বিদ্যুৎখাতে বর্তমান সরকারের সাফল্য ও সমালোচনার যৌক্তিকতা

আবদুল্লাহ-হারুন-জুয়েল
Published : 17 July 2012, 03:25 AM
Updated : 17 July 2012, 03:25 AM

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইতিহাসে দেখা যায় ১৯৪৭ সালের পূর্বপর্যন্ত শাসকর্তারা মূলত প্রাইভেট সেক্টরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো যা ১৭টি প্রাদেশিক রাজ্যে সীমিত আকারে ব্যবহৃত হত। সর্বমোট উৎপাদন ক্ষমতা ছিল পর্যায়ক্রমে সর্বোচ্চ ১৭ মে:ও:। পাবলিক সেক্টরে প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয় ১৯৬০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে (স্টীম টারবাইন)। পরবর্তীতে একে একে আরও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্তাপিত হয়। ১৯৬২ সালে ৪০ মে:ও: ক্ষমতা নিয়ে স্থাপিত হয় কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ। এর ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে ১৯৮৮ সালে দাঁড়ায় ২২০ মে:ও:।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বিবেচনা করলে ১৯৭০,১৯৮০, ১৯৯০, ২০০০, ২০১১ এবং ২০১২ সালে ছিল যথাক্রমে ২২৫, ৬২৫, ১৮০৪, ৪০০৫, ৫৮০০, ৭৮১৪ এবং ৮০৯৯ মেগাওয়াট। এসময়ে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপিদনের পরিমান ছির যথাক্রমে ১১, ২০, ৭০, ১২০, ২১২ এবং ২১৫ কিলোওয়াট।

বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব অত্যাধিক বিবেচনায় এ খাতের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিষয়টি প্রচার করেছে এবং অনেকে প্রাপ্ত তথ্য বা প্রচারণা থেকে এ সংশ্লিষ্ট কিছু প্রশ্ন ও মন্তব্য উত্থাপিত করেছে যেমনঃ
১. রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন করা হলো?
২. এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়?
৩. কেন এত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলো?
৪. কেন তেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে উৎপাদন ব্যয় বাড়ানো হলো?
৫. পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা যেত, পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর করে সমস্যার সমাধান করা যেত।
৬. কেন টেন্ডার ছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হল? ৭. পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে অর্থ অপচয় করা হয়েছে।
৮. কেন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলো না?
৯. বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে, রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে অর্থনীতি ধ্বংস করা হচ্ছে।
১০. কতটা পুরাতন যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে?
এরকম আরো অনেত প্রশ্ন অনেকের মাঝে আসছে। আমরা মনে করি এ সকল বিষয়ে সরকারের বক্তব্য, তাদের গৃহীত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা এবং অর্জিত সাফল্য এবং পদক্ষেপ সমূহের সমালোচনার যথার্থতা ও ব্যাখ্যা জনগণের জানা প্রয়োজন।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন দেশে বিদ্যুৎ সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। বর্তমান সরকার যেদিন দায়িত্ব গ্রহন করে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৯৩১, পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ চাহিদা ৪০০০ মে:ও: এর বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৩২১৭ মে:ও:। সে বছর সেচ মওসুম এবং গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম হওয়ায় বিদ্যুৎ খাতের অবস্থা ছিল চরম নাজুক।

২০০৯ সালের কয়েকটি সংবাদপত্রের শিরোনামঃ
• লোডশেডিং এ অতিষ্ট মানুষ, কেরানীগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে হামলা ভাংচুর (দৈনিক জনকন্ঠ, ২০ জুন, ২০০৯)
• নীলফামারিতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট: ১৫ ঘন্টায় ৫০ বার। (দৈনিক জনকন্ঠ, ২০ জুন, ২০০৯)
• তীব্র দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে লোডশেডিং (দৈনিক জনকন্ঠ, ২১ জুন, ২০০৯)
• লোডশেডিংয়ের সময়সূচীও ভেঙ্গে পড়েছে (প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল, ২০০৯)
• রাজশাহীতে অসহনীয় গরমে জনজীবন অতিষ্ট (দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ এপ্রিল, ২০০৯)

এক নজরে বিদ্যুৎখাতের তিন বছরঃ
• তিন বছরে উৎপাদন বেড়েছে ৮৫%
• তরল জ্বালানি ভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১২২৭ মে:ও:।
• উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা ৩ বছরে ৬০০ মে:ও: বেড়েছে।
• রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত না হলে কোন কোন জায়গায় লোডশেডিংয়ের হার হতো ১২-১৬ ঘন্টা।

সমসাময়িককালে বাংলাদেমে সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত বর্তমান সরকার জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ সমীচীন মনে করে যার কোন বিকল্প ছিল না। আমরা জানি বিদ্যুতের অভাবে কৃষকের সেচ হয়, কলকারখানা ও জন-জীবনে মারাত্বক সমস্যা সৃষ্টি হয়। বিগত ২০০৯ সালের সেচ ও গ্রীষ্ম মওসুমে অফিসিয়াল হিসাবে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়ে প্রতি মাসে ১২০ ঘন্টা লোডশেডিং হয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা সরবরাহের চেয়ে প্রকৃত চাহিদা অনেক বেশি হয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার চারস্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
১. তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য ১৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা ৬ মাস থেকে ১২ মাসের মধ্যে উৎপাদনে আসবে।
২. স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার আওতাধীন ৪৫৮৮ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ছোট আইপিপি এবং সরকারী খাতে পিকিং প্ল্যান্ট যা ১-২ বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসবে।
৩. মধ্য মেয়াদী ৩-৪ বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসবে এমন পরিকল্পনা আওতায় আছে সরকারী ও বেসরকারী খাতে ডুয়েল-ফুয়েল ও গ্যাস ভিত্তিক ৫১৫৯ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং
৪. ৫ বছরের ঊর্ধ্বে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় ৭৯৭৮ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা ও পরমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

রেন্টাল ও ছোট আইপিপিগুলোর প্রয়োজন মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিয়ে মেটানো যাবে এবং পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয়া হবে।
রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এ সরকারের মেয়াদে প্রথম ৫০০ মে:ও: বিদ্যুতের জন্য টেন্ডার আহবান করা হয় ০৯/০৯/২০০৯ তারিখে। টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখের মধ্যে মোট ৩০০ মেগাওয়াটের কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রতিযোগিতামূলক দরের ভিত্তিতে এ সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যাদেশ দেয়া হয়।

উৎপাদনরত সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

ক্রমিক নং ১ ও ২ নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে উৎপাদনে আসে এবং নির্ধারিত ক্ষমতার ৫০-৭০% বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। ক্রমিক নং ৪ ও ৫ এর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

প্রতিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্য একজন করে দক্ষ প্রকৌশলীকে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। মন্ত্রণালয়ে মাসিক ভিত্তিতে উদ্যোক্তাগণকে নিয়ে বাস্তবায়ন মনিটরিং করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকল্প পরিচালকগণ প্রকল্পের চলমান কাজের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রেরণ করে। এই টেন্ডারের সফলতা বা ব্যর্থতা পর্যালোচনা করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট ২০০৬ এর ৬৬ ধারা অনুযায়ী সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে কয়েকটি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র "বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০" এর আওতায় সম্পাদন করা হয়।
সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া এবং ২০১০ সালে নতুন আইনের আওতায় রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত তথ্যচিত্র নিম্নরূপঃ

রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট


এ তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শুধুমাত্র ক্রমিক নং ১৮ বাস্তকায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ক্রমিক নং ২-৫ ছাড়া অন্য সকল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে স্থাপিত হয়েছে এবং নির্ধারিত সময়ের কাছাকাছি সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রথম তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এক্ট ২০০৬ এর আওতায় উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে। অন্য রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট ২০০৬ এর ৬৬ ধারা মোতাবেক সরাসরি সংগ্রহ পদ্ধতি এবং ২০১০ সালের বিশেষ আইনের আওতায় বাস্তবায়িত হয়েছে। উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সফলতার হার ৫০% এর নিচে অন্যদিকে সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া ও নতুন আইনের আওতায় সফলতার হার ৯৩.২৭ৎ। এতে দেখা যাচ্ছে রেন্টাল ২২টি প্ল্যান্টে ১৭৮৩ মে:ও: ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যাদেশ দেওয়া হয় যার মধ্যে ২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৬৫৩ মে:ও: বাস্তবায়িত হয় অর্থাৎ বাস্তবায়নের হার ৯২.৭%।

পুরাতন যন্ত্রপাতিঃ
নতুন বা পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় ক্রমিক নং ২-৫ নং উদ্যোক্তা পুরাতন যন্ত্রপাতি আমদানী করে। একটি বিবেচ্য বিষয় হল যেহেতু রেন্টাল পদ্ধতি তাই চুক্তি অনুযায়ী রেন্টাল কোম্পানীর উৎপাদিত বিদ্যুৎ নির্ধারিত মূল্য ক্রয় করছে সরকার। তাই কিভাবে সর্বোচ্চ বা কাঙ্খিত উৎপাদন করবে সেটি উদ্যোক্তারই উদ্বিঘ্ন হবার বিষয়। ক্রমিক নং ২-৫ আন্তর্জাতিক রেন্টাল কোম্পানী যারা তাদের পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই সকল সময় স্থাপিত ক্ষমতার বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। বাস্তবায়িত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে মোট ২টি প্ল্যান্টের ২১৫ মে:ও: এর যন্ত্রপাতি পুরাতন কিন্তু কার্যক্ষম। তাই সকল রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে স্থাপিত হয়েছে এমন মন্তব্য সঠিক নয়। উল্লেখ্য নির্ধারিত পরিমান উৎপাদন না করতে পারলে সরকার কর্তৃক জরিমানাসহ বিধিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতাও চুক্তিতে রয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে ২০০৯ সালে ২৫৬ মে:ও:, ২০১০ সালে ৭৭৫ মে:ও:, ২০১১ সালে ১৭৬৩ মে:ও: এবং ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত ৪৮৬ মোঃওঃ সহ মোট ৩৩৮০ মোঃওঃ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। তন্মধ্যে সরকারী কার্যাদেশ দেয়া ১৬৫৩ মোঃওঃ তরল জ্বালানি ভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র মাত্র ১২২৭ মে:ও:। এ যাবত স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হয় ৮০৯৯ মে:ও: এবং ২২ মার্চ ২০১২ তারিখে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ৬০৬৫.৫ মে:ও: যা ২০০৯ সালের জানুয়ারির তুলনায় ৮৫% বেশি অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত না হলে কি হতো?
২০০৯ সাল পর্যন্ত চালু থাকা ৩২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কেন্দ্র সহ তখনকার ও বর্তমান সময়ের সর্বমোট উৎপাদনের একটি তুলনামূলক চিত্র দেয়া হলঃ

৬ জানুয়ারী ২০০৯ তারিখে যে সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্তাপিত ছিল সেগুলো থেকে ৩২৬৭.৬ মে:ও: বিদ্যুৎ উৎপাদিত হত যার উৎপাদন ২৬ জুন ২০১২ তারিখ দাঁড়ায় ৩৮৬০ মে:ও:। শুধুমাত্র উন্নত ব্যবস্থাপনার কারণে তিন বছরে উৎপাদন না কমে বেড়ে আরও ৬০০ মে:ও: যুক্ত হয়েছে।

কুইক রেন্টাল সম্পর্কে কিছু কথা
বিগত চারদলীয় সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় ২০০৫ সালে বেগম খালেদা জিয়া কুইক রেন্টাল সিস্টেমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদ্যুৎখাতের অন্যতম পরিকল্পনা প্রণয়নকারী বিডি রহমতউল্লার ভাষ্য অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ১২টি কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের প্রস্তাব করা হয়। বেগম জিয়া তাকে এর সংখ্যা ২২ টি করতে বলেন। এক পর্যায়ে ৩৫ পর্যন্ত প্রস্তাবনা আসে এবং বিডি রহমতউল্লাহর তত্ত্বাবধায়নে ৫০টি প্ল্যান্টের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয় যার একটিও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করতে তারা সক্ষম হয়নি।

জ্বালানি : কয়লাভিত্তিক প্রকল্প এবং তেলে ভর্তুকী প্রসঙ্গ
বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বড় সমস্যা জ্বালানি সংকট। যে কোন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উৎপাদনমূল্য এবং ক্রয়মূল্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। আমাদের দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও আছে। কিন্তু কয়লার পর্যাপ্ত যোগান, খনি থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে উত্তোলন ব্যয় এবং পরিবহন ও সরবরাহসহ ইউনিট প্রতি সম্ভাব্য খরচ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কয়লা বা গ্যাস সবক্ষেত্রেই চাহিদাসহ সকল সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে উদ্যোগ গৃহীত হয়। তাই কয়লা, গ্যাস এবং তেল এ সকল জ্বালানিভিত্তিক সবচেয়ে সুলভ ও বাস্তবায়নযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।

২০০৯ সাল পর্যন্ত আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল জ্বালানি ছিল প্রাকৃতিক গ্যাস। পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগই নেননি। গ্যাসভিত্তিক ৭০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প (যা আমাদের পূর্বেই ছিল) গ্যাসের অভাবে চলতে পারেনি। কাজেই গ্যাসভিত্তিক বেজ প্ল্যান্ট স্বল্প সময়ের মধ্যে (যদিও সম্ভব নয়) নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও খুব একটা লাভ হত না। তেলের উপর নির্ভরশীলতা অপরিহার্য হয়ে পরেছিল। যার ফলে বর্তমান সরকারকে জরুরিভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সাময়িক সমাধান হিসেবে ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেলের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। তেলের ক্ষেত্রে ভর্তুকীর যে কথা বলা হয় সেক্ষেত্র একটি বিষয় জনগণের অবগত হওয়া প্রয়োজন যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে তেল সরবরাহ করা হয় না। তারা তেল ক্রয় করে নেয়। আমরা ব্যক্তিগত ক্ষেত্র যেমন গাড়ীতে যে তেল ব্যবহার করি তাতেও সরকারী ভর্তুকী রয়েছে। তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ইচ্ছে মতো তেল নিচ্ছে এটি অযোক্তিক বরং এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায় পক্ষান্তরে সরকার নির্ধারিত মূল্যেই বিদ্যুৎ ক্রয় করে। বিদ্যুত উৎপাদনে শতকরা হারে বিভিন্নতা থাকলেও অনেক কারণে সিস্টেম লস হয়। সরকারী খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে সিস্টেম লসের ভার সরকার তথা জনগণের উপর বর্তালেও রেন্টাল পদ্ধতিতে সিস্টেম লস উদ্যোক্তাকেই বহন করতে হয়।

প্রসঙ্গ পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র
পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করে কতটা চাহিদা পূরণ করা যেত, কেন পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র কম্বাইন্ড সাইকেলে উন্নীত করে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হল না এ ধরণের প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। যেকোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তা নতুন হোক বা পুরাতন হোক তার যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত একটি চলমান প্রক্রিয়া যা উৎপাদনক্ষম রাখার জন্য অব্যহত রাখতে হয়। আমাদের দেশে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো সেগুলোর ২৫ শতাংশ ২০ বছরের পুরনো। এর একটি বড় অংশ ৩০ থেকে ৩৫ বছরের পুরনো যা বিশ্বের অনেক দেশেই আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। আবার অনেক যন্ত্রপাতি মেরামত অযোগ্য। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেরামত বা কম্বাইন্ড সাইকেলে উন্নীত করতে উৎপাদন ক্ষমতা ভেদে সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে এক বছর এমনকি অনেক কেন্দ্রে ২ বছর সময় প্রয়োজন। গত তিন বছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেরামতের কাজ চলেছে এবং চলছে যার ফলে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে লক্ষনীয় অগ্রগতি দেখতে পাই। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংস্কারের উপর নির্ভর করলে ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান দেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না এবং জনগণের দূর্দশা শুধু চরমেই পৌঁছাতো না অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে তুলতো। রেন্টাল পদ্ধতি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা হিসাবেই গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে যার উপর এক সময়ে আর নির্ভরশীল হতে হবে না।

বিদ্যুতের মূল্য প্রসঙ্গ
আমরা এক সময়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথাও ভেবেছি। কিন্তু সরকারের উপর আস্থাশীল হয়ে উদ্যোক্তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে এটি কত বড় সাফল্য তা ভাবা প্রয়োজন। আমরা বেশী দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করছি এ অভিযোগও করা হয়। বিশ্বমন্দাসহ বিভিন্ন কারণে সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে পক্ষান্তরে আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের সাথে আমাদের দেশের ভোক্তাতের ক্রয়কৃত বিদ্যুতের মূল্যের তুলনামূলক চিত্রটি দেখলে আমাদের অবস্থান বোঝা যাবে।

সিস্টেম লসঃ
সিস্টেম লসে সরকারের অগ্রগতির একটি তুলনামূলক চিত্র দেয়া হলঃ

কুইক রেন্টালের কি বিকল্প ছিলনা?
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ১১টি রেন্টাল কোম্পানী কার্যাদেশ পায় যা থেকে উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ৩০০ মে:ও:। যদি রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয়া না হত তাহলে প্রতিদিন ৮ ঘন্টা থেকে স্থানভেদে ১২-১৬ ঘন্টা লোডশেডিং হত। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো ত্বরিতগতিতে স্বল্পমেয়াদে যদি না নেয়া হত তাহলে বাংলাদেশের জিডিপিতে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হত। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ খাতে তেলের ভর্তুকি এবং রেন্টাল পেমেন্ট বাবদ ১৬ হাজার ৬শ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। এই সহজ হিসাবটি না বোঝার কী হল? আরেকটি কথা অনেকেই বলে থাকেন আর তা হল কুইক রেন্টাল এবং রেন্টাল প্রকল্পগুলোর জন্য বিদ্যুতের দাম বেড়েছে কথাটি একবারেই অসত্য। কারণ বিদ্যুতের মূল্য বাড়ার মূল কারণ এর জ্বালানি। বর্তমান সরকারের সময়কালীন নির্মিত বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্তত ৬০০ মেগাওয়াটের মতো সরকারি প্রকল্প আছে তেলভিত্তিক সেগুলোও অনেক উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আবার ৪২৬ মেগাওয়াটের মতো গ্যাসভিত্তিক কুইক রেন্টাল প্রকল্প আছে যার বিদ্যুৎ উৎপাদন মূল্য অনেক কম।

ইতিমধ্যেই সরকার ২৪ লাখ নতুন সংযোগ দিয়েছেন। একটি সংযোগের সুবিধাভোগী গড়ে কমপক্ষে ৫ জন হলেও মোট ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এসেছে। এটি কম কথা নয়। কৃষিতে বাম্পার ফলন এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যে পথ প্রসারিত হয়েছে, গার্মেন্টস শিল্প সহ অন্যান্য শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক রপ্তানীতে রেকর্ড স্থাপন এসব সাফল্যের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণ অনেক। অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের কারণে বিদ্যুৎ অপচয় হয়, কারিগরী সিস্টেম লস, দূর্ণীতির কারণে সিস্টেম লস, নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা সব সীমাবদ্ধতার পরও জনগণের মূল বক্তব্য একটিই বিদ্যুৎ চাই। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলো ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাবে এবং এরইমধ্যে সরকারের অন্যান্য বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে চলে আসবে। বিদ্যুৎ নিয়ে আমরা যে সাময়িক সংকটে পড়েছিলাম তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠবো। আমরা আশাবাদী যে খুব নিকট ভবিষ্যতেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সঙ্কট থাকবে না।

কৃতজ্ঞতা : মোহাম্মদ এ আরাফাত, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড