদ্য আরবে এসে এক ঠগবাজের কাছে অভিযানের জন্য জমানো সব সম্পদ খুইয়ে ফেলে। এরপর সে কাজ নেয় এক ক্রিস্টালের দোকানের কর্মচারী হিসেবে। পরিশ্রমী, ধৈর্য্যশীল এই কিশোর সেখানেও তার বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা দিয়ে চমক লাগিয়ে দেয়। কিন্তু সে ভোলেনা তার স্বপ্বের কথা। সমৃদ্ধির জীবন ছেড়ে সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেয় দুর্গম সাহারা মরুভূমি। পৌঁছে এক মরুদ্যানে। প্রকৃতির ইশারায় শান্ত, নিরাপদ মরুদ্যানকে বাঁচিয়ে দেয় ভয়ানক শত্রুর আক্রমন থেকে। পরিচয় হয় ফাতেমা নামের বেদুঈন কন্যার সাথে। সে তাকে বলে বেদুঈন মেয়েরা তাদের স্বামীর জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করে থাকে। সুতরাং, সে যেনো পিছুটান ভুলে গুপ্তধনের সন্ধানে বের হয়।
কিশোর এগিয়ে যায়। পথে পথে আক্রান্ত হয়। এরপরও সে থামেনি। প্রকৃতির ইশারা থেকে ঠিক করে নেয় যাত্রাপথ। তবুও স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা এই কিশোর কখনো বিচ্যুত হয়নি তার বিশ্বাস থেকে। সে জানত তার গুপ্তধনের সন্ধান সে পাবেই। এসকল বাধা-বিপত্তি তাকে সাহস জুগিয়েছে। মরুভূমির নির্জনতা, বাতাসের মুখরতা আর ভেড়ার পালের অপরিসীম ধৈর্য্য তাকে শিখিয়েছে মহাবিশ্বের ভাষা। সে ভাষায় সে কথা বলেছে আকাশের সাথে, সূর্যের সাথে। নিজেকে পরিণত করেছে প্রচন্ড ঝড় সাইমুমে। এসকল কাজে তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে রহস্যময় আলকেমিস্ট।
অ্যালকেমিস্ট হলো এক রহস্যময় ব্যক্তি যে লোহাকে স্বর্ণে রূপান্তর করতে পারে। যে জানে মহাবিশ্বের ভাষা। ইংলিশম্যান তার সন্ধানে বছরের পর বছর ঘুরে ফেরে। লোকে বলে তার বয়স নাকি দু'শো বছর। কিশোর নায়কের লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ় মনোবল, প্রতিজ্ঞা অ্যালকেমিস্টকে মুগ্ধ করে। কিশোরকে পথ দেখিয়ে সে পৌঁছে দেয় পিরামিডের কাছে।
দীর্ঘ উত্থান আর পতনের পর কিশোর ঠিকই তার গুপ্তধন খুঁজে পায়। তার লক্ষ্যে সে ঠিকই পৌঁছে। কিন্তু এ পরিশ্রম আর কষ্ট কিন্তু তাকে গুপ্তধনের চাইতেও অনেক অনেক বড় জিনিস উপহার দেয়। তা হলো জীবনের গুঢ় রহস্য- মহাবিশ্বের ভাষা বোঝার ক্ষমতা। যে ভাষায় স্রষ্টা আর সৃষ্টির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত। যে ভাষা বুঝলে সৃষ্টি বুঝে যায় তার স্রষ্টার উদ্দেশ্য।
বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় অংশ হলো 'মুখবন্ধ।' আমার মনে হয় বইটির যে ত্রিশ লক্ষ কপি পৃথিবীজুড়ে বিক্রি হয়েছে তার মূল কারণ এই মুখবন্ধ। মানুষের ব্যর্থ হবার জন্য লেখক চারটি কারণ এখানে উল্লেখ করেছেন। পড়ে দেখুন, মনে হবে এগুলো বুঝি আপনার জীবনের সাথেও মিলে যায়।