আমরা কী খাচ্ছি? কোথায় নিরাপদ খাদ্য ?

আবদুল্লাহ-হারুন-জুয়েল
Published : 23 August 2012, 06:26 PM
Updated : 23 August 2012, 06:26 PM

খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব যা সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে। রাস্তার ফুটপাতের দোকান থেকে বড়/নামকরা কোম্পানিও ভেজাল খাদ্য সরবরাহের অভিযোগে অভিযুক্ত। গরুর দুধ থেকে শুরু করে মুরগীর ডিম নিয়েও শঙ্কিত ভোক্তারা। শিশু-খাদ্য নিয়ে অনেক তোলপাড় হয়েছে। ঢাকা-কেন্দ্রিক একটি খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা বা কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ছাড়া তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিএসটিআই এর চরম দায়িত্বহীনতা অভিযোগ রয়েছে। যারা ভেজাল খাদ্য নিয়ে সচেতন নয় তারা অন্তত নিশ্চিন্তে আছে।

ভেজাল খাদ্য ও খাদ্যের নিরাপত্তা
দুধ এবং ডিম নিরাপদ খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হতো কিন্তু এ নিয়েও ভেজাল। এক ধরনের পাউডার দিয়ে দুধ তৈরি করে মিল্ক-ভিটাসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। চীনে উদ্ভাবিত কৃত্রিম ডিম অনেক দেশে যাচ্ছে তবে বাংলাদেশে এখনো আসেনি বলে জানা যায়। এসব কৃত্রিম খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হানিকর।

মবিল মেশানো তেলে ভাজা চানাচুর, চিপসসহ কড়কড়ে অনেক স্ন্যাকস, বিষাক্ত রঙ দিয়ে শোভা বর্ধনকারী লোভনীয় খাবার, হোটেলের অপরিচ্ছন্ন খাবার, বাসী খাবার এগুলোকে বোধহয় দ্বিতীয় পর্যায়ের ভেজাল খাবার বললে ভাল হয়। কারণ এগুলো তৈরিতে যে মূল উপাদান ব্যবহার হয় সেগুলোই ভেজাল। চাল, আটা, তেল, মাছ, ফল, সবজি সবকিছুতেই ভেজালের অভিযোগ।

মাছ তাজা রাখতে বিষাক্ত ফরমালিন নিয়ে এক সময় ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হলেও এখন ভাটা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। মাছের মতো ফলমূল তাজা রাখতেও এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয় যার বিষক্রিয়ায় মাছিও ফলের কাছে আসে না। এ ব্যাপারে অনেকে সচেতন তাই এখন তাজা রাখার রাসায়নিক পদার্থের সাথে আরও একটি পদার্থ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা যায় যা মাছিদের আকৃষ্ট করে। এত ভেজালের মাঝে শাক-সবজিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক নিয়ে তো ভাবারই সময় নেই।

সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেল ভেজাল খাদ্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন দেখিয়েছে। তাদের অনুসন্ধানে বড় বড় প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতকৃত/প্রক্রিয়াজাতকৃত/সরবরাহকৃত খাদ্যে কোন না কোন ভেজাল রয়েছে বলে জানা যায়। তেল, সস, মশলা, ফ্রুট ড্রিংকস, দুধ কোনটিই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি।

বিএসটিআই যেন ভেজালের সনদ-দাতা
বিএসটিআই এর কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে ভেজাল পণ্য সহজেই বাজারের ছাড়পত্র পায়। জানা যায় তারা কয়েকটি পণ্যের স্যাম্পল দেখে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার চুক্তিতে অনুমতি প্রদান করে। অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষত বিভিন্ন পানীয় তৈরির প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইকে অবহিত না করেই অনুমোদনের সীলমোহর মেরে দেয়। তবে এককভাবে বিএসটিআইকে দোষ দেয়া যাবে না কারণ ঐসব প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সকল প্রভাবশালী মহলের সখ্য আছে তাই পানিতে থেকে কুমিরের সাথে লড়াই না করার উপায়ই শ্রেয় বলে মনে করে।

ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ
খাদ্যে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রিসারভেটিভ ও রঙ অন্যতম। ক্ষতিকর রঙের মধ্যে Blue 1 ও 2 ক্যান্ডি, পানীয় এবং বেকিং খাবারে ব্যবহৃত হয় একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে Blue 2 ইঁদুরের brain tumor সৃষ্টি করেছে। Red 3 ফ্রুট ড্রিংকস, ককটেল থাইরয়েডের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। Yellow 6 বিভিন্ন পানীয় সসসহ ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। এমনকি খাদ্যের মোড়ক হিসাবে ব্যবহৃত প্লাস্টিক মোড়কও ক্ষতিকর। Bisphenol A (BPA), Phthalates, Pesticides, Zeranol, rBGH/rBST, Styrene, Vinyl Chloride, Phytoestrogens ইত্যাদি উপাদানে প্রস্তুতকৃত মোড়ক খাদ্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

খাদ্য আদালত
২০০৭ সালে হাইকোর্ট ৬৪ জেলার প্রতিটিতে একটি করে খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়। ঢাকায় একটি খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা ছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশ শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। ঢাকার খাদ্য আদালতও সকল সহযোগিতা পায় না। তারা ভেজাল দুধের পরীক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল যার চিঠি চালাচালি হতে তিন বছর সময় লাগে। তিন বছর পর "কোন ভেজাল নেই" – এই মর্মে পরীক্ষার যে ফলাফল দেয়া হয়েছে সেটি দুধের নয়, আটার পরীক্ষার ফলাফল।

আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো যেসব অভিযান পরিচালনা করে তাদের কাছে ভেজাল সনাক্তকারী কোন যন্ত্রপাতি নেই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় কারণ কোন পরীক্ষা প্রয়োজন হলে ২/৩ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে জেল-জরিমানা হয় এবং খুব সহজেই মুক্ত হয়ে বা জামিনে বেরিয়ে এসে নবোদ্যমে ভেজাল তৈরি শুরু করে।

ভেজাল খাদ্যের প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার ছাড়াও কিডনি, লিভার, পাকস্থলী ইত্যাদির ক্ষতি করে থাকে। চিকিৎসা-বাবদ আমাদের যে বিপুল অংকের টাকা খরচ হয় তার নেপথ্যে যে ভেজাল খাদ্য রয়েছে তা তেমনভাবে আলোচিত হয় না। ভোক্তা অধিকার আইন বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কোনটিই কার্যকর হবে না যদি কর্তৃপক্ষ সক্রিয় না হয় এবং ভোক্তারা মানে আমরা সোচ্চার না হই।

[ আমাদের শরীরটা কতটা ভেজাল-প্রুফ এটি পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা চালু হলে খারাপ হয় না। ভাল মার্কেট পাবে।]